পৃথিবী রক্ষায় অভিনব আন্দোলন

অক্সফোর্ড সার্কাস এলাকায় গাট্টি-বোঁচকা নিয়ে রাস্তায় অবস্থান করছেন আন্দোলনকারীরা। ছবি: তবারুকুল ইসলাম
অক্সফোর্ড সার্কাস এলাকায় গাট্টি-বোঁচকা নিয়ে রাস্তায় অবস্থান করছেন আন্দোলনকারীরা। ছবি: তবারুকুল ইসলাম

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে পৃথিবীকে রক্ষায় যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনে চলছে এক অভিনব আন্দোলন। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট স্কয়ার, অক্সফোর্ড সার্কাস, ওয়াটারলু ব্রিজ, ম্যাফেয়ারসহ লন্ডনের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি স্থানে সোমবার থেকে যান চলাচল বন্ধ করে দিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। গাট্টি-বোঁচকা নিয়ে রাস্তায় নেমেছেন এসব বিপ্লবী পরিবেশবাদী। সড়ক বন্ধ করে দিয়ে রাস্তায় তাঁবু ফেলে দিন–রাত সেখানেই অবস্থান করছেন। তবে তাঁরা কোনো সংঘাতে জড়াচ্ছেন না, বরং স্বেচ্ছায় গ্রেপ্তার বরণ করছেন।

অভিনব এই অহিংস আন্দোলনের আয়োজক ‘এক্সটিঙ্কশন রেবেলিয়ন’ বা ‘বিলুপ্ত বিপ্লবী’। এসব আন্দোলনকারীদের বলা হচ্ছে ‘ইকো ওয়ারিয়র’ বা ‘পরিবেশযোদ্ধা’।

ওয়েস্টমিনস্টারে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সামনে প্লাস্টিক বন্ধের দাবি নিয়ে এক প্রকৃতিপ্রেমী। ছবি: তবারুকুল ইসলাম
ওয়েস্টমিনস্টারে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সামনে প্লাস্টিক বন্ধের দাবি নিয়ে এক প্রকৃতিপ্রেমী। ছবি: তবারুকুল ইসলাম

গতকাল বৃহস্পতিবার আন্দোলনের তৃতীয় দিনে অক্সফোর্ড সার্কাস এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানকার ব্যস্ততম চৌরাস্তাটি আন্দোলনকারীদের প্রধান আস্তানা। বিশাল এক নৌকার আদলে মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। সেই নৌকায় ‘সমুদ্রের উচ্চতা বাড়ছে’, ‘জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে মানুষকে সত্য বলুন’ ইত্যাদি বার্তা লেখা। ওই নৌকা ঘিরে শত শত মানুষের জটলা। সেই জটলার মধ্যেই পুলিশ এক নারী আন্দোলনকারীকে ঘিরে আছে। পুলিশ তাঁকে বারবার করে বলছে, আন্দোলনের জন্য ম্যাফেয়ার এলাকায় স্থান বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ওই নারী যেন সেখানে চলে যান। অন্যথায় জনশৃঙ্খলাবিধি ভঙ্গের দায়ে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে। তবে পুলিশের কথায় কর্ণপাত না করে নির্বাক শুয়ে আছেন সেই নারী। খানিক পর পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। হাতকড়া পরিয়ে পুলিশের চার সদস্য পাঁজাকোলা করে সেই নারীকে নিয়ে যাওয়ার সময় ওই নারীর চোখে-মুখে ছিল দুষ্টু হাসি। এ যেন চোর-পুলিশ খেলা। সেই সঙ্গে স্লোগানে জেগে উঠল পুরো সমাবেশস্থল। গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তির উদ্দেশে সবাই স্লোগান দিচ্ছেন—‘উই লাভ ইউ, উই লাভ ইউ’। কিছুক্ষণ পর আরেকজনকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় পুলিশ। আবারও একই স্লোগানে জেগে উঠে সমাবেশ।

অহিংস এই আন্দোলনের অনন্য দিক হলো, স্বেচ্ছায় গ্রেপ্তার হতে চাইছেন আন্দোলনকারীরা। তাঁরা চান, যান চলাচল বন্ধ করে নিজেদের দাবি সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি পুলিশের কাজকে কঠিন করে তুলতে। গ্রেপ্তার ঘোষণামাত্রই তাঁরা শুয়ে পড়েন। যাতে তাঁদের তুলে নিয়ে যেতে পুলিশকে কসরত করতে হয়।

আন্দোলনকারীদের মধ্যে বেশ কয়েকজন আইনি পর্যবেক্ষককেও দেখা গেল। তাঁরা পুলিশের আচরণ প্রত্যক্ষ করছেন এবং গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের আইনগত অধিকারের বিষয়গুলো দেখছেন।

এর আগে ওয়েস্টমিনস্টারে গিয়ে দেখা যায়, ব্রিটিশ পার্লামেন্টের চারপাশের রাস্তা বন্ধ। ফাঁকা রাস্তায় ছড়িয়ে–ছিটিয়ে শুয়ে-বসে আছেন আন্দোলনকারীরা। অনেকেই রাস্তায় নিজেদের দাবির পক্ষে লিফলেট বিলি করছেন। কেউবা যান চলাচল ব্যাহত হওয়ায় দুর্ভোগে পড়া পথচারীদের আন্দোলনের যৌক্তিকতা বোঝাচ্ছেন।

লিফলেট বিলিতে ব্যস্ত থাকা কেটি উইলসন নামের এক নারী প্রথম আলোকে বলেন, তিনি পেশায় একজন স্কুলশিক্ষক। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে পৃথিবীর অস্তিত্ব যে হুমকির মুখে পড়েছে, এ নিয়ে অনেক দিন ধরেই তিনি কিছু করার তাগিদ বোধ করছিলেন। তিনি বলেন, গত বছর যখন পরিবেশবাদী সংগঠন ‘এক্সটিঙ্কশন রেবেলিয়ন’–এর যাত্রা শুরু হলো তখন মনে হলো, এই সংগঠনের সঙ্গেই তাঁর যুক্ত হওয়া উচিত। তাঁর মতে, যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়ার কারণে যে ভোগান্তি হচ্ছে, তা এই পৃথিবী রক্ষার বিবেচনায় অতি নগণ্য ত্যাগ। মানুষের কাছ থেকে তুমুল সমর্থন পাচ্ছেন বলে তিনি জানান।

অক্সফোর্ড সার্কাস এলাকায় তাঁবু ফেলে দিন-রাত রাস্তায় অবস্থান করছেন বিপ্লবী পরিবেশবাদীরা। ছবি: তবারুকুল ইসলাম
অক্সফোর্ড সার্কাস এলাকায় তাঁবু ফেলে দিন-রাত রাস্তায় অবস্থান করছেন বিপ্লবী পরিবেশবাদীরা। ছবি: তবারুকুল ইসলাম

সেখানে বেশ কয়েকজন আন্দোলনকারীর সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। তাঁদের অধিকাংশই শিক্ষক কিংবা শিক্ষার্থী।

গতকাল বৃহস্পতিবার বিরোধী দল লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিনের বাসার সামনে বসে পড়েন কয়েকজন আন্দোলনকারী। তাঁরা চান, করবিন যেন প্রকৃতিপ্রেমীদের দাবি আদায়ে জোরালো অবস্থান নেন।

স্কটল্যান্ডের এডিনবরা একই রকম আন্দোলন হচ্ছে। ‘এক্সটিঙ্কশন রেবেলিয়ন’ বলছে, বিশ্বের ৩৩টি দেশের মোট ৮০টি শহরে একই রকম আন্দোলন হচ্ছে। বৈশ্বিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে যুক্তরাজ্যে নিজেদের ভূমিকা পালন করছেন তাঁরা।

এক্সটিঙ্কশন রেবেলিয়নের মূল দাবি তিনটি—সরকার যেন দ্রুত জলবায়ু এবং পরিবেশগত জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে প্রকৃত তথ্য তুলে ধরে। ২০২৫ সালের মধ্যে যুক্তরাজ্যে কার্বন নির্গমনের হার শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে। জলবায়ুর পরিবর্তন মোকাবিলায় গৃহীত উদ্যোগ পর্যবেক্ষণে গণ–অ্যাসেম্বলি গঠন করতে হবে।

অক্সফোর্ড সার্কাস এলাকায় এক আন্দোলনকারীকে গ্রেপ্তারের প্রস্তুতি নিচ্ছে পুলিশ। সেখানে আন্দোলনকারীদের পক্ষে নজর রাখছেন একজন আইনি পর্যবেক্ষক (কমলা রঙের পোশাকে)। ছবি: তবারুকুল ইসলাম
অক্সফোর্ড সার্কাস এলাকায় এক আন্দোলনকারীকে গ্রেপ্তারের প্রস্তুতি নিচ্ছে পুলিশ। সেখানে আন্দোলনকারীদের পক্ষে নজর রাখছেন একজন আইনি পর্যবেক্ষক (কমলা রঙের পোশাকে)। ছবি: তবারুকুল ইসলাম

পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুসারে, গতকাল পর্যন্ত গ্রেপ্তার ব্যক্তির সংখ্যা পাঁচ শ ছাড়িয়ে গেছে। আন্দোলনকারীরা বলছেন, প্রতিদিন চার হাজারের মতো স্বেচ্ছাসেবী এই আন্দোলনে অংশ নিচ্ছেন। আরও হাজার হাজার আন্দোলনকারী গ্রেপ্তার হতে প্রস্তুত। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা ঘরে ফিরবেন না।

গতকাল আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে যুক্তরাজ্যের পরিবেশমন্ত্রী মাইকেল গোভকে দাবির বিষয়ে বৈঠকের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আজ শুক্রবার তাঁরা হিথ্রো বিমানবন্দর অচল করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।

সরকারের তরফ থেকে আন্দোলনকারীদের থামাতে কঠোর পদক্ষেপের হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু অহিংস এই আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কঠোর হওয়া নিয়ে ভালোই বিপাকে পড়েছে পুলিশ।

প্রসঙ্গত, যুক্তরাজ্যে যান চলাচল বন্ধ করে দিয়ে আন্দোলন এক বিরল ঘটনা। দেশটিতে সাধারণত সপ্তাহের ছুটির দিন শনি ও রোববার বিক্ষোভ হয়ে থাকে।