মাগনা খেয়েও নেই রে সুখ

যুক্তরাজ্যর ফুড ব্যাংক
যুক্তরাজ্যর ফুড ব্যাংক

যুক্তরাজ্যে ফুড ব্যাংক ব্যবহারের হার অতীতের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে। সামাজিক কল্যাণ সুবিধাগুলো মানুষের জীবন ধারণের খরচ মেটাতে না পারায় অনেকেই ফুড ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠছে বলে সতর্ক করেছে দেশটির জাতীয় ফুড ব্যাংকের রসদ সরবরাহকারীরা।

ট্রাসেল ট্রাস্টের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের মার্চ থেকে এ বছরের মার্চ পর্যন্ত যুক্তরাজ্যজুড়ে ১৩ লাখ ৩২ হাজার ৯৫২ জনকে তিন দিনের জরুরি খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয়েছে, যা তার আগের বছরের তুলনায় ১৩ শতাংশ বেশি।

ফুড ব্যাংকের ওপর নির্ভরতার মূল কারণ হিসেবে মানুষের আয় কমে যাওয়ার বিষয়টিকেই দেখা হচ্ছে বলে ইনডিপেনডেন্ট অনলাইনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়। আয় কমার এ ধারা ২০১৬ সালের এপ্রিল মাস থেকেই ঊর্ধ্বমুখী।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বাড়িভাড়া ও আনুষঙ্গিক বিভিন্ন পরিষেবা বিল বেড়ে যাওয়ার কারণে অনেকই ফুড ব্যাংকের রেফারেল সিস্টেম আসছেন। এ ছাড়া সামাজিক কল্যাণ সুবিধা পেতে দেরি হওয়ার ও নীতিতে পরিবর্তন আনার কারণেও ফুড ব্যাংকে যেতে হচ্ছে দরিদ্র মানুষকে।

ফুড ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়া মানুষের একজন মারভিন। তিনি কখনো ভাবতে পারেননি তাঁকে খাদ্য সাহায্য নিতে হবে। বিনা মূল্যের খাবার নিতে তাঁর অস্বস্তি লাগছিল। হাসপাতালের নিরাপত্তারক্ষীর কাজ করা মারভিন (৪৭) বলেন, তাঁর মতো কেউই ফুড ব্যাংকে যেতে চান না। কিন্তু কোমরে আঘাত পেয়ে তিনি আর কাজে যেতে পারেননি। সরকারের নতুন সামাজিক কল্যাণ সুবিধা ইউনিভার্সাল ক্রেডিটের আওতায় বিভিন্ন দেনা শোধ করতে হিমশিম খেতে হয়। আট মাস বয়সী সন্তানের জন্য তাঁকে ছয় মাসের মধ্যে তিনবার ফুড ব্যাংকে যেতে হয়েছে।

মারভিন বলেন, ‘একসময়ে অসহায় ও হতাশায় ভুগতে শুরু করি। কিন্তু মেয়ের দিতে তাকিয়ে আমি হাল ছাড়িনি। ফুড ব্যাংকের স্বেচ্ছাসেবকেরা দারুণ। তারা না থাকলে কী হতো, আমি ভাবতে পারি না।’

ফুড ব্যাংকটি মূলত সেন্ট পল চার্চভিত্তিক। সালসবারি শহরের অ্যাভন নদীর পাশে এর অবস্থান। যে কমিউনিটি সেন্টারে এটির অবস্থান, তা অনেকটাই সাধারণ চার্চ হলের মতো। সেখানে কয়েকজন বসে গল্প করতে পারে। এর ভেতরে বিভিন্ন তাকে নানা খাবার সাজানো। যার মধ্যে টমেটো স্যুপ, মাংস, দুধসহ বেশি দিন সংরক্ষণ করা যায়—এমন খাবার ভরা। স্বেচ্ছাসেবীরা এগুলো প্যাকেট করে সাহায্যপ্রার্থীদের হাতে তুলে দেন।

এখানে যাঁরা আসেন, তাঁদের বেশির ভাগই ভয়ে থাকেন বলে মনে হয়। তবে মূল পরিবেশ বন্ধুত্বপূর্ণ। সেখানে সাহায্যপ্রার্থীদের ফুড ব্যাংকের ভাউচার দিতে হয়। এসব ভাউচার মূলত বিভিন্ন এজেন্সি, যেমন: সিটিজেন অ্যাডভাইস, সমাজকর্মী ও পেশাদার চিকিৎসকেরা দেন। এতে যাঁরা প্রকৃত সাহায্যপ্রার্থী, তাঁরাই সুবিধা পান।

ফুড ব্যাংকে গেলে চা-টোস্ট খেতে দেওয়া হয়। কারণ, অনেক সময় খাদ্য সাহায্য পেতে কিছুটা দেরি হতে পারে। এ সময় স্বেচ্ছাসেবীদের সঙ্গে আলাপ করেন অনেকেই।

ফুড ব্যাংকে পাঁচ বছর ধরে কাজ করা পিটার (৭০) বলেন, ‘আমরা চাই এখানে যাঁরা আসেন, তাঁরা যেন ভালো বোধ করেন—এটাই চাওয়া। যতটা সম্ভব তাঁদের স্বাগত জানানোর চেষ্টা করি।’

ফুড ব্যাংক থেকে খাবারের যে মোড়ক দেওয়া হয়, তাতে একটি পরিবারের জন্য তিন দিনের মতো খাবার থাকে। অবশ্য চাইলে বাড়তি হিসেবে তোয়ালে, ফল, সবজি, ন্যাপি বা পশুখাদ্য নেওয়া যেতে পারে।

খাদ্য সহায়তা দেওয়ার পাশাপাশি নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য আর কী কী সাহায্য লাগবে, তা মারভিনের কাছ থেকে জানার চেষ্টা করেন এক স্বেচ্ছাসেবী। কাউকে যেন ছয় মাসের মধ্যে তিনবারের বেশি ফুড ব্যাংকে আসা না লাগে, এ জন্য নানা রকম পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা দিয়েও সহায়তা করেন স্বেচ্ছাসেবীরা।

অবশ্য ফুড ব্যাংকের ব্যবহার নিয়ে সমালোচনাও রয়েছে। অনেকেই মনে করেন, এভাবে খাদ্য সাহায্য করলে এর ওপর নির্ভরশীলতা বাড়তে থাকবে। কেউ কেউ বলেন, দারিদ্র্যের মূল সমস্যা সমাধান না করে এ ধরনের উদ্যোগে কোনো কাজ হবে না।

সালসবারি ফুড ব্যাংকের ব্যবস্থাপক লুসি ডাফি বলেন, বিপদে পড়া লোকজনকে সাহায্য করতে তাঁরা এগিয়ে এসেছেন। এটা দীর্ঘমেয়াদি কোনো সমাধান নয়।

সালসবারি থেকে ৮০ মাইল দূরে নিউপোর্টে আরেকটি স্বাধীন ফুড ব্যাংকেও একই পরিস্থিতি। তাদেরও নতুন বেকারদের চাপ সামলাতে হচ্ছে।

ওই ফুড ব্যাংকের ব্যবস্থাপক মাইক স্কট জানান, নিউপোর্টেও বেকারের সংখ্যা প্রচুর। দীর্ঘদিন ধরে এ সমস্যা চলছে। এখানকার স্টিল কারখানা, কয়লাখনি বন্ধ হয়ে গেছে। জাতীয় গড় আয়ের তুলনায় এখানকার মজুরি কম। এ ছাড়া স্বাস্থ্যগত কারণে অনেকে কাজ করতে পারেন না। সরকারি সুবিধাপ্রাপ্ত অনেকেই তাই ফুড ব্যাংকে আসছেন।

শার্লট (৩৩) ওই ফুড ব্যাংকে সাহায্য নেন। তিনি বলেন, মানসিক সমস্যা রয়েছে তাঁর। সরকারি সাহায্যে তাঁর চলে না। অন্যান্য খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হয়। তাঁর চশমা দরকার। সরকারি সাহায্যের আশায় আছেন। ফুড ব্যাংক তাঁর কাছে খাবারের আশ্রয়। তিনি জানেন, অন্তত না খেয়ে থাকতে হবে না তাঁকে।

ওই ফুড ব্যাংক থেকে সপ্তাহে ১৫০ জনকে খাবার দেওয়া দেওয়া হয়। তবে এ চাহিদা আরও বেড়ে গেছে। দুই বছর আগের চেয়ে দ্বিগুণ সাহায্য দিতে হচ্ছে তাদের। এ ফুড ব্যাংক থেকে সাহায্যপ্রার্থীদের কাজ পেতে প্রশিক্ষণসহ নানাভাবে সাহায্য করা হয়।

নিউপোর্টের ওই ফুড ব্যাংকের চেয়ে স্টকপোর্টে খাদ্য চাহিদা মেটানোর পদ্ধতি একটু আলাদা। স্টকপোর্ট হোমস নামে সেখানে চারটি কমিউনিটি খাবার দোকান চালানো হয়। এগুলো প্যানট্রি নামে পরিচিত। এর লক্ষ্য হচ্ছে স্থানীয় লোকজনকে খুব কমদামে দরকারি পণ্য সরবরাহ করা যাতে মানুষ অর্থ বাঁচাতে পারে।

স্টকপোর্ট হোমসের কর্মী অ্যানা জোনস বলেন, ২০১৩ সালে সরকারি সাহায্যের নীতিমালা পরিবর্তনের পর থেকে এখানকার বাসিন্দাদের অবস্থা বদলে গেছে। কিন্তু অনেকেই লজ্জাবশত ফুড ব্যাংকে যেতে চান না। এখানে প্যানট্রিগুলো জনপ্রিয়। স্টকপোর্টের সুবিধাবঞ্চিত এলাকায় ২০১৬ সালে তাঁরা একটি প্যানট্রি খুলেছেন। এখানে কম খরচে কেনাকাটা করার সুবিধা আছে।

এখানকার অধিকাংশ পণ্য সরবরাহ করে ফেয়ারশেয়ার নামের একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান। ওই দোকান খোলার আগেই সেখানে মানুষের লাইন দেখা যায়। অনেকে বলেছেন, পরিবারের বাজেট অনুযায়ী এখান থেকে পণ্য কিনতে পারেন তাঁরা।

ফুড ব্যাংক ও প্যানট্রির ব্যবহার বাড়ার নানা কারণ রয়েছে বলে জানিয়েছে যুক্তরাজ্যের ওয়ার্ক অ্যান্ড পেনশন বিভাগ (ডিডব্লিউপি)। তবে সরকারি ইউনিভার্সাল ক্রেডিটের কারণে এর ব্যবহার বাড়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছে ওই বিভাগটি। তাদের দাবি, ইউনিভার্সাল ক্রেডিট থেকে ১৭ লাখ মানুষ সুবিধা পাচ্ছে। যেখানে প্রয়োজন, সেখানে সুবিধা উন্নত করার কাজ করছে সরকারের এ বিভাগ।