বাংলাদেশি তরুণদের ভাবনা

অস্ট্রেলিয়ায় জাতীয় অঙ্গনে বাজছে নির্বাচনের দামামা। আর মাত্র দিন চারেক পর আগামী ১৮ মে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দেশটির ৪৬তম জাতীয় নির্বাচন। নির্বাচন সামনে রেখে নানা আনুষ্ঠানিকতা শেষ করছে রাজনৈতিক দলগুলো। একদিকে দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা জোট সরকার দল লিবারেল পার্টি আর অন্যদিকে প্রধান বিরোধী দল লেবার পার্টি। 

শেষ রাজ্য নির্বাচনে জয় সরকার দলের পক্ষে এলেও অস্ট্রেলিয়ার দীর্ঘদিনের ইতিহাস এবার বিরোধী দলের পক্ষ নিয়েছে। কে হতে চলেছেন অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী, কোন দল গঠন করবে সরকার—এমন সব প্রশ্ন এখন সবার মনেই।
অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসরত বাংলাদেশি তরুণ শিক্ষক, চিকিৎসক, উদ্যোক্তা, সমাজসেবীসহ আরও অনেকে কথা বলেন এই প্রতিবেদকের সঙ্গে। দেশটির সমাজ ও অর্থনীতিতে ভূমিকা রেখে চলা অস্ট্রেলিয়ার প্রবাসী বাংলাদেশি তরুণেরা কী ভাবছেন আসন্ন নির্বাচন নিয়ে সে কথাই থাকছে এখানে:

নির্বাহী হিসাবরক্ষক ও উদ্যোক্তা রিদওয়ান জামান। ছবি: সংগৃহীত
নির্বাহী হিসাবরক্ষক ও উদ্যোক্তা রিদওয়ান জামান। ছবি: সংগৃহীত

‘ব্যবসায়ীবান্ধব লিবারেল পার্টি’
রিদওয়ান জামান, নির্বাহী হিসাবরক্ষক ও উদ্যোক্তা

দেশটির বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার দল লিবারেল পার্টির দেশ পরিচালনা নীতি তরুণদের অগ্রগতির সহায়ক বলে মনে করেন এই তরুণ উদ্যোক্তা। তিনি বলেন, ‘বর্তমান সরকার ছোট ব্যবসায়ীবান্ধব। তাদের আমলে যেসব অর্থনৈতিক নীতিমালা বাস্তবায়িত হয়েছে, তা উদ্যোক্তাদের সফলতায় ভূমিকা রেখেছে। বিশেষ করে ছোট ব্যবসার জন্য কর কমিয়ে দেওয়া উদ্যোক্তাদের আরও উৎসাহিত করেছে।’ একজন উদ্যোক্তা হিসেবে সরকার দল লিবারেল পার্টিকে আবারও ক্ষমতায় দেখতে চান রিদওয়ান জামান।

সামাজিক সংগঠক ও ব্যবসায়ী সুরজিৎ রায়। ছবি: সংগৃহীত
সামাজিক সংগঠক ও ব্যবসায়ী সুরজিৎ রায়। ছবি: সংগৃহীত

‘কমিউনিটি খুশি নয় লেবারের ওপর’
সুরজিৎ রায়, সামাজিক সংগঠক ও ব্যবসায়ী

অস্ট্রেলিয়ার জনসংখ্যার একটা বড় অংশজুড়ে রয়েছে অভিবাসীরা। তাঁদের সবার মধ্যে কমিউনিটিভিত্তিক মতামতের একতা রয়েছে। কমিউনিটির মধ্যকার কারও সঙ্গে ঘটা ভালো বা মন্দ যেকোনো ঘটনায় সবাইকেই প্রভাবিত করে। সেদিক থেকে কমিউনিটিভিত্তিক সমর্থন লেবারের কম বলে মনে করেন সুরজিৎ রায়। তিনি বলেন, ‘লেবার সমর্থক কমিউনিটির অনেক নেতা–কর্মীর বিভিন্ন নেতিবাচক ঘটনা রয়েছে। ভালোভাবে যাচাই না করে দলের নেতা–কর্মী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া লেবার পার্টির একটা দীর্ঘদিনের সমস্যা। এ ছাড়া দলটি ক্ষমতায় থাকাকালে দেশের বিভিন্ন নীতিমালায় ভোগান্তির শিকার হয়েছেন অনেকেই। তাই কমিউনিটির একটা দীর্ঘদিনের ক্ষোভ রয়েছে লেবার পার্টির ওপর।’ তবে নির্বাচন পূর্ববর্তী সময়ে সমর্থক আকর্ষণ করতে লিবারেল পার্টি সফলতার মুখ দেখছে বলে মনে করেন সুরজিৎ রায়।

চিকিৎসক সুরঞ্জনা জেনিফার রহমান। ছবি: সংগৃহীত
চিকিৎসক সুরঞ্জনা জেনিফার রহমান। ছবি: সংগৃহীত

‘চিকিৎসা ক্ষেত্রের সুচিন্তক লেবার পার্টি
সুরঞ্জনা জেনিফার রহমান, চিকিৎসক

লেবারের প্রতি সমর্থন রয়েছে বলে জানান এই বাংলাদেশি চিকিৎসক। বলেন, ‘অস্ট্রেলিয়ায় চিকিৎসাসেবার মান বৃদ্ধি, প্রতিবন্ধীদের বিশেষ সুবিধা দেওয়া, ক্যানসার গবেষণাকেন্দ্রের পৃষ্ঠপোষকতা—এমন সব দিকগুলোর জন্য চিকিৎসকদের কাছে প্রশংসিত লেবার পার্টি। লেবার ক্ষমতায় এলে অস্ট্রেলিয়ার চিকিৎসা ক্ষেত্রের মান আরও বাড়বে বলে আশাবাদী।’ লেবারকে অনেকে ভোট দিতে চাইলেও ব্যক্তিগত স্বার্থে লিবারেলের সমর্থক বেশি বলেও মনে করেন এই বাংলাদেশি চিকিৎসক। তিনি বলেন, ‘লেবারের কর নীতিমালা অনেকের পছন্দ নয়। অনেকেই আমাকে বলেছেন লিবারেল পার্টির কর নীতিমালার কারণে দলটিকে সমর্থন করেন তাঁরা।’

প্রকৌশলী ও চলচ্চিত্র নির্মাতা আশিকুর রহমান। ছবি: সংগৃহীত
প্রকৌশলী ও চলচ্চিত্র নির্মাতা আশিকুর রহমান। ছবি: সংগৃহীত

‘সম্ভাবনাময় লিবারেল পার্টি’
আশিকুর রহমান, প্রকৌশলী ও চলচ্চিত্র নির্মাতা

চলচ্চিত্র নির্মাতা আশিকুর রহমান পেশায় একজন প্রকৌশলী। অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে তুলতে আগ্রহী দলকে সমর্থন করবেন বলে জানান তিনি। আশিকুর বলেন, ‘দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী ও সচ্ছল না হলে একটি দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয় না। তাই অর্থনীতি নিয়ে চিন্তা করা দলকেই সরকার হিসেবে চাইব।’ তবে লিবারেল দলকে ব্যক্তিগতভাবে অর্থনীতিবান্ধব বলে মনে করেন তিনি। আশিকুর বলেন, ‘সরকার দল বিরোধী দল লেবার পার্টির চেয়ে অর্থনীতিকে বেশি অগ্রাধিকার দিয়েছে বলে মনে করি। তাই এবার সম্ভাবনা রয়েছে লিবারেল পার্টির।’

মডেল সৈয়দা রাজী। ছবি: সংগৃহীত
মডেল সৈয়দা রাজী। ছবি: সংগৃহীত

‘আদি অস্ট্রেলিয়ানদের পছন্দ লিবারেল’
সৈয়দা রাজী, মডেল

অস্ট্রেলিয়ায় পড়াশোনা করেছেন সৈয়দা রাজী। প্রতিদিন তাঁর কাছে আসা বহু মানুষের রাজনৈতিক আলোচনা থেকে আদি অস্ট্রেলিয়ানদের লিবারেলের প্রতি সমর্থন বেশি রয়েছে বলে অনুমান করেন তিনি। সৈয়দা রাজি বলেন, ‘যদিও অস্ট্রেলিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাস বলে, টানা তিন মেয়াদে কোনো দল ক্ষমতায় আসেনি। তবে এবার মনে হচ্ছে সেটি হতে পারে। প্রতিদিন বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষের আলাপচারিতা থেকে বোঝা যায়, তাঁরা লিবারেল সমর্থন করে।’ তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য লিবারেলের কর লাঘব করার বিষয়টি তাঁকেও প্রভাবিত করেছে বলে জানান সৈয়দা রাজী।

কলেজ শিক্ষক সাদ্দাম খান। ছবি: সংগৃহীত
কলেজ শিক্ষক সাদ্দাম খান। ছবি: সংগৃহীত

‘শিক্ষার্থীদের সুযোগ কম লেবারের ক্ষমতায়’
সাদ্দাম খান, কলেজ শিক্ষক

পেশায় শিক্ষক এই বাংলাদেশি তরুণ লেবার পার্টিকে অভিবাসীবান্ধব নয় বলে মনে করেন। সাদ্দাম বলেন, ‘লেবার পার্টি শরণার্থীদের প্রতি বেশি ঝুঁকে পড়ে। অস্ট্রেলিয়ায় শিক্ষার্থী ও দক্ষ অভিবাসীদের সুযোগ কমে যায় দলটির ক্ষমতাকালীন সময়ে। অভিবাসীদের আনুপাতিক ভারসাম্যে অনেকটাই তারতম্য দেখা দেয় লেবারের অধীনে।’ লেবার পার্টিকে আত্মকেন্দ্রিক দল বলেও মনে করেন তিনি। সাদ্দাম বলেন, ‘লেবার সরকার গঠন করলে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে লেবার দল নিজেই। কারণ, দলটির নীতিমালা প্রণয়নসহ সবকিছুতেই নিজেদের লাভবান করতে চেষ্টা করে। ফলে দেখা যায় বড় বড় ব্যবসায়ীরা লাভবান হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ অন্যান্য ব্যবসায়ী ও পেশাদারদের জীবনযাত্রার মান কমে যায়।’

শিল্পকারখানা উপদেষ্টা রিজওয়ান চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত
শিল্পকারখানা উপদেষ্টা রিজওয়ান চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত

‘বেতন স্কেল বাড়েনি গত আট বছরে’
রিজওয়ান চৌধুরী, শিল্পকারখানা উপদেষ্টা

বর্তমান সরকারের সময়ে দুই মেয়াদে কর্মীদের বেতন বাড়েনি বলে মনে করেন এই তরুণ বাংলাদেশি উপদেষ্টা। রিজওয়ান বলেন, ‘লিবারেল সময়ের সঙ্গে কর্মীদের বেতন বৃদ্ধি নিয়ে একদমই ভাবেনি। বেতন বৃদ্ধির হার নজরে পড়ার মতো। অভিবাসী কর্মীরা দীর্ঘদিন বিষয়টির দাবি করে আসছেন। এ ছাড়া শিল্পকারখানার মধ্যকার সম্পর্কের নতুনত্ব প্রয়োজন। যার অভাবে কর্মীদের প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান দিতে একাধিক চাকরি করতে হচ্ছে।’ লেবার পার্টি ক্ষমতায় এলে শিল্পকারখানা পরিচালনা পদ্ধতিতে পরিবর্তন আসবে বলে আশাবাদী রিজওয়ান চৌধুরী।

সম্পত্তি বিক্রয় পরামর্শদাতা তালাত মাহমুদ। ছবি: সংগৃহীত
সম্পত্তি বিক্রয় পরামর্শদাতা তালাত মাহমুদ। ছবি: সংগৃহীত

‘বিনিয়োগকারীদের ভরসা নেই লেবারের ওপর’
তালাত মাহমুদ, সম্পত্তি বিক্রয় পরামর্শদাতা

সম্পত্তির ওপর কর নীতিমালা নিয়ে লেবারের পরিকল্পনা নিয়ে নাখোশ অনেকেই বলে মনে করেন বাংলাদেশি এই তরুণ পরামর্শদাতা। তিনি বলেন, ‘প্রবাসী বাংলাদেশিসহ অনেক নতুন বিনিয়োগকারীর জন্য অস্ট্রেলিয়ায় সবচেয়ে বড় সম্ভাবনার ক্ষেত্র হচ্ছে বসতবাড়ি বা জমি। তবে লেবারের সম্পত্তির ওপর কর বৃদ্ধির পরিকল্পনা শঙ্কিত করে তুলেছে বিনিয়োগকারীদের। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, অনেকেই চাইবে না লেবার ক্ষমতায় আসুক। আর লিবারেল সমর্থক না হয়েও তাই দলটিকে ভোট দেবে কেউ কেউ।’