তেলের মজুতে ভাগ্য ফিরবে উগান্ডার জনগণের?

মজুত থাকা তেল ব্যবহারে প্রতিবেশী দেশগুলোর থেকে উগান্ডাকে শিক্ষা নিতে বলছেন বিশ্লেষকেরা। ছবি: রয়টার্স
মজুত থাকা তেল ব্যবহারে প্রতিবেশী দেশগুলোর থেকে উগান্ডাকে শিক্ষা নিতে বলছেন বিশ্লেষকেরা। ছবি: রয়টার্স

২০০৬ সালে উগান্ডা প্রথমবারের মতো জানতে পারে, নিজের মজুত থেকে তারা বাণিজ্যিকভাবে তেল উত্তোলন করতে পারবে। ২০ বছরের মধ্যে আফ্রিকার সাব-সাহারা অঞ্চলে সন্ধান পাওয়া সবচেয়ে বড় তেলের উৎস এটিই। খুব দ্রুত হলেও ২০২২ সালের আগে ওই তেল উত্তোলন করতে পারবে না দেশটি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের নানা হিসাব-নিকাশ বলছে, এই তেল কি উগান্ডার জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসবে, নাকি হবে আশীর্বাদরূপী অভিশাপ?

দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উগান্ডার পশ্চিমাঞ্চলের লেক আলবার্টসংলগ্ন এলাকায় প্রায় ৬০০ কোটি ব্যারেল তেল মজুত রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এর মধ্যে প্রায় ১৫০ কোটি ব্যারেল তেল উত্তোলনযোগ্য। কিন্তু এই তেল উত্তোলনের জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে উগান্ডাকে। গবেষকদের আশঙ্কা, এই ‘সম্পদরূপী অভিশাপ’ অর্থনীতিকে চাপে ফেলে, রাজনীতিকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে ও যুদ্ধকে উসকে দেয়। এমনকি গবেষকেরা এমনটাও বলছেন, তেল উত্তোলন শুরুর আগেই এই ‘অভিশাপ’ সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে।

উগান্ডায় তেলের সন্ধান পাওয়ার কাছাকাছি সময়ে ঘানা ও মোজাম্বিকে তেল-গ্যাসের বিশাল মজুতের সন্ধান মিলেছিল। কোথায় সেই তেল ও গ্যাস উত্তোলন করে দেশ দুটি নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি ঘটাবে তা না, বরং উভয় দেশই অর্থনৈতিক সংকটে নিমজ্জিত হয়েছে। গবেষকেরা তাই এখন থেকেই উগান্ডাকে শিক্ষা নেওয়ার কথা বলছেন।

মূলত, উগান্ডাকে ধৈর্য ধরতে বলছেন গবেষকেরা। দ্রুত তেল উত্তোলনের আশায় বিপুল অঙ্কের অর্থ ঋণ করেছিল ঘানা। পরিকল্পনা ছিল, একবার তেল উত্তোলন শুরু হলেই সব ঋণ শোধ করে দেবে তারা। কিন্তু তেল উত্তোলন শুরুর ছয় বছর পরেও বিশাল ঋণের বোঝা থেকে মুক্ত হতে পারেনি ঘানা। এমনকি ঋণ শোধের জন্য ২০১৫ সালে আইএমএফের শরণাপন্নও হতে হয়েছে দেশটিকে। একইভাবে দ্রুত গ্যাস উত্তোলনের জন্য বন্ড বিক্রি থেকে শুরু করে প্রচুর ঋণ করেছে মোজাম্বিকও, কিন্তু লাভের বদলে উল্টো তারা ঋণের বোঝা বহন করে চলেছে। দেশটির সাবেক অর্থমন্ত্রী এখন দক্ষিণ আফ্রিকায় কারাবাস করছেন।

উগান্ডা
অবস্থান: আফ্রিকা মহাদেশের পূর্বাঞ্চল
রাজধানী: কাম্পালা
জনসংখ্যা: ৩ কোটি ৫৬ লাখ
মুদ্রা: উগান্ডান শিলিং
আয়তন: ২ লাখ ৪১ হাজার ৩৮ বর্গকিলোমিটার
ভাষা: ইংরেজি, সোয়াহিলি
গড় আয়ু: পুরুষ (৫৪ বছর), নারী (৫৫ বছর)
সূত্র: বিবিসি

গবেষকেরা বলছেন, অবাস্তব উচ্চাকাঙ্ক্ষা থেকেই ঋণ গ্রহণের এই মহোৎসব শুরু হয়। ২০১৭ সালে জেমস কাস্ট ও ডেভিড মিলহালি নামের দুজন গবেষক একটি গবেষণা করেছিলেন। তাঁরা ১৯৮৮ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে বিশ্বজুড়ে আবিষ্কৃত হওয়া ২৩৬ টি তেলের খনির বিষয়ে এই গবেষণা করেছেন। তেলের সন্ধান পাওয়ার আগে আইএমএফ দেশগুলোর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সম্পর্কে যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল, তেলের খনি আবিষ্কৃত হওয়ার পর সেই পূর্বাভাস কতটা মিলেছে সেটি মিলিয়ে দেখাই ছিল তাঁদের উদ্দেশ্য। গবেষণার ফলাফল বলছে, তেলের খনি আবিষ্কৃত হওয়ার পর প্রতিবছর দেশগুলোর প্রবৃদ্ধি গড়ে  শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ করে কমেছে। আর যেসব দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো একটু দুর্বল, সেসব দেশে প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৪ শতাংশ পর্যন্তও কমতে দেখা গেছে।

তবে বাকি দেশগুলোর তুলনায় উগান্ডার একটি সুবিধাও দেখতে পাচ্ছেন কেউ কেউ। ১৯৮৬ সাল থেকে দেশটির প্রেসিডেন্ট ইয়োওয়েরি মুসেভেনি বেশ শক্তভাবেই ক্ষমতা নিজের কাছে কুক্ষিগত করে রেখেছেন। উগান্ডার বিশ্লেষক অ্যাঞ্জেলো ইজামা ও ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক স্যাম হিকি বলছেন, এই তেলের খনি নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করার সুযোগ পাবেন মুসেভেনি, যে সুযোগ ঘানার মতো তুলনামূলক গণতন্ত্রপন্থী দেশগুলো পায়নি। ক্ষমতার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই খনি থেকে তেল উত্তোলনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন সেসব দেশগুলোর রাষ্ট্রপ্রধানেরা। উগান্ডার তাই তেল নিয়ে বহির্বিশ্বের দেশগুলোর সঙ্গে লাভজনক ও দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করার সুযোগ বাকিদের তুলনায় বেশি।

কিন্তু প্রশ্ন এখন এটিই, উগান্ডা কি তত দিন এই তেল সম্পদের জন্য ধৈর্য ধরতে পারবে? উগান্ডার জনগণ যতটা ধারণা করেন, আদতে তার চেয়ে অনেক কম তেল মজুত রয়েছে দেশটিতে। দেশের সব মানুষের মধ্যে সমানভাবে এই তেল ভাগ করে দিলে প্রত্যেকের ভাগে বছরে মাত্র দুই ব্যারেল করে তেল পড়বে। তিন দশকের মধ্যে এই তেল শেষ হয়ে যাবে। যেখানে অ্যাঙ্গোলার মজুত হিসাবে প্রতি নাগরিক পাবেন ৩৯ ব্যারেলের কাছাকাছি। বিশ্লেষকেরা তাই শঙ্কিত, উগান্ডার এই তেলসম্পদ কি দেশটির অর্থনীতির জন্য আশীর্বাদ হিসেবে ধরা দেবে? নাকি ঘানা ও মোজাম্বিকের মতোই ঋণের ভারে জর্জরিত হবে তারা?