লকেটের আনন্দ আর মুনমুনের ক্ষোভ

লকেট চট্টোপাধ্যায়, মুনমুন সেন। ছবি: ভাস্কর মুখার্জি।
লকেট চট্টোপাধ্যায়, মুনমুন সেন। ছবি: ভাস্কর মুখার্জি।

ভারতের লোকসভা ভোটের মহাযজ্ঞ শেষ। গতকাল বৃহস্পতিবার ৫৪৩ আসনের এই লোকসভা ভোটের ফলও ঘোষিত হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে নরেন্দ্র মোদি আবার ক্ষমতায় ফিরে এলেন। পশ্চিমবঙ্গে এই মোদি ঝড়ে বিধ্বস্ত হয়েছেন তৃণমূল কংগ্রেসের নেত্রী মমতা ব্যানার্জি।

মমতার ঘনিষ্ঠজনেরা বলছেন, অহংকার, একনায়কতন্ত্র মনোভাব আর ভোটব্যাংক রক্ষা করতে গিয়ে নানা বেফাঁস মন্তব্য মমতাকে ডুবিয়ে দিয়েছে। মমতার কাছে এমনটা অপ্রত্যাশিত ছিল। মমতা ভেবেছিলেন, তাঁর রাজ্যের ৪২ আসনে একাই জিতে যাবেন। কিন্তু তাঁর দল জিতেছে ২২ আসনে। আর ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) পেয়েছে ১৮টি আসন।

মমতা রাজ্য থেকে পাঁচ চিত্রতারকাকে মনোনয়ন দেন। তাঁরা হলেন মুনমুন সেন, শতাব্দী রায়, দেব, মিমি চক্রবর্তী ও নুসরাত জাহান। মুনমুন সেন ছাড়া বাকি চারজন জিতেছেন। মুনমুন হেরে গেছেন বিজেপির প্রার্থী প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী বাবুল সুপ্রিয়র কাছে। বিজেপির প্রার্থী অভিনেত্রী লকেট চট্টোপাধ্যায় চিকিৎসক রতন দে নাগকে হারিয়েছেন। তিনি ছিলেন এই আসনের তৃণমূলের সাংসদ।

জয়ের পর লকেট চট্টোপাধ্যায় আনন্দ প্রকাশ করেছেন। তবে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মুনমুন সেন। লকেট চট্টোপাধ্যায় সাংবাদিকদের বলেন, প্রথম কাজ হবে সিঙ্গুরকে সন্ত্রাসমুক্ত করা। হুগলি আসনের মধ্যে সিঙ্গুর রয়েছে। ২০০৭ সালে সিঙ্গুরে টাটাকে সস্তার ন্যানো গাড়ি কারখানা নির্মাণের জন্য সাবেক বাম ফ্রন্ট সরকার ৯৯৭ একর জমি দিয়েছিল। এটা মেনে নিতে পারেননি মমতা। এরপরেই তিনি সিঙ্গুরের টাটার জন্য রাজ্য সরকারের অধিগৃহীত জমি চাষিদের ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলেন। সেই আন্দোলনের জেরে টাটা সিঙ্গুর ছেড়ে চলে যায় গুজরাটের সানন্দে। পরে মমতা উচ্চ আদালতের আদেশে সিঙ্গুরের জমি চাষিদের ফিরিয়ে দেন।

জয়ের পর লকেট চট্টোপাধ্যায় ঘোষণা দিয়েছেন, সিঙ্গুরের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মমতার উত্থান হয়েছিল। এই আন্দোলনের পথ ধরে ২০১১ সালে ক্ষমতায় এসেছিলেন মমতা। এবার এই সিঙ্গুর থেকে শুরু হবে মমতার পতনের আন্দোলনও।

লকেট চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘আমরা চাই, আবার এই সিঙ্গুরে টাটা ফিরে আসুক।’ তিনি পশ্চিমবঙ্গকে শিল্পসমৃদ্ধ করতে চান। তাই টাটাকে ফিরে আসার ডাক দিয়েছেন। বলেছেন, ‘আসুক টাটা এখানে, শিল্প গড়ুক এখানে।’

লকেট বলেছেন, এবার এই হুগলি আসনে ভোটাররা ভোটবাক্সে তৃণমূলের সন্ত্রাসের প্রতিবাদ করেছেন। তাই তাঁর প্রথম কাজ হবে সিঙ্গুরকে সন্ত্রাসমুক্ত করা। এই আসনে ২০০৯ ও ২০১৪ সালে সাংসদ হন তৃণমূলের রতন দে নাগ। ২০০৪ সালে এই আসনে সিপিএমের পোড় খাওয়া নেতা রূপচাঁদ পালকে পরাজিত করে অপ্রত্যাশিত ফল করেছিল তৃণমূল। এবার ২০১৯ সালে রতন দে নাগকে পরাজিত করে আবার অপ্রত্যাশিত ফল পেয়েছেন বিজেপির প্রার্থী লকেট চট্টোপাধ্যায়।

আরেক অভিনেত্রী মুনমুন সেন এবার আসানসোল আসনে তৃণমূলের টিকিটে লড়ে বিজেপির প্রার্থী প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী বাবুল সুপ্রিয়র কাছে হেরে যান। মুনমুন সেন ২০১৪ সালের নির্বাচনে প্রথম তৃণমূলের টিকিটে বাঁকুড়া আসনে লড়েন। সেখানে তিনি সিপিএমের প্রখ্যাত নেতা এবং দীর্ঘদিনের সাংসদ বাসুদেব আচারিয়াকে পরাজিত করে সাংসদ হন। এবার মমতা তাঁকে আসানসোল আসনে টিকিট দিয়েছেন। বাঁকুড়ায় রাজ্যের মন্ত্রী সুব্রত মুখার্জিকে প্রার্থী করেছেন। সেখানে অবশ্য সুব্রত মুখার্জি বিজেপি প্রার্থীর কাছে হেরে গিয়েছেন।

তবে পরাজয় মানতে পারেননি মুনমুন সেন। রোববার বুথ ফেরত সমীক্ষায় জয়ের ইঙ্গিত দিলে মুনমুন সেন ভোট গণনার আগের দিন বুধবার চলে যান আসানসোলে। গতকাল বৃহস্পতিবার তিনি আসানসোলের গণনা কেন্দ্রে উপস্থিত থাকেন। কিন্তু বিকেলের দিকে যখন তিনি বুঝতে পারেন তাঁর জয়ের আশা ক্রমে বিলীন হয়ে যাচ্ছে, তখনই তিনি তাঁর মেয়েদের কথায় আসানসোল ছেড়ে কলকাতায় ফিরে আসেন।

মুনমুন সেন এতটাই আঘাত পেয়েছেন যে তিনি সাংবাদিকদের কাছে রাজনীতি থেকে বিদায় নেওয়ার কথাও বলেছেন। এই পরাজয়ের জন্য দোষ চাপিয়েছেন তৃণমূলের নিচুতলার নেতা–কর্মীদের ওপর। বলেছেন, ‘ওরাই আমাকে হারিয়ে দিয়েছে। ওরা ভালো নয়। এরপর আমায় ডাকলে আর পাবে না। বিদায় নেব রাজনীতি থেকে।’ বলেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকেই তিনি তৃণমূলে গিয়েছিলেন। সাংসদও হয়েছিলেন। এবার মমতা বন্দ্যোপধ্যায়কে বলবেন, দলকে ঢেলে সাজাতে। তিনি একাই লড়ে যাচ্ছেন! দলের নিচুতলার মানুষগুলো ভালো নয়!