বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের টক-মিষ্টি জীবন

বিয়ের অনুষ্ঠান চলছে কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরে। ছবি: রয়টার্স
বিয়ের অনুষ্ঠান চলছে কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরে। ছবি: রয়টার্স

সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের ওপর নানা বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে মিয়ানমার। ভ্রমণ করা, দলবদ্ধ হয়ে আড্ডা দেওয়া, গান গাওয়া বা নিজেদের জাতিগত পরিচয় প্রকাশিত হয়—এমন কোনো কাজ করার অনুমতি নেই তাদের। প্রাণ বাঁচাতে নিজ দেশ ছেড়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসে উদ্বাস্তুতে পরিণত হওয়া রোহিঙ্গারা এখন কেমন আছে? রয়টার্সের আজকের এক প্রতিবেদনে তা উঠে এসেছে।

বাঁশের বেড়ায় ঘেরা বাংলাদেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরের সামনে বসে আছেন গুদার মিয়া। গানের সঙ্গে সঙ্গে সিগারেটও তাঁর নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন তো যাকে বলে একেবারে ‘চেইন স্মোকার’ তিনি। শিবিরে এসে আশিতে পা রাখা এই গায়ক চোখ বন্ধ করে গুন গুন করে রোহিঙ্গা লোকসংগীতের সুর ভাঁজতে লাগলেন। পাশেই বসে আছেন আমির আলী। সত্তরের মধ্যাহ্নে থাকা বেহালাবাদক আমির গুদার মিয়ার প্রাণের বন্ধু। তরুণ বয়সে মিয়ানমারে থাকাকালে তাঁরা একসঙ্গে বিয়ের গানের দলে কাজ করতেন।

আমির বলেন, ‘প্রতিদিন কোথাও না কোথাও কাজ থাকত আমাদের। মাঝেমধ্যে তো টানা ২০ দিনেও বাড়ি ফিরতে পারিনি।’

একসময় রাখাইন রাজ্য দাপিয়ে বেড়ানো সেই দুই যুবক জীবনসায়াহ্নে এসে ঠাঁই নিয়েছেন রোহিঙ্গা শিবিরে। এখন তাঁদের গানের শ্রোতা শিবিরের জনকতক রোহিঙ্গা বাসিন্দা। তবু কয়েক দশক পরে এমন মুক্ত কণ্ঠে গান গাওয়ার সুযোগ পেয়ে আনন্দিত তাঁরা দুজন। আমির বলেন, ‘মিয়ানমারে থাকতে ১০ জন লোকের সামনেও গান গাইতে পারতাম না। এমন গান গেয়ে কি আনন্দ হয়?’

২০১৭ সালের আগস্ট মাসে শেষবারের মতো কোনো বিয়ের অনুষ্ঠানে গেয়েছিলেন তাঁরা। রাখাইন রাজ্যের শান্ত এক গ্রামে সেদিনই হাজির হয় সৈনিকেরা। পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে ছারখার করে দেয়। জাতিসংঘের ভাষায় গণহত্যার উদ্দেশে সংঘটিত এই সামরিক হামলার কারণে প্রায় ৭ লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়।

প্রায় ১০ লাখ মানুষকে আশ্রয় দেওয়া বাংলাদেশি শরণার্থীশিবিরটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী নিষ্পত্তি কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সেখানে নতুন করে রোহিঙ্গাসমাজ গড়ে উঠছে। শিবিরের জীবন বিবর্ণ এবং একঘেয়ে হলেও এখানে অন্তত স্বাধীনতা তো পাচ্ছেন, আর তাতেই খুশি রোহিঙ্গারা।

কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরে নতুন করে জীবন ফিরে পেয়েছেন রোহিঙ্গারা, প্রাণের সঞ্চার হয়েছে সেখানে। বিয়ের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে, নতুন শিশুরা জন্ম নিচ্ছে। এমনই এক বিয়ের অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার দায়িত্ব পেয়েছেন গুদার মিয়ারা। বারবার তাঁদের কাছে অনুরোধ আসছিল, ‘পুরোনো গান গাও, আমাদের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনো।’

হাওলা নামে পরিচিত এই পুরোনো গানগুলো একটু ধীরগতির, শুধু বিয়েতেই গাওয়া হয়। রাখাইন রাজ্যকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের প্রেমকাহিনি নিয়ে তৈরি করা হয় হাওলা। নতুন গানগুলোর মতো সেখানে নেই কোনো কষ্টের কথা। বরং আগেকার সুখময় জীবনই সেখানে প্রাধান্য পায়। বিয়েতে ঘুড়ি ওড়ানো, ধান চাষের ছন্দের মতো বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী রীতি পালন করা হয়।

১৯৭৮ সালের পর জেনারেল নে উইন রোহিঙ্গা গ্রামগুলোয় নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। সে সময়ের কথা স্মরণ করে আমির আলী বলেন, ‘তখন কেবল বড়লোকেরাই বিয়ের অনুষ্ঠান করার অনুমতি পেত। আগের মতো আর আয় করতে পারতাম না, ভীষণ মন খারাপ হতো আমাদের।’

মিয়ানমারে জাতিসত্তা নাগরিকত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত। রোহিঙ্গাদের জাতিগত গোষ্ঠী বিবেচনা করে এ ধরনের বিধিনিষেধ চাপিয়ে দেওয়া হতো। সেসব দিন পেছনে ফেলে এলেও স্মৃতিগুলো এখনো মুছে যায়নি। যেকোনো অনুষ্ঠানে গানের পর আসত ঐতিহ্যবাহী হরেক রকমের খাবারের পালা। ‘মধু বাতর’ নামে পরিচিত একধরনের মিষ্টান্ন তৈরি করা হতো ভাতের সঙ্গে মধু মিশিয়ে। বছরের উষ্ণতম দিনগুলোয় শরীর ঠান্ডা রাখতে মধু বাতরের জুড়ি মেলা ভার। এরপর থাকত লুরি ফেরা, গরু বা খাসির মাংসের তরকারি দিয়ে খাওয়া হতো চালের গুঁড়োর সঙ্গে আটা মিশিয়ে তৈরি পাতলা রুটি।

রয়টার্সকে ফোনে সাক্ষাৎকার দেন মিয়ানমারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তা মিন থেইন। রোহিঙ্গাদের তিনি ‘কালার’ বলে সম্বোধন করেন। মূলত দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের বিদেশিদের ক্ষেত্রেই এই শব্দ ব্যবহার করা হয়। তিনি বলেন, তাদের সংস্কৃতির ওপর মোটেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়নি। রাখাইন রাজ্যজুড়ে অসংখ্য মসজিদ বানিয়েছে তারা। শুধু কালাররাই নয়, রাখাইন, ডায়গনেটের মতো বৌদ্ধ সংখ্যালঘুরাও পরিবহনসংকটের কারণে নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। তিনি জানান, ইতিহাস বইয়ে রোহিঙ্গাদের সাম্প্রদায়িক কোনো পরিচয়ের কথা উল্লেখ নেই। রোহিঙ্গারা দেশে ফিরে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করে যাচাইপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারে।

কিন্তু রোহিঙ্গারা অনেক দিন ধরে যে জীবনযাপন করছে, তাকে নির্বাসন বললেও অত্যুক্তি হবে না। গত বছর রোহিঙ্গাদের রাখাইন রাজ্যে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা ব্যর্থ হয়। জাতিসংঘ জানায় রাখাইন রাজ্য এখনো তাদের প্রত্যাবাসনের জন্য নিরাপদ নয়। কাজেই শিবিরগুলোয় সাংস্কৃতিক কার্যক্রম থেকে শুরু করে আনুষ্ঠানিক পড়ালেখা শেখানোর ব্যবস্থা করছেন তরুণ নেতারা।

রাখাইন রাজ্যে থাকাকালে সাহিত্য ম্যাগাজিনে ছদ্মনামে কবিতা লিখতেন এনজিওকর্মী মাইয়ু আলী। বাংলাদেশে এসে শিক্ষার্থীদের কবিতাপাঠের তালিম দিচ্ছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘আমি চাই না বাচ্চারা ছুরি-বন্দুক হাতে নিয়ে বড় হোক। তাদের হাতে বরং কলমই শোভা পায়। লাখো রোহিঙ্গার বাস এই শিবিরে। সবার জীবনেই কোনো না কোনো ট্রমা বা গভীর ক্ষত আছে। আমি চাই নতুন প্রজন্ম নিজেদের সেই গল্পগুলো লিখে রাখুক।’

কিন্তু বিয়ের অনুষ্ঠানের বেলায় তাদের একমাত্র ভরসা সেই হারিয়ে যাওয়া পুরোনো দিনের গানগুলোই। আমির আলী ও গুদার মিয়া জানান, তাঁদের গ্রামটা খুব সুন্দর ছিল। নিজের দেশে থাকার সময় বেহালা বাজিয়ে, গান গেয়ে দুঃখ ভুলে থাকতেন। শিবিরে এসেও দুশ্চিন্তা ভুলে থাকতে গানকেই অবলম্বন করেছেন।

হাওলাতে যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনা দেওয়া হয়, রাখাইন রাজ্যের সেই সৌন্দর্য এখন আর নেই। তবে আমির আলীর বেহালা থেকে এখনো যেন সেসব দিনের আমেজ পান প্রতিবেশীরা।