আসাম-ত্রিপুরার কৌশলে পশ্চিমবঙ্গ দখলের লড়াই বিজেপির

নরেন্দ্র মোদি
নরেন্দ্র মোদি

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি এবারের লোকসভা নির্বাচনে কোন রাজ্যে সবচেয়ে বেশিবার নির্বাচনী প্রচারে গেছেন। উত্তরটা খুবই সোজা। উত্তর প্রদেশ। কারণ, সেখানে লোকসভার আসনসংখ্যা ৮০। সবাই জানেন, ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির সাফল্য এবং প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পেছনে এই রাজ্যের অবদান সবচেয়ে বেশি।

সবই ঠিক আছে। কিন্তু সোজা উত্তরটা একেবারে ভুল। প্রধানমন্ত্রী মোদি এবার এমন এক রাজ্যে সবচেয়ে বেশিবার নির্বাচনী সফরে গেছেন, যার আসন উত্তর প্রদেশের আসনসংখ্যার অর্ধেক। রাজ্যটির নাম পশ্চিমবঙ্গ। এখানে আসন ৪২টা হলেও বিজেপি সম্ভাবনা দেখছে বিপুল। কারণ, পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসানের পর ৮ বছর ধরে ক্ষমতায় আছে তৃণমূল কংগ্রেস। এই সময়কালে রাজ্য রাজনীতিতে ক্রমে অপাঙ্‌ক্তেয় হয়ে পড়েছে বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস। তৃণমূলের প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে উঠে এসেছে বিজেপি।

আর এই সুযোগটাই নিতে চাচ্ছেন নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহরা। গত ১০ মার্চ ভারতের লোকসভা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর মোদি ইতিমধ্যে কোচবিহার, কলকাতা, আসানসোল, শ্রীরামপুর, হলদিয়া, ঝাড়গ্রাম, তমলুকে একাধিক জনসভা করেছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার জনসভা করছেন পুরুলিয়া ও বাঁকুড়ায়। আরও সভা করবেন বসিরহাট ও ডায়মন্ড হারবারে। সব মিলিয়ে এবার প্রধানমন্ত্রী মোদি এই রাজ্যে ১৯টি জনসভা করবেন, যা কোনো প্রধানমন্ত্রী কখনো করেননি। মোদি দেশের অন্য কোনো রাজ্যে এত সভা করেননি। ফলে বোঝাই যায়, নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহরা কতটা মরিয়া পশ্চিমবঙ্গ দখলে।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

তাঁরা এই কাজে মেনে চলছেন ত্রিপুরা ও আসাম জয়ের সেই পুরোনো ছক। এক্কেবারে অঙ্ক কষে তিন বছর আগে থেকেই শুরু হয়েছে বিজেপির রাজ্য জয়ের অভিযান। তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পরাস্ত করতে তাঁর ইমেজকে কালিমালিপ্ত করার পাশাপাশি মমতাবিরোধী ভোটকে এক জায়গায় নিয়ে আসতে চাইছে বিজেপি। সেই সঙ্গে দল ভাঙার মাধ্যমে তছনছ করে দিতে চাইছে মমতার যাবতীয় সংগঠন।

প্রয়োজনে আঙুল বেঁকিয়ে হলেও ‘ঘি’ তুলতে কসুর করছেন না রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আরএসএস)-এর বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিজেপির নেতারা। রাষ্ট্রশক্তির ‘অপব্যবহার’, অঢেল অর্থশক্তি এবং পেশাদারি মিডিয়া ম্যানেজমেন্ট তো আছেই। বিজেপির এই ফর্মুলা নতুন কিছু নয়। আসাম ও ত্রিপুরাতে তারা এই ফর্মুলাতেই সফল। ২০১৬ সালে ছিল আসামের নির্বাচন। তরুণ গগৈয়ের নেতৃত্বে টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস। জাতপাতে বিভক্ত আসামে কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি বিজেপি ক্ষমতায় আসবে। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী আসামের জনসংখ্যার ৩৪ দশমিক ২২ শতাংশই মুসলমান। মুসলমান ছাড়াও রয়েছে চা শ্রমিক ও হিন্দু বাঙালিরাও। কংগ্রেসের ভোটব্যাংক বলা হতো ‘আলী (মুসলিম), কুলি (চা শ্রমিক), বাঙালি (হিন্দু বাঙালি)’। কারণ, উগ্র অসমিয়া আধিপত্যবাদীদের হাত থেকে বাঁচতে এই আলী, কুলি ও বাঙালিদের ভরসাই ছিল কংগ্রেস। তাই হিন্দুত্ববাদীরা আসাম দখল করবে কেউ ভাবতে পারেনি।

ভারতের মানচিত্রে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান (লাল চিহ্নিত)
ভারতের মানচিত্রে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান (লাল চিহ্নিত)

২০১৪ সালে কংগ্রেসের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব আর মুসলিম ভোটের সফল বিভাজনের মাধ্যমে লোকসভা ভোটেই কংগ্রেসকে টেক্কা দিল বিজেপি। সঙ্গে ছিল বোড়ো জনজাতিদেরও ভোট ভাগাভাগি। তার আগেই অসম গণ পরিষদের (অগপ) ডাক সাইটে নেতা সর্বানন্দ সোনোয়ালকে নিজেদের দলে নিয়ে আসে বিজেপি। শুরু হয় মিশন ২০১৬। ১৪-য় ক্ষমতায় এসেই অসমে কংগ্রেসের ‘মুকুল রায়’ হীমন্ত বিশ্বশর্মাকে দলে আনার ছক কষেন বিজেপির নেতারা। অনেকেই মনে করেন, এই কাজে ঠিক পশ্চিমবঙ্গের মতো আসামেও ব্যবহার করা হয় ভারতীয় তদন্ত সংস্থা সিবিআইকে। চিটফান্ড কেলেঙ্কারিতে সিবিআই চাপে ফেলে হীমন্তকে। কংগ্রেসের সবচেয়ে ডাকাবুকো নেতা হীমন্ত বিজেপিতে আসতেই অসমে জোয়ার আসে হিন্দুত্ববাদীদের। এরপর আঞ্চলিক দল অগপ ও অন্যদের সঙ্গে আঁতাত, অঢেল অর্থের ব্যবহার, মিডিয়াকে সঠিকভাবে নিজেদের অনুকূলে ব্যবহার এবং দিল্লি থেকে নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহদের ঘন ঘন আসাম সফরে ভেঙে পড়ে কংগ্রেস দুর্গ।

আসাম পেতেই বিজেপি ঘোষণা করেছিল উত্তর–পূর্বাঞ্চলকে কংগ্রেসমুক্ত করার। ২০১৪তে বিজেপি ক্ষমতায় আসার সময় উত্তর–পূর্ব ভারতের ৮ রাজ্যের মধ্যে ৫ রাজ্যেই ছিল কংগ্রেসের সরকার। প্রথমে অরুণাচল প্রদেশ দলবদলের মাধ্যমে দখল করে বিজেপি। আসামের ফর্মুলায় মণিপুরও তাদের দখলে আসে। মণিপুরে ক্ষমতায় আসার ৬ মাস আগেও যিনি কংগ্রেস সরকারের মন্ত্রী ছিলেন, তিনিই এখন বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং। মেঘালয় ও মিজোরামে আঞ্চলিক দলকে মদদ দিয়ে কংগ্রেসকে ক্ষমতাচ্যুত করে।

ভারতের মানচিত্রে আসামের অবস্থান (লাল চিহ্নিত)
ভারতের মানচিত্রে আসামের অবস্থান (লাল চিহ্নিত)

ত্রিপুরাতে ২০১৪-য় প্রবল মোদি হাওয়াতেও ২ শতাংশের কম ছিল বিজেপির ভোট। কংগ্রেসের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, সিপিএমের সঙ্গে মিত্রতায় তাঁরা নাকি ত্রিপুরার ক্ষমতা দখলে রাজি নয়। মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারের স্বচ্ছ ভাবমূর্তিকে টার্গেট করে কংগ্রেসের ঘর ভাঙানোর খেলা শুরু হয় তিন বছর আগে। তবে এখানে প্রথমে নয়, তৃণমূল স্তর থেকে শুরু হয় দলবদল। পরে অবশ্য কংগ্রেসের প্রায় সব হেভিওয়েট নেতাকেই নিয়ে আসা হয় বিজেপিতে। সেই সঙ্গে ঘন ঘন মোদিসহ কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা আসতে শুরু করেন সিপিএম শাসিত এই রাজ্যে। মিডিয়াকে ব্যবহার করা হয় নিজেদের অনুকূলে। ত্রিপুরার উপজাতি জনগোষ্ঠীর নেতাদেরও সঙ্গে নিতে অসুবিধা হয়নি বিজেপির। প্রশাসনকেও রাষ্ট্রশক্তির মাধ্যমে কাবু করা হয়। কংগ্রেসকে কার্যত অপ্রাসঙ্গিক করে দিয়ে ত্রিপুরা দখল করে বিজেপি।

বিজেপির স্লোগানই ছিল কংগ্রেসমুক্ত উত্তর–পূর্বাঞ্চল। কার্যত শুধু উত্তর–পূর্বাঞ্চলই নয়, পূর্ব ভারতেও কংগ্রেসের পতাকা রয়েছে শুধু পশ্চিমবঙ্গে। তা–ও সেটা তৃণমূলের কাঁধে। বিহার, ওডিশা, ঝাড়খন্ডে বহুকাল ধরেই নেই কংগ্রেস।

সম্প্রতি প্রথম আলোর এক প্রশ্নের জবাবে বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ বলেছিলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গে লোকসভা ভোটে বিজেপি ৪২-এর মধ্যে ২৩টা আসন পাবেই। আর ২০২১ সালে আমরাই সরকার গড়ব।’ মমতার ডান হাত বলে পরিচিত মুকুল রায়কে দলে টেনে, মোদি-অমিত শাহের ঘন ঘন পশ্চিমবঙ্গ সফর, তৃণমূলের ভাঙন, সিবিআইয়ের তৎপরতা, মিডিয়ায় বিজেপির জয়গান, জাতপাতের অর্থবহ রসায়ন—সব মিলিয়ে সেই চেনা ছক। তবে পশ্চিমবঙ্গের সংবাদমাধ্যম এখনো সেভাবে বিজেপির পক্ষ নেয়নি, বরং কিছুটা উল্টো।

ভারতের মানচিত্রে ত্রিপুরার অবস্থান (লাল চিহ্নিত)
ভারতের মানচিত্রে ত্রিপুরার অবস্থান (লাল চিহ্নিত)

তারপরেও আসাম ও ত্রিপুরার মতো একই কৌশলই মমতাকে পরাস্ত করতে দিলীপ ঘোষ কৈলাশ বিজয় বর্গীয়দের পুঁজি বলে মনে হচ্ছে। সাফল্য আসবে কি না, সেটা বোঝা যাবে ২৩ মে ভোট গণনার দিন। আর এই দিনে ভারতের জনগণের রায়ে নরেন্দ্র মোদি যদি দিল্লির মসনদে আবার বসেন, তবে ২০২১-এ পশ্চিমবঙ্গে রাজ্য বিধানসভার ভোটে কী হবে বলা কঠিন। আপাতত কংগ্রেস ও সিপিএমের কট্টর মমতা বিরোধিতাকে অনেকটাই নিজেদের ঝুলিতে নিয়ে আসতে পেরেছে। চলতি লোকসভা ভোটেই বহু বামপন্থী ও কংগ্রেসি তৃণমূলের বিরুদ্ধে নিজেদের ক্ষোভ উগরে দিতে বিজেপিকেই ভোট দিচ্ছেন। আসাম বা ত্রিপুরাতেও এটাই দেখা গিয়েছিল। আসামে কংগ্রেসবিরোধী ভোট যেমন পেয়েছে বিজেপি, তেমনি ত্রিপুরাতেও হিন্দুত্ববাদীদের ঝুলিতে এসেছে সিপিএমবিরোধী নেগেটিভ ভোট। শাসক দলের বিরুদ্ধে ক্ষোভটাকেও কাজে লাগানো বিজেপির কৌশলের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ।

পশ্চিমবঙ্গেও সেটা চলছে পুরোদমে। সোজা কথায়, রণে বা প্রেমে নৈতিকতার কোনো দাম নেই। তাই ছলে, বলে, কলে (রাষ্ট্রশক্তি), কৌশলে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতা দখলে মরিয়া বিজেপি। সাফল্যের বিষয়টি এখনো ভবিষ্যতের গর্ভে নিহিত।