এই অন্ধকার থেকে মুক্তি দাও প্রভু!

রোববার ৮টি হামলায় রক্তাক্ত শ্রীলঙ্কা। এসব হামলায় নিহত দুই শতাধিক। ছবি: রয়টার্স
রোববার ৮টি হামলায় রক্তাক্ত শ্রীলঙ্কা। এসব হামলায় নিহত দুই শতাধিক। ছবি: রয়টার্স

এই অন্ধকার থেকে মুক্তি দাও প্রভু! গৃহযুদ্ধের সেই বিভীষিকাময় দিনগুলোতে কত কত শ্রীলঙ্কান হাঁটু গেড়ে প্রার্থনা করেছেন শান্তির খোঁজে। সেই রক্তের দাগ প্রায় শুকিয়েই গিয়েছিল। সেরে উঠছিল ক্ষত। কিন্তু আজ (২১ এপ্রিল, রোববার) এক আঘাতে রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধের সেই পুরোনো দুঃসহ স্মৃতির দিনগুলোতে যেন ফিরে গেল শ্রীলঙ্কা। ২০০৯ সালের পর এই প্রথম এত বড় সন্ত্রাসী হামলার শিকার হলো দেশটি। আজকের এই সন্ত্রাসী হামলায় মৃত্যুর সংখ্যা দুই শর কাছাকাছি পৌঁছে গেছে বলে কিছু সংবাদমাধ্যম দাবি করছে। সংখ্যাটি আরও বাড়তে পারে। কারণ আহত ও গুরুতর আহতের সংখ্যাও যে সাড়ে চার শ পেরিয়েছে। একক কোনো সন্ত্রাসী হামলায় হতাহতের সংখ্যায় অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে আজকের রক্তাক্ত রোববার ।

১৯৯০ সালের ১১ জুন তখনকার বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন তামিল টাইগার বা এলটিটিই শ্রীলঙ্কার পুলিশ বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায়। ধারণা করা হয়, সে ঘটনায় ছয় শতাধিক পুলিশ সদস্যকে হত্যা করেছিল এলটিটিই। সংখ্যার দিক দিয়ে একক কোনো সন্ত্রাসী হামলায় এটিই শ্রীলঙ্কার সর্বোচ্চ সহিংস ঘটনা হয়ে আছে। তবে নিরস্ত্র সাধারণ জনগণের ওপর হামলায় নিহতের সংখ্যায় আজকের ঘটনাটি অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ১৯৯২ সালে উত্তরাঞ্চলের মুসলিম অধ্যুষিত পল্লিয়াগোদেল্লা গ্রামে তামিল টাইগাররা ১৬৬-১৭১ জনকে হত্যা করে। এটিই এখন পর্যন্ত সাধারণ জনগণের ওপর চালানো সর্বোচ্চ হত্যাযজ্ঞের উদাহরণ। যেটিকে বলা পল্লিয়াগোদেল্লা ম্যাসাকার।

লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ইলম, সংক্ষেপে এলটিটিই, যারা তামিল টাইগার নামে বিশ্বজুড়ে পরিচিতি পায়। ২০০৯ সালে প্রায় পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় হওয়ার আগ পর্যন্ত শ্রীলঙ্কায় প্রতিটা দিন এক বিভীষিকার অভিজ্ঞতা এনে দিয়েছিল এই সংগঠনটি। স্বাভাবিকভাবে শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে কুখ্যাত সন্ত্রাসী হামলাগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে এদের নাম।

১৯৮৫ সালের ১৪ মে এলটিটিইর আরেক তাণ্ডবের নাম শ্রী মহাবোধি অ্যাটাক। এলটিটিই অনুরাধাপুরা শহরে ঢুকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের সাহায্যে নির্বিচার গুলি চালিয়েছিল। তাদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পায়নি বৌদ্ধদের কাছে খুবই পবিত্র মন্দির বলে বিবেচিত শ্রী মহাবোধি। সেখানেও তারা পুরোহিত এবং প্রার্থনা ও জীবন বাঁচাতে আশ্রয় নেওয়া সাধারণ মানুষদের ওপর গুলি চালায়। সে ঘটনায় মারা যায় ১৪৬ জন।

১৯৮৭ সালের এমনই এপ্রিল মাসে চার দিনের ব্যবধানে তামিল টাইগাররা বড় দুটি সন্ত্রাসী হামলা পরিচালনা করে। ১৭ এপ্রিল যাত্রীবাহী বাসের বহর থেকে যাত্রাপথে আলাদা হয়ে পড়া তিনটি বাস আক্রমণ করে তারা ১২৭ জনকে হত্যা করে, যাদের বেশির ভাগ ছিল তীর্থ কিংবা ছুটি থেকে ফেরা খ্রিষ্টান সিংহলি। তারা ২১ এপ্রিল বোমা মেরে উড়িয়ে দেয় কলম্বোর কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল, যে ঘটনায় মারা যায় ১১৩ জন সাধারণ নাগরিক।

এক সময় বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন তামিল টাইগার বা এলটিটিইর হামলায় রক্তাক্ত হতো শ্রীলঙ্কা। ছবি: সংগৃহীত
এক সময় বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন তামিল টাইগার বা এলটিটিইর হামলায় রক্তাক্ত হতো শ্রীলঙ্কা। ছবি: সংগৃহীত

১৯৯০ সালের ৩ আগস্ট আরও একবার বিশ্বব্যাপী সংবাদের শিরোনামে আসে এলটিটিই। চারটি মসজিদে হামলা চালিয়ে ১৪৭ জন মুসলিমকে হত্যা করেছিল তারা। এই ঘটনা কাট্টানকুডি মস্ক ম্যাসাকার নামে পরিচিত।

২০০০ সালের পর থেকে ধীরে ধীরে তামিল টাইগারদের দাপট কমে আসতে শুরু করে। এই সময়ের পরে একক হামলায় এক শ কিংবা এর বেশি নিহতের ঘটনা সর্বশেষ ঘটেছিল ২০০৬ সালে। সেবারের হামলাটি ঘটেছিল সেনা সদস্য, মূলত নৌসেনাদের ওপর। দুই শর বেশি নৌসেনাকে নিয়ে ১৫টি সামরিক বাসের বহর ত্রিঙ্কোমালি থেকে যাত্রা শুরু করেছিল। এই সেনা সদস্যরা মূলত ছুটি কাটাতে নিজেদের পরিবারের কাছে যাচ্ছিলেন। এ সময় এলটিটিইর বোমা বহনকারী একটি আত্মঘাতী ট্রাক বাসের বহরে আক্রমণ করে। দিগমপথানার এই ঘটনায় মারা যান ১০৩ জন সেনাসদস্য।

এলটিটিইর সদস্যরাও সামরিক বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ, নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন। স্বাধীন একটা দেশের স্বপ্ন খুব সাধারণ মানুষের হাতে তুলে দিয়েছিল অস্ত্র। বুকে বোমা বাঁধতে দ্বিধা করেনি তামিল কিশোর বা কিশোরী। আজকের ঘটনার পেছনে কে বা কারা আছে, তা এখনো পরিষ্কার নয়। হয়তো কোনো সন্ত্রাসী সংগঠন, যাদের চোখে আদর্শের ঠুলি পরানো হয়ে গেছে, করা হয়েছে মগজধোলাই। হতে পারে, এর পেছনে আছে রাজনৈতিক কোনো স্বার্থ হাসিলের অভিপ্রায়ও।

কারণটা যা-ই হোক না কেন, এর বলি হলো শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষই। খুব সাধারণ একজন গৃহবধূ, একজন বাবা কিংবা মা, একজন ভাই কিংবা বোন; রাজনীতি শব্দের মানে না বোঝা শিশু। রক্তাক্ত শ্রীলঙ্কা আবারও প্রার্থনায় মগ্ন হলো, এই অন্ধকার থেকে মুক্তি দাও প্রভু!