পশ্চিমবঙ্গে মোদি ঝড়ে তছনছ মমতার সাজানো বাগান

ভোটের ফলাফল ঘোষণার পর রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় বিজেপির সমর্থকেরা বিজয় আনন্দে মেতে ওঠেন। একে অপরকে জড়িয়ে ধরে শুভেচ্ছা বিনিময় ও মিষ্টিমুখ করানো হয়। ছবি: ভাস্কর মুখার্জি
ভোটের ফলাফল ঘোষণার পর রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় বিজেপির সমর্থকেরা বিজয় আনন্দে মেতে ওঠেন। একে অপরকে জড়িয়ে ধরে শুভেচ্ছা বিনিময় ও মিষ্টিমুখ করানো হয়। ছবি: ভাস্কর মুখার্জি

এবার পশ্চিমবঙ্গে মোদি ঝড় চুরমার করে দিয়েছে মমতার এত দিনে তিলে তিলে তৈরি সাজানো বাগানকে। মমতাও বুঝতে পারেননি, এভাবে তাঁর রাজ্যের ৪২ আসনে জয়ের স্বপ্ন চুরমার করে দেবে মোদি ঝড়। তাঁর ধারণা ছিল, এবার ভারত থেকে বিদায় হবে মোদি শাসন। ভারতে আসবে জনগণের শাসন। কিন্তু মমতার সেই স্বপ্ন ভেঙে দিলেন নরেন্দ্র মোদি।

ভারতের লোকসভা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে থেকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজনৈতিক ময়দানে নামেন পশ্চিমবঙ্গের লোকসভার ৪২ আসনের জয়ের বার্তা নিয়ে। মমতা নিজেই বারবার ঘোষণা দিয়েছেন এই রাজ্যের ৪২টি আসনেই জিতবে তৃণমূল। বিরোধীদের জন্য এবার একটি আসনও নয়। শুধু তা–ই নয়, মমতা-চন্দ্রবাবু নাইডুরা বৃহত্তর জোট গড়লেও পশ্চিমবঙ্গে কোনো দলের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি করেনি তৃণমূল কংগ্রেস। লড়েছে একা। ভাগ দেয়নি কোনো দলকে। মমতার ধারণা ছিল, এই রাজ্যে তাঁর দল ছাড়া বিকল্প নেই। সুতরাং নিজের অহংকারের দাপটে একা লড়ে ৪২ আসন ছিনিয়ে নিতে গিয়ে এবার ধরা পড়ে গেছেন মানুষের কাছে। মমতাকে প্রত্যাখ্যান করেছে সাধারণ মানুষ।

ভোটের ফলাফল ঘোষণার পর রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় তৃণমূল ও বিজেপির সমর্থকেরা বিজয় আনন্দে মেতে ওঠেন। আবির মেখে এবং নিজ নিজ দলের পতাকা নিয়ে আনন্দে মেতে ওঠেন তাঁরা। ছবি: ভাস্কর মুখার্জি
ভোটের ফলাফল ঘোষণার পর রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় তৃণমূল ও বিজেপির সমর্থকেরা বিজয় আনন্দে মেতে ওঠেন। আবির মেখে এবং নিজ নিজ দলের পতাকা নিয়ে আনন্দে মেতে ওঠেন তাঁরা। ছবি: ভাস্কর মুখার্জি

পশ্চিমবঙ্গে প্রচারে এসে বিজেপি নেতা ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, মমতার অহংকার মমতাকে ডোবাবে। ভোটের ফলাফল ঘোষণার পর সেই আশঙ্কাই এবার সত্যি হয়েছে। মমতা এবার ৪২ আসনের মধ্যে জিততে চলেছেন ২৩টি আসন। আর যে বিজেপিকে তিনি শূন্য আসন দিয়েছিলেন, সেই বিজেপি এবার ছিনিয়ে নিতে চলেছে ১৮টি আসন। আর কংগ্রেস একটি। তবে এটি চূড়ান্ত ফল নয়। আজ বৃহস্পতিবার বিকেল চারটায় ইভিএমে ফল গণনা শেষ হলে এই ছবি উঠে আসে। এখনো প্রতিটি কেন্দ্রের ভিভিপ্যাটের ভোট গণনা বাকি। সেটি গণনা করতে ৮–১০ ঘণ্টা লেগে যাবে। তাই চূড়ান্ত ফল পেতে আগামীকাল সকাল হয়ে যেতে পারে।

এবার মমতা প্রচারে গিয়ে ভোটের জন্য যেভাবে প্রধানমন্ত্রী মোদিকে গালাগাল করেছেন, সেটি অনেকেই মেনে নিতে পারেননি। তাঁর বেফাঁস মন্তব্যে অনেকেই ক্ষুব্ধ হয়েছেন মমতার ওপর। আবার মমতার ৪২ এ ৪২ আসন জেতার ঘোষণাও মানুষ মেনে নিতে পারেনি। অনেকেই বলেছেন, এটা গণতন্ত্রের ভাষা হতে পারে না। তৃতীয়ত, মমতার মুসলিম ভোট ব্যাংক নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য যেভাবে তিনি সাম্প্রদায়িকতার কথা প্রচার করেছেন, তা–ও মেনে নিতে পারেনি অসাম্প্রদায়িক মানুষ। এসব কারণেই এবার ভরাডুবি হয়েছে মমতার।

এবার এই রাজ্যে খাতা খুলতে পারেনি বামফ্রন্টও। তারা একটি আসনও পায়নি। অথচ গত নির্বাচনে তারা পেয়েছিল ২টি আসন। এবার কংগ্রেস পেয়েছে মাত্র একটি আসন। গত নির্বাচনে পেয়েছিল চারটি আসন। এবার পেল শুধু বহরমপুর আসন। এই আসনে লড়েছেন কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরী। তিনিই সম্মান রক্ষা করেছেন কংগ্রেসের। জিতেছেন এই আসন থেকে।

অন্যদিকে ঐতিহাসিক ফলাফল করেছে বিজেপি। দলটির কেন্দ্রীয় সভাপতি অমিত শাহ ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যেভাবে পশ্চিমবঙ্গে বারবার এসে প্রচারের সঙ্গী হয়েছেন, তাতেই মানুষ ঝুঁকে পড়েছে বিজেপির দিকে। একজন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এই রাজ্যে ১৯টি জনসভা করা ছিল মোদির ঐতিহাসিক রেকর্ড। রাজ্যের মানুষও মোদি ও অমিত শাহর এই নিরলস পরিশ্রমের যথাযথ ফসল তুলে দিয়েছেন তাঁদের হাতে।

বিজেপির যাঁরা জিততে চলেছেন
মেদিনীপুরে বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ, কোচবিহারে নিশীথ প্রামাণিক, আলিপুরদুয়ারে জন বারলা, জলপাইগুড়িতে জয়ন্ত রায়, রায়গঞ্জে দেবশ্রী চৌধুরী, বালুরঘাটে সুকান্ত চৌধুরী, মালদহ উত্তরে খগেন মুর্মু, মালদা দক্ষিণে শ্রীরূপা মিত্র চৌধুরী, দার্জিলিংয়ে রাজু সিং বিস্ত, বনগাঁয় শান্তনু ঠাকুর, আরামবাগে তপন রায়, ঝাড়গ্রামে কুনার হেমব্রম প্রমুখ।

পরাজিত হওয়ার পথে যাঁরা
পরাজিতের তালিকায় রয়েছেন বাঁকুরায় তৃণমূলের নেতা ও রাজ্যের মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়, মেদিনীপুরে তৃণমূলের সাবেক মন্ত্রী মানস ভূঁইয়া, আসানসোলে মুনমুন সেন, জঙ্গিপুরে সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের ছেলে কংগ্রেসের অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়, ঘাটালে সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা ভারতী ঘোষ, হুগলিতে বর্তমান তৃণমূল সাংসদ রত্না দে নাগ, যাদবপুরে কলকাতার সাবেক মেয়র ও সিপিএম প্রার্থী বিকাশ ভট্টাচার্য, ডায়মন্ড হারবারে সিপিএম প্রার্থী ফুয়াদ হালিম, কলকাতা উত্তরে বিজেপির সাবেক রাজ্য সভাপতি রাহুল সিনহা, কলকাতা দক্ষিণে নেতাজির ভ্রাতুষ্পুত্র চন্দ্র কুমার বোস, জয়নগরে বাম প্রার্থী সুভাষ নস্কর প্রমুখ।

ভোটে জিতেছেন তৃণমূলের প্রার্থী অভিনেত্রী মিমি, নুসরাত ও অভিনেতা দেব। আরও জিতেছেন শতাব্দী রায় ও লকেট চট্টোপাধ্যায়। ছবি: ভাস্কর মুখার্জি
ভোটে জিতেছেন তৃণমূলের প্রার্থী অভিনেত্রী মিমি, নুসরাত ও অভিনেতা দেব। আরও জিতেছেন শতাব্দী রায় ও লকেট চট্টোপাধ্যায়। ছবি: ভাস্কর মুখার্জি

জয়ের পথে পাঁচ তারকা
তৃণমূল ও বিজেপির টিকিটে দাঁড়ানো ৬ অভিনেতা-অভিনেত্রীর মধ্যে জয়ী হয়েছেন ৫ জন। তাঁরা হলেন বীরভূমে তৃণমূলের শতাব্দী রায়, বসিরহাটে তৃণমূলের নুসরাত জাহান, যাদবপুরে তৃণমূলের মিমি চক্রবর্তী ও ঘাটালে তৃণমূলের প্রার্থী অভিনেতা দেব। তবে তৃণমূলের অন্য প্রার্থী মুনমুন সেন এবার হেরে যাচ্ছেন আসানসোলে বিজেপির তারকা প্রার্থী সংগীতশিল্পী বাবুল সুপ্রিয়র কাছে। বিজেপির অভিনেত্রী প্রার্থী লকেট চট্টোপাধ্যায় জিততে চলেছেন হুগলি আসন থেকে।

মমতার প্রতিক্রিয়া
পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির বিপুল উত্থান ও বহু আসনে বিজেপি এগিয়ে যাওয়ার পর টুইট করেছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দলকে চাঙা রাখতে এবং কর্মীদের মনোবল দৃঢ় রাখতে বিজয়ীদের অভিনন্দন জানিয়েছেন তিনি। বলেছেন, ‘সব পরাজিতরা পরাজিত নয়। এ নিয়ে আমাদের পর্যালোচনা করতে হবে। তারপর মত দেব। ভিভিপ্যাটের সঙ্গে ইভিএম মিলিয়ে গণনা পদ্ধতি আগে শেষ হতে দিন।’

আনন্দ উৎসব
ভোটের ফলাফল ঘোষণার পর রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় তৃণমূল ও বিজেপির সমর্থকেরা বিজয় আনন্দে মেতে ওঠেন। বিতরণ করেন মিষ্টি। আবির মেখে এবং নিজ নিজ দলের পতাকা নিয়ে আনন্দে মেতে ওঠেন তাঁরা। মমতার কালীঘাটের বাড়ির কাছে আনন্দে যেমন মেতে ওঠেন তৃণমূলের কর্মী–সমর্থকেরা, তেমনি কলকাতার বিজেপির সদর দপ্তরের সামনে চলে উৎসব। একে অপরকে জড়িয়ে ধরে শুভেচ্ছা বিনিময় ও মিষ্টিমুখ করানো হয়।