কমপ্লায়েন্স বিভাগে কর্মীর চাহিদা বাড়ছে

বর্তমান বিশ্বে প্রযুক্তির ছোঁয়ার সবকিছুতে যেমন তেলেসমাতি বেড়েছে, একই সঙ্গে বেড়েছে জটিলতাও। বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ম-নীতি ভঙ্গ করা ও কর ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতাও কম নয়। প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ নিয়ম-নীতি ও গোপনীয়তা রক্ষা এবং বাহ্যিক আইনি জটিলতা মোকাবিলা করতে গত এক দশকে বিশ্বে কমপ্লায়েন্স বিভাগের গুরুত্ব বেড়েছে।

বলে রাখা প্রয়োজন, বিদ্যমান আইন অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানের বিশেষ রীতিনীতি ও পদ্ধতি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া দেখভাল করাই হচ্ছে কমপ্লায়েন্স বিভাগের কাজ। প্রতিষ্ঠানের মূলধন থেকে শুরু করে করপোরেট প্রশাসনসহ প্রায় সবকিছুই কমপ্লায়েন্স বিভাগের নজরে থাকে। প্রতিষ্ঠানের খরচ সাশ্রয় করে মুনাফা অর্জনে অবদান রাখে এই বিভাগ। ফলে, বহির্বিশ্বের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় কমপ্লায়েন্স কর্মকর্তাদের কদর বেশি।

বিশ্বে ২০০৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মানি লন্ডারিং ও নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার দায়ে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে ২৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার জরিমানা করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করায় ফরাসি আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং গ্রুপ বিএনপি পরিবাসকে এককভাবে ৮ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার জরিমানা গুনতে হয়েছে। ডেনমার্কের ডেনসকে ব্যাংক, সুইডেনের সুয়েড ব্যাংকসহ ইউরোপ অঞ্চলের স্ক্যান্ডিনেভিয়ান ব্যাংকগুলো এসব কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে জরিমানা দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে তারা কমপ্লায়েন্স কর্মকর্তাদের ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় দিকে ব্যবহার করছে। উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল-স্কেল অপারেশন’ তৈরি করতে তাগিদ দিয়েছেন এইচএসবিসি ব্যাংকের প্রধান কমপ্লায়েন্স কর্মকর্তা (সিসিও) সিলন বেল।

বর্তমানে কমপ্লায়েন্স বিভাগকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। ব্যাংকিংসহ বিভিন্ন কাজে কমপ্লায়েন্স বিভাগের তথ্য-উপাত্ত গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরে তারা। পাশাপাশি ব্যবসায় সংশ্লিষ্ট পক্ষের কাছে নিজেদের প্রতিষ্ঠানে কমপ্লায়েন্স বিভাগ সক্রিয় আছে উল্লেখ করে ইতিবাচক ভাবমূর্তি তুলে ধরা হয়।

সম্প্রতি যুক্তরাজ্যভিত্তিক সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালের শেষে আমেরিকান ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের ২ লাখ ৪ হাজার কর্মীর মধ্যে ৩০ হাজার জন (১৫ শতাংশ) কমপ্লায়েন্স, ঝুঁকি ও অন্যান্য নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে কর্মরত ছিলেন। ২০০৮ সালের শেষে যা ছিল ৪ শতাংশের সামান্য বেশি। ১০ বছরের ব্যবধানে এই খাতে কর্মীর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় চার গুণ।

যুক্তরাজ্যের আর্থিক নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিন্যান্সিয়াল কনডাক্ট অথোরিটির তথ্যমতে, মেক্সিকান কালো টাকা ব্যাংকিং ও অন্যান্য অনিয়মের দায়ে ২০১২ সালে এইচএসবিসি ব্যাংককে ১৯০ কোটি মার্কিন ডলার জরিমানা করা হয়। যদিও এই প্রতিষ্ঠানে আছে অর্থ পাচার প্রতিরোধী (অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং বা এএমএল) কমপ্লায়েন্সের পাঁচ হাজার কর্মী। এ ছাড়া নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনের জন্য স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংককে ১৮০ কোটি ডলার অর্থদণ্ড করা হয়। আর এ প্রতিষ্ঠানে অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং-বিষয়ক কর্মী আছে সাড়ে তিন হাজার। উভয় ব্যাংক প্রতিটি অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং বিষয়ে বছরে ৫০০ মিলিয়ন ডলার খরচ করে। ব্রিটিশ ব্যাংকের বার্ষিক অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং বিষয়ে ব্যয় ৫০০ কোটি ডলার। ২০১৪ সালে বিএনপি পরিবাসকে বড় ধরনের জরিমানা করা হয়েছিল। এই প্রতিষ্ঠানে কমপ্লায়েন্স ও অন্যান্য কার্যক্রমের জন্য রয়েছে প্রায় ১৩ হাজার কর্মী। অর্থাৎ এটা পরিষ্কার করে যে শুধু নিয়মতান্ত্রিক নয়, অনিয়মের ক্ষেত্রেও কমপ্লায়েন্স কর্মকর্তাদের ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার প্রতিষ্ঠান অ্যাসোসিয়েশন অব সার্টিফায়েড অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্টের বিশ্বব্যাপী সদস্যসংখ্যা বাড়ছে। ২০০৭ সালে এর সদস্য সংখ্যা ৫ হাজার ৬০০ থেকে বেড়ে এখন হয়েছে ৭০ হাজার জন। ব্যাংকগুলো শুধু অর্থ কেলেঙ্কারিতে ধরা খায়নি, বরং বাজার শান্ত করতে সাফাই বিজ্ঞাপন প্রচার ও প্রকাশ করে ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে। ডেনসকে ব্যাংক বলছে, চলতি বছরে তারা ৬০০ নতুন কমপ্লায়েন্স কর্মী ভাড়া নেবে। ২০১৫ সালের চেয়ে যা চার গুণ বেশি।

কমপ্লায়েন্স খাতে শুধু খরচ বেড়েছে এমন নয়, এই খাত থেকে নানামুখী সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে। আগে এই খাতে আইন ও ঝুঁকি বিভাগে সুপ্ত অবস্থায় ছিল। এখন এটি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ স্তরে দাপুটে রূপ নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান হেইড্রিক ও স্ট্রাগলের কর্মকর্তা মার্ক জ্যাকসন বলেন, কমপ্লায়েন্স এখন অনেক বেশি প্রভাবশালী খাতে পরিণত হয়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার পর চাকরির বাজারের অন্যতম আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে এই খাত। বিশ্বজুড়ে এখন বহুমুখী কাজের দক্ষতাসম্পন্ন কমপ্লায়েন্স কর্মকর্তাদের জোরালো ভূমিকা ব্যাংকারদের জন্য আতঙ্কের কারণ। অবশ্য এশিয়ার বাংলাদেশ ও ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোয় কমপ্লায়েন্স বিভাগ ততটা শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেনি। বিশ্বের নামকরা নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর ভাষ্য, মেধাবী আইনজীবী বা আইন বিষয়ে ভালো জানাশোনা ব্যক্তিরা এই খাতে সম্পৃক্ত হতে বেশি আগ্রহী।

বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান এইচটিএফের তথ্যমতে, ২০১৮ সালে বিশ্বব্যাপী রেকটেকের (আর্থিক প্রতিষ্ঠান) বাজার মুনাফা ছিল ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। ২০২৫ সাল নাগাদ সম্ভাব্য সেই মুনাফা দাঁড়াবে ৬ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারে। ২০১৮ সালে ৮০০ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঝুঁকি ও কমপ্লায়েন্স কর্মকর্তারা বিশ্বব্যাপী গবেষণা করে দেখেন, পরবর্তী ১২ মাসের মধ্যে তাঁদের ক্ষেত্র ৪৩ শতাংশ বাড়তে পারে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বিএনপি পরিবাস বাণিজ্য ও কমপ্লায়েন্স খাতে তাদের কর্মীদের মনোযোগ বাড়াতে উৎসাহিত করছে। কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাদের কমপ্লায়েন্স কর্মকর্তাদের দিয়ে কমপ্লায়েন্স-সংক্রান্ত আউটসোর্সিং বা বিশেষ প্রকল্পে কাজ করাচ্ছে। আমেরিকান ফার্ম কমপ্লায়েন্স রিস্ক কনসেপ্টসের ম্যানেজিং পার্টনার মিচ অ্যাভনেট বলেন, বছরে এই খাতে ৩০ শতাংশ চাহিদা বাড়ছে।

বর্ধিত চাহিদা মেটাতে ব্যাংক নিয়ন্ত্রকেরা কী পরিমাণ মানবসম্পদ কমপ্লায়েন্স খাতে নিয়োজিত করবে, সেটা এখন বড় প্রশ্ন হয়ে উঠেছে। তা ছাড়া পুরোনো ধ্যানধারণার ব্যাংকারদের দিয়ে তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর কমপ্লায়েন্স বিভাগ চালানো নিয়েও আছে সংশয়। ফলে, এ খাতে নতুন, তরুণ বা প্রশিক্ষিত দক্ষ জনবল নিয়োগ করা সময়ের দাবি।