লোকসভার শেষ পর্বের ভোট আজ, ফল নিয়ে জল্পনা

ইভিএম পরীক্ষা করছেন নির্বাচন কর্মকর্তারা। গতকাল ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায়।  ছবি: এএফপি
ইভিএম পরীক্ষা করছেন নির্বাচন কর্মকর্তারা। গতকাল ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায়। ছবি: এএফপি
>আজ রোববার সন্ধ্যা থেকে শুরু হবে বুথ ফেরত সমীক্ষার ফল। সম্ভাব্য ফল ঘিরে উত্তেজনা।

এক মাসের বেশি সময় ধরে চলা ভারতীয় সংসদের ভোট শেষ হতে চলেছে। আজ রোববার ৫৯ কেন্দ্রের ভোট গ্রহণের মধ্য দিয়ে শেষ হবে সাত দফার দীর্ঘতম এই ভোট–পর্ব। আজ যে যে কেন্দ্রের ভোট, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে উত্তর প্রদেশের বারানসি, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যেখান থেকে ভোটপ্রার্থী। শেষ দফায় ভোট হবে মধ্যপ্রদেশ ও বিহারের ৮টি করে কেন্দ্রে, পাঞ্জাবের ১৩, ঝাড়খন্ডের ৩, উত্তর প্রদেশের ১৩, হিমাচল প্রদেশের ৪, চণ্ডীগড় ও পশ্চিমবঙ্গের অবশিষ্ট ৯ কেন্দ্রে। ভোট গণনা তিন দিন পর, ২৩ মে।

ভোট গ্রহণের সময় বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত। যদিও লাইনের শেষ ভোটারের ভোট শেষ হতে কখনো কখনো রাত হয়ে যায়। ভোট গ্রহণের নির্দিষ্ট সময় শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আজ সন্ধ্যা থেকে শুরু হয়ে যাবে চ্যানেলে চ্যানেলে বুথ-ফেরত সমীক্ষার ফল। আজকের এই শেষ পর্বের ভোটের আকর্ষণ এটাই। এ মুহূর্তের যাবতীয় উত্তেজনা ও জল্পনা ওই বুথ-ফেরত সমীক্ষা বা ‘এক্সিট পোল’ ঘিরেই। গণনার দিন পর্যন্ত বিভিন্ন সমীক্ষার এই ফলই হয়ে দাঁড়াবে আলোচনার বিষয়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইতিমধ্যে একটি চ্যানেলের সেই সমীক্ষার ‘ফল’ প্রকাশ ঘিরে রীতিমতো চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে। তাতে দেখানো হয়েছে, বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ পাচ্ছে ১৭৭, কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ ১৪১ এবং অন্যরা ২২৪ আসন। সংশ্লিষ্ট চ্যানেলের পক্ষ থেকে ফাঁস হওয়া ওই ‘ফল’ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ওটি আদৌ সত্যি নয়। যা দেখানো হয়েছে তা আদতে চ্যানেলের ‘ডামি’।

চাঞ্চল্য আরও এই কারণে, এবারের মতো এমন টান টান ভোট ভারতে আগে হয়নি। সম্ভাব্য ফল ঘিরে এমন উত্তেজনা আগের কোনো ভোটে ছিল না। এমন ‘একমুখী’ ভোটও কখনো হয়নি। ভোটের একদিকে শাসক দল ও জোটের একটাই মুখ—প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। অন্যদিকে ছত্রভঙ্গ বিরোধীকুল। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ঢঙে এই প্রথম ভোট হতে চলেছে ভারতে।

৫৪৩ কেন্দ্রেই শাসক দল ভোট চেয়েছে মোদির নামে। একের বিরুদ্ধে অন্য অনেকের এই অনন্য লড়াই-ই এবারের ভোটকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। ভোট শুরু হয়েছিল মোদি-সরকারের পাঁচ বছরের ‘সাফল্য’ ঘিরে। কিন্তু প্রচার যত এগিয়েছে, ততই বড় হয়ে উঠেছে পুলওয়ামা-বালাকোট-পাকিস্তান। সবকিছু ছাপিয়ে বড় করে তোলা হয়েছে দেশের নিরাপত্তার প্রশ্ন। কাজেই অভূতপূর্ব এই ভোট ঘিরে কোনো মহলই ভবিষ্যদ্বাণী করতে সাহস পাচ্ছে না। যদিও গত শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী মোদি এবং বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ দাবি করেছেন, ৩০০-এর বেশি আসন একা জিতে মোদি দ্বিতীয়বারের মতো দেশের দায়িত্ব হাতে নেবেন। গতবার বিজেপি একাই পেয়েছিল ২৮২ আসন।

এবারের ভোটের মতো এত কু-কথা আগে কখনো শোনা যায়নি। নেতাদের ভাষণ বহু ক্ষেত্রে শালীনতার বেড়া টপকেছে। ব্যক্তিকেন্দ্রিক কুৎসা ছড়ানো হয়েছে। প্রয়াত নেতাদের কালিমালিপ্ত করা হয়েছে। বড় বড় নেতার নামে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ জমা পড়েছে বিস্তর। পক্ষপাতিত্বের অভিযোগও উঠেছে। নির্বাচন কমিশনের আচরণ ঘিরেও প্রশ্ন তোলা হয়েছে। প্রশ্ন তুলেছেন কমিশনের তিন সদস্যের অন্যতম অশোক লাভাসা। নির্বাচন কমিশনে এমন ঘটনা অতীতে কখনো ঘটেনি।

পাঁচ বছর আগের ভোটে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি একাই নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা পেয়েছিল। উত্তর ভারতে ভোট হয়েছিল মোদির নামে। হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখন্ড, দিল্লি, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, গুজরাট, মহারাষ্ট্র, বিহার ও ঝাড়গ্রামে বিজেপি ও তার শরিকেরা বিরোধীদের দাঁড়াতেই দেয়নি। এবার উত্তর প্রদেশে প্রধান তিন বিরোধী দল জোটবদ্ধ হয়েছে। জোট জমাট বিহার ও ঝাড়খন্ডেও। রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ের শাসনক্ষমতা বিজেপির হাত থেকে কেড়ে নিয়েছে কংগ্রেস। হিন্দি-হৃদয়পুরে বিজেপি ও শরিকদের আসন বাড়ানোর সম্ভাবনা ক্ষীণ বলে তারা এবার পূর্বমুখী। নজর দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ ও ওডিশায়। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির উত্থানে বড় বাধা তৃণমূল কংগ্রেস। রাজ্যে প্রতিটি পর্বের ভোটে হিংসা থাবা বসিয়েছে। নির্বাচন কমিশন বাধ্য হয়েছে রাজ্যের প্রচার এক দিন আগেই বন্ধ করে দিতে।

ভোট-পর্ব শেষ হওয়ার আগেই ঈশ্বরের শরণাপন্ন হয়েছেন মোদি ও শাহ। নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা হওয়ার পর দুই মাসের বেশি বিশ্রামহীন কেটেছে তাঁদের। শনিবার মোদি তাই চলে যান উত্তরাখন্ড, শাহ গুজরাট। উত্তরাখন্ডের কেদারনাথ মন্দিরে সকালে পূজা দেন মোদি। গেরুয়া বসন পরে ধ্যানেও বসেন। হিমালয়ের পাদদেশে কেদারনাথ ভগবান শিবের পীঠস্থান। সেখানে প্রার্থনা সেরে তিনি যাবেন বদ্রিধাম, ভগবান বিষ্ণুর অধিষ্ঠান যেখানে। অমিত শাহ শনিবার পূজা দেন ও প্রার্থনা সারেন গুজরাটের সোমনাথ মন্দিরে। ভোটের আচরণবিধি চালু থাকায় দুই নেতাই তীর্থে যাওয়ার জন্য নির্বাচন কমিশনের অনুমতি নেন।

বিজেপি ও এনডিএ গতবারের মতো আসন পাবে না ধরে নিয়ে বিরোধীরাও তৎপর। ইউপিএ চেয়ারপারসন সোনিয়া গান্ধী বিরোধী নেতাদের চিঠি দিয়ে ২৩ মে বৈঠকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। অন্ধ্র প্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও তেলেগু দেশম নেতা চন্দ্রবাবু নাইডু সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। তিনি ইতিমধ্যে দেখা করেছেন আম আদমি পার্টির নেতা দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল, এনসিপি নেতা শারদ পাওয়ার, জনতা দল নেতা শরদ যাদব ও কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধীর সঙ্গে। বিরোধীদের এক জোট করতে তিনি সচেষ্ট। কংগ্রেস ও বিজেপি থেকে সমদূরত্বের নীতি নিলেও ওডিশার বিজু জনতা দলের নেতা নবীন পট্টনায়ক জোটের পক্ষে নমনীয়তার ইঙ্গিত দিয়েছেন। বিজেপিকে তিনি ‘সাম্প্রদায়িক’ দল বলেছেন। আর বলেছেন, ওডিশার স্বার্থরক্ষায় যে দল কাজ করবে, তিনি তাদের সমর্থন দেবেন। ইতিবাচক ইঙ্গিত মিলেছে বাম মহল থেকেও। সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি বলেছেন, ধর্মনিরপেক্ষ জোটকে তাঁরা সমর্থন করবেন। উত্তর প্রদেশের সমাজবাদী পার্টি ও বহুজন সমাজ পার্টির সঙ্গে কথা বলতে চন্দ্রবাবু শনিবার চলে যান লক্ষ্ণৌ। অখিলেশ যাদব ও মায়াবতীর সঙ্গে তাঁর আলোচনায় বসার কথা।