মহাকাশ পর্যটনে দেদার অর্থ কামাচ্ছে চীন

চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের গানসু প্রদেশে মরুময় পাহাড়ে ঘেরা মঙ্গল গ্রহবিষয়ক ক্যাম্প মার্স বেজ ১। ছবি: এএফপি
চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের গানসু প্রদেশে মরুময় পাহাড়ে ঘেরা মঙ্গল গ্রহবিষয়ক ক্যাম্প মার্স বেজ ১। ছবি: এএফপি

স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েরা চোখ বড় বড় করে দেখছিল দৃশ্যটা। তাদের গাইড গুয়ো জিয়ায়ু একটি শুঁয়োপোকাকে টিপে ভর্তা বানিয়ে বললেন, লাল গ্রহে নভোচারীদের খাবারের তালিকায় এটিও থাকতে পারে। এই ছেলেমেয়েরা এসেছে বিখ্যাত গোবি মরুভূমিতে। চীনের অংশের এই মরুভূমিতেই গড়ে তোলা হয়েছে লাল গ্রহ, অর্থাৎ মঙ্গল গ্রহবিষয়ক ক্যাম্প মার্স বেজ ১। মঙ্গল গ্রহে যাত্রা নিয়ে আগ্রহী ছেলেমেয়েরা এই ক্যাম্প থেকে জেনে নিচ্ছে কেমন হতে পারে মঙ্গল গ্রহে যাত্রা। ক্যাম্পের একটি অংশে নিয়ন আলো ঘেরা করিডর ধরে গেছে ঘুমানোর কক্ষ এবং একটি নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র। বাইরের এবড়োখেবড়ো বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ঘুরে বেড়ানোর জন্য প্রস্তুত রয়েছে মহাকাশ স্যুট।

পশ্চিমাঞ্চলের গানসু প্রদেশের নিকেলখনির শহর জিনচ্যাংয়ের কাছের ছোট্ট একটি স্থাপনা মার্স বেজ ১। গত বছর এটি নির্মাণ করা হয় স্থানীয় মুদ্রা প্রায় পাঁচ কোটি ইউয়ান (প্রায় ৬৩ কোটি ৩৮ লাখ ২৮ হাজার টাকা) ব্যয়ে। বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের সহায়তায় এটি নির্মাণ করেন ব্রিটেনে পড়াশোনা করা উদ্যোক্তা বাই ফ্যান। তিনি এখন স্থানটিকে মূলত ব্যবহার করছেন মঙ্গল গ্রহে ভ্রমণে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য। তাঁর আশা, এটি একসময় শৌখিন রিসোর্ট হয়ে উঠবে। তাঁর প্রতিষ্ঠান মরুভূমি ঘিরে ৬৭ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে নিরাপত্তা ও উন্নয়নের কাজ করছে। এখানে ইতিমধ্যে একটি টেলিভিশন রিয়েলিটি শো হয়েছে। অনুষ্ঠানটিতে ছয়জন তারকা নভোচারীর ভূমিকায় ঝুঁকিপূর্ণ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়ার অভিনয় করেছেন।

চীনজুড়ে ব্যবসায়ীরা মহাকাশভ্রমণে দেশটির অনুসন্ধান খাতে অর্থ আয়ের সম্ভাবনা দেখছে। গত জানুয়ারি মাসে চীনই প্রথম দেশ, যাদের মহাকাশযান চাঁদ থেকে কিছু দূরে অবতরণ করে। নমুনা সংগ্রহ করে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার জন্য এ বছর চাঁদের উপরিভাগে আরেকটি মহাকাশযান পাঠাতে চায় চীন। শেষবার ১৯৭৬ সালে এ কাজটি করেছিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন। আগামী বছর চীন পৃথিবী পরিভ্রমণের পথে নতুন মহাকাশ স্টেশনের মূল বিভাগটি উদ্বোধন করতে চায় এবং মঙ্গল গ্রহে রোভার পাঠাতে চায়।

স্বাভাবিকভাবেই এসব ব্যাপারে লোকজনের তুমুল আগ্রহ রয়েছে। রেকনস সিট্রিপ নামে চীনের এক ভ্রমণবিষয়ক সংস্থার দেওয়া তথ্য অনুসারে, গত বছর অনলাইনে মহাকাশ–সম্পর্কিত জাদুঘর, আকর্ষণীয় স্থান ও ভ্রমণ বিষয়ে মানুষের অনুসন্ধান ৬০ শতাংশ বেড়েছে। মার্চ মাসে মঙ্গল গ্রহের থিম নিয়ে তিব্বতীয় মালভূমিতে আরেকটি স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানে পর্যটন ধারণ ক্ষমতা রয়েছে ১৬০ জনের। চীনের নিউজ সাইট সিক্সথ টোন জানিয়েছে, ২০১১ সালের তুলনায় প্রকাশকেরা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিভিত্তিক বই পাঁচ গুণ বেশি ছাপাচ্ছে।

মার্স বেজ ১–এ একজন গাইড মহাকাশ স্যুট পরছেন। ছবি: এএফপি
মার্স বেজ ১–এ একজন গাইড মহাকাশ স্যুট পরছেন। ছবি: এএফপি

একদম দক্ষিণের প্রদেশ হাইনানে ২০১৬ সালে কার্যক্রম শুরু করা মহাকাশ-উদ্বোধন সাইট থেকে অর্থ আয়ের প্রত্যাশা করছেন কর্মকর্তারা। এর আগে এমন স্থাপনা দুর্গম এলাকায় তৈরি করা হয়েছিল। নতুন সুবিধাদি পর্যটকদের জন্য আরও বেশি প্রবেশযোগ্য হয়েছে। কাছের বালুর সৈকত থেকে এর উদ্বোধন কার্যক্রম দেখা যায়। তবে এখন লোকের সবচেয়ে বেশি মনোযোগ রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় রেডিও টেলিস্কোপ ফাস্টের দিকে। দক্ষিণের আরেক প্রদেশ গুয়াইঝোর দুর্গম নদী অববাহিকায় এটি স্থাপন করা হয়েছে। ৫০০ মিটার ব্যাসের একটি যন্ত্রও ২০১৬ সালে চালু করা হয়েছে। গত বছরের শুধু প্রথম ভাগেই এটি দেখতে এসেছিলেন ৫০ লাখ দর্শনার্থী। তবে এর ভেতরে অল্প কিছু পর্যটকই প্রবেশের সুযোগ পান। প্রতিদিন মাত্র দুই হাজার মানুষ এর ভেতরে ঢুকতে পারেন। কিন্তু এটাকে উপলক্ষ করে আশপাশের শহরগুলোতে মানুষের ভিড় উপচে পড়ে।

গুয়াইঝো কর্তৃপক্ষ চিন্তিত এই ভেবে যে পর্যটকদের এই ভিড় টেলিস্কোপটির কার্যকারিতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এ ভিড় কমাতে সেই এলাকা ঘিরে তারা অন্যান্য উন্নয়ন পরিকল্পনা করছে। কিন্তু শাসক কমিউনিস্ট পার্টি মহাকাশের প্রতি মানুষের এই আকর্ষণ থেকে সুবিধা তুলতে চাইছে। মহাকাশবিজ্ঞান নিয়ে তুমুল আগ্রহের পাশাপাশি দেশপ্রেম বোধে আগ্রহী করে তুলতে চাইছে লোকজনকে। এই মঙ্গল গ্রহে ভ্রমণের ক্যাম্পে আসা ১৩ বছর বয়সী এক কিশোরী উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলেছে, সে এক সময় মঙ্গল গ্রহ ভ্রমণে যেতে চায়। আমেরিকানরা চাঁদে প্রথম পা রেখেছে। তাহলে মঙ্গল গ্রহে কেন চীনারা প্রথম হতে পারবে না?

সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট