আগ্নেয়গিরির ভস্ম থেকে যে গ্রাম হলো

চা দাস ক্যালদেরিয়াস উপত্যকায় নতুন করে গড়ে তোলা হোটেল।
চা দাস ক্যালদেরিয়াস উপত্যকায় নতুন করে গড়ে তোলা হোটেল।

নিজ ঘরের মায়া কি সহজে কাটে? হোক না সে আগুনে পোড়া, শত জীর্ণ। সুযোগ পেলে সেখানেই আবার ফুটিয়ে তোলা যায় প্রাণচাঞ্চল্য। তেমনিভাবে পর্তুগালের একটি দ্বীপে ফুটেছে আগুনের মধ্যে প্রাণের চাঞ্চল্য। চার বছর আগে পর্তুগিজের কেপ ভার্দের পিকো ডো ফোগো আগ্নেয়গিরি ফুঁসে উঠেছিল। চা দাস ক্যালদেরিয়াস উপত্যকায় চালিয়েছিল ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ। পথে যা পেয়েছিল, তা-ই ভস্ম করে এগিয়ে চলেছিল ভয়ংকর লাভা। তবে ভস্ম করতে পারেনি চা দাস ক্যালদেরিয়াসের বাসিন্দাদের আশা-স্বপ্ন। আবার নতুন করে সেখানে ঘর বাঁধছে তারা।

ছাই-ভস্মের বুক চিরে গড়ে উঠছে নতুন গ্রাম। তৈরি হচ্ছে নতুন হোটেল, পর্যটক আকর্ষণের নানা বসতি।

সেখানকার হোটেলমালিক ত্রিশোর্ধ্ব মারিসা লোপেজ বললেন, ‘লাভা এখনো ঠান্ডা হয়নি। আমরা এর ওপরই দ্রুত হোটেল তৈরি করে ফেলেছি। প্রথম কয়েক মাসে এ হোটেলের ঘরগুলোর মেঝেতে খালি পায়ে হাঁটা যেত না।’

চা দাস ক্যালদেরিয়াসের ওপর মাথা উঁচু করে থাকা পিকো ডো ফোগো আগ্নেয়গিরির সঙ্গে লোপেজের মতো যুদ্ধ করে যাচ্ছেন আরও কয়েকজন উদ্যোক্তা। সেখানে অবশ্য মাত্র ৫০০ জনের মতো বাসিন্দা রয়েছে। পর্তুগিজ ভাষায় ওই চূড়ার নামের অর্থ ‘আগুনের চূড়া’ বা পিক অব ফায়ার।

পিকো ডো ফোগো আগ্নেয়গিরি
পিকো ডো ফোগো আগ্নেয়গিরি

তবে ওই আগ্নেয়গিরি ঘিরেই সেখানকার বাসিন্দাদের রুটিরুজি। প্রতিবছর এ আগ্নেয়গিরি দেখতে পাঁচ হাজারের বেশি পর্যটক সেখানে যান। তাঁদের প্রয়োজনীয় বিছানা, খাবার ও ট্যুর গাইড হিসেবে কাজ করে অনেকেই। তবে এখানকার বড় সমস্যার নাম ওই অগ্ন্যুৎপাত। এখানে প্রতি প্রজন্মে একবার করে অগ্ন্যুৎপাত হয়। গত ২০০ বছরের মধ্যে ছয়বার উদ্‌গিরণ হয়েছে সক্রিয় এ আগ্নেয়গিরি থেকে।

অগ্ন্যুৎপাতে সৃষ্ট লাভা তার পথে যে শস্য, বাড়ি, রাস্তা পায়, সবই ভস্ম করে চলে। সর্বশেষ ২০১৪ সারের ২৩ নভেম্বর ১৯ বছরের ব্যবধানে এখানে উদ্‌গিরণের ঘটনা ঘটে। সাড়ে নয় হাজার ফুট উঁচু থেকে বয়ে চলা আগুনের ওই নদীর যাত্রাপথ মাড়িয়ে চলার দৃশ্য অসহায়ভাবে চেয়ে দেখা ছাড়া লোপেজের মতো মানুষের কিছুই করার ছিল না।

লাভার আগুনে ভস্ম হয় লোপেজের চকচকে পর্যটন হোটেল ‘কাসা মারিসা’। তিন মাস পরই আবার তিনি সেখানে গড়ে তোলেন আরেকটি নতুন হোটেল।

লোপেজ বলেন, ‘আমার একটি বাড়ি কেড়ে নিয়েছে ওই আগ্নেয়গিরি। কিন্তু দিয়েছে অন্য কিছু। ওই আগ্নেয়গিরি না থাকলে এখানে পর্যটকেরা আসতেন না।’

এখানকার বাসিন্দাদের ওই আগ্নেয়গিরির ভয়াবহতা, বিপদ সম্পর্কে অবহিত করে সরকার সেখান থেকে তাদের সরানোর নানা চেষ্টা করছে। কিন্তু তাতে কী? আবার সেই ছাই-ভস্মে ফিরে আসছে তার।

গড়ে তুলছে নতুন গ্রাম। সর্বশেষ অগ্ন্যুৎপাতের সময় দেশটির সেনাবাহিনীর সদস্যরা সেখান থেকে লোকজন সরিয়ে নেয়। তাদের ছয় মাস পর্যন্ত খাবার সরবরাহ করেছিল সরকার। কিন্তু এখানকার মানুষ সরকারি ওই সাহায্যের আশায় বসে থাকেনি। তারা নিজের উদ্যোগেই আবার রাস্তা নির্মাণসহ বাড়ি ও হোটেল তৈরি করে নিয়েছে।

২০১৪ সালে এখানেই ছিলেন ৪২ বছর বয়সী সিসিলিও মনট্রোড। গলিত পাথরের ওই লাভাস্রোত তাঁর ফলের গাছসহ যা কিছু ছিল, সব ভস্ম করে দিয়েছে। ওই লাভাস্রোতে কেউ মারা যায়নি সত্যি, তবে গৃহহারা করেছে দেড় হাজার মানুষকে।

পর্তুগিজের কেপ ভার্দ উপত্যকা।
পর্তুগিজের কেপ ভার্দ উপত্যকা।

সাও ফিলিপে নামের নিকটবর্তী যে শহরে তাঁদের রাখা হয়েছিল, সেখান থেকে আবার চা দাস ক্যালদেরিয়াস উপত্যকায় স্ত্রীসহ ফিরেছেন সিসিলিও। এখনো সেখানকার বাতাস পরিষ্কার হয়নি। ছাই রয়েছে বাতাসে। পাখি ওড়ে না সেখানে। উষ্ণ লাভার স্তরে ঢাকা ওই লাভাসমুদ্রে কোনো প্রাণীর টিকে থাকা সম্ভব নয়। কয়েক সপ্তাহ ধরে সিসিলিও তাঁর বাড়ির ছাদে একটি তাঁবু টাঙিয়ে বাস করেছেন। কিন্তু সেখানে না আছে পানি, না আছে বিদ্যুৎ। ক্যানভর্তি কেনা খাবার ছাড়া অন্য কোনো খাবারের জোগানও নেই।

সিসিলিও বলেন, ‘কোনো রকম একটা থাকার জায়গা করেছি, যা অনেকটাই বিপজ্জনক। তবু তো সেটা নিজের বাড়ি। এটা সেই আগ্নেয়গিরি, যা আমাদের বাঁচতে শিখিয়েছে।’ সিসিলিও এখন ট্যুর গাইড আর হোটেল ব্যবস্থাপনা কাজে যুক্ত হয়েছেন।

আশার কথা হচ্ছে, পিকোর যে উদ্‌গিরণ হয়, তাতে মানুষের জীবননাশের মতো মারাত্মক নয়।

কিন্তু আবার যদি ভয়াবহ উদ্‌গিরণ শুরু হয়? সিসিলিও বলেন, ‘আগ্নেয়গিরি আমার জীবন। এখানে জন্মেছি। এখানেই মরতে চাই। যা দিয়েছে, এ আগ্নেয়গিরিই দিয়েছে। নেওয়ার থাকলে সে-ই নেবে।’

শুরুতে উপত্যকা ধ্বংস করেছে। পরে আবার নতুন করে সেখানে উর্বর জমি সৃষ্টি করেছে। সেখানে আঙুরের চাষ করে বাজারে নেওয়া যাবে। মাথার ওপর ভয়ের খড়্গ ঝুলতে থাকলেও এর সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে গেছে এখানকার মানুষ। এটাই তাদের পরিচয় গড়ে দিয়েছে।

মার্গারিটা লোপেজ দস সান্তোসকে (৯৯) পিকো ডো ফোগোর কারণে তিনবার ঘর ছাড়তে হয়েছে। ১৯৫১ সালের জুনে প্রথমবার ঘর ছাড়ার পর প্রথম সন্তানের জন্ম দেন তিনি। লোপেজ বলেন, প্রথমবার সেই ঘর ছাড়ার ঘটনাটি যেন গতকালের ঘটনার মতো। তখন আগ্নেয়গিরি ছিল আরও মারাত্মক। আকাশ থেকে পাথর পড়ছিল। ধোঁয়া আর ছাইয়ের ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়েছিল।

বাড়ির বাইরে এখন ফুলের গাছ লাগিয়েছেন লোপেজ। ধূসর কালো পটভূমিতে লাল রঙের ফুল ফুটে ওঠার অপেক্ষায় তিনি।

কেপ ভার্দের ফোগো দ্বীপের সাও ফিলিপের মিউনিসিপ্যাল কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট জর্জ নগুরিয়া বলেন, এখানকার মানুষের সহ্যশক্তি অসীম। বসবাসের পরিস্থিতি যতই প্রতিকূল হোক, তারা যতটা সম্ভব দ্রুত ফিরে এসেছে। তাদের কাছে সবচেয়ে বড় বিষয় যে নিজের ঘরে ফিরেছে তারা। তাদের কাছে ‘নিজ হাতে গড়া মোর  কাঁচা ঘরই খাসা’।