পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির উত্থানের মূল মসলা কী

মোদি-শাহ জুটির ক্যারিশমায় পশ্চিমবঙ্গে এত ভালো ফল করেছে ক্ষমতাসীন দল বিজেপি।
মোদি-শাহ জুটির ক্যারিশমায় পশ্চিমবঙ্গে এত ভালো ফল করেছে ক্ষমতাসীন দল বিজেপি।

ভারতের লোকসভার নির্বাচনে কোন দল জিতছে, তখন সেটা প্রায় নিশ্চিত। টেলিভিশনের পর্দায় দেখানো ভারতের মানচিত্র তখন ভরে উঠছে গেরুয়া রঙে। গতকাল বৃহস্পতিবার এই জনরায়ের ফল দেওয়ার সময় গণমাধ্যম ব্যস্ত নানা বিশ্লেষণ, পর্যালোচনা নিয়ে। একসময়ের বাম দুর্গ পশ্চিমবঙ্গে গেরুয়া–ঝড়ের লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তখন এনডিটিভিতে এসে পশ্চিমবঙ্গের প্রবীণ তৃণমূল নেতা ও সম্পাদক চন্দন মিত্র বললেন, ‘বিজেপি ইজ এ গভর্নমেন্ট ইন ওয়েটিং।’ অর্থাৎ, বিজেপি মনে হয় আগামী দিনে পশ্চিমবঙ্গে সরকার গড়তে চলেছে।

পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভার নির্বাচন হতে আরও দুই বছর বাকি। এর মধ্যে রাজনীতির গতিপ্রকৃতি অনেক পরিবর্তন হবে, সন্দেহ নেই। তবে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির উত্থানের যে গতি, তাতে চন্দন মিত্রের ধারণাকে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আমরা জেনে গেছি, পশ্চিমবঙ্গে লোকসভার ৪২টি আসনের মধ্যে ১৮টি পেয়েছে বিজেপি। গত লোকসভায় দলটি পেয়েছিল মাত্র ২টি আসন। আর ৪২টির মধ্যে সবকটি আসন পাবেন বলে যে হুংকার ছেড়েছিলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ও তৃণমূলপ্রধান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তা কার্যত অসাড় হলো। লোকসভায় মোট ভোটের ৪৩ শতাংশ পেয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। আর ঘাড়ের কাছে শ্বাস ফেলা বিজেপি ৪০ শতাংশ।

এটুকুই শেষ নয়। কাল লোকসভার পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার ৮ আসনের ফল বেরোয়। এখানে কিন্তু বিজেপি ছাড়িয়ে গেছে শাসকদের। ৪টিতে জিতেছে তারা। ৩টি তৃণমূলের, ১টি আসন কংগ্রেসের। পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভার মোট আসন ২৯৪টি। লোকসভা ভোট অনুযায়ী এর মধ্যে ১২৯টি আসনে বিজয়ী হয়েছে বিজেপি। ১৫৮টিতে জিতেছে তৃণমূল। ২০১৬ সালে এ রাজ্যের সর্বশেষ বিধানসভা নির্বাচনের তুলনায় এবারের লোকসভায় তৃণমূলের ভোট কমেছে মাত্র ২ শতাংশ। কিন্তু বিজেপির ভোট বেড়েছে ৩০ শতাংশ। এ রাজ্য গেরুয়া বাহিনীর দখলে যাওয়ার লক্ষণ তো তবে স্পষ্ট!

কিন্তু কেন এমন হলো? ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গে অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিই ক্ষমতায় থেকেছে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭৭ কংগ্রেস (মাঝে দু–বছর অকংগ্রেস সরকার),  এরপর ৩৪ বছর ধরে বাম শাসন। পরে তৃণমূল কংগ্রেস এসে তার ক্ষমতার দ্বিতীয় মেয়াদ পার করছে। তৃণমূল সরকারও সংখ্যালঘু-বান্ধব হিসেবেই পরিচিত। বিজেপি তৃণমূলের এই নীতিকে ‘সংখ্যালঘু তোষণ’ বলে কটাক্ষও করে। আজ বিজেপির এই উত্থান নিছক সাম্প্রদায়িক ভেদনীতির বহিঃপ্রকাশ? আর কিছুই নেই? বিজেপির উত্থানের পেছনে এমন সরল সমীকরণ টানা বোধকরি সংগত নয়। কারণ ভোটের ফলাফল বলছে ভিন্ন কথা।

লোকসভার এবারের ভোটে বিজেপি ভালো করেছে গ্রামাঞ্চলে। এ রাজ্যে বামদের উত্থানের জায়গাই ছিল এই গ্রাম। আর বামদের হটাতে তৃণমূলের মূল শক্তি ছিল শহরাঞ্চলের মানুষের ভোট। এ কথা সহজেই বলা যায়, তৃণমূলের ভোটে খুব বেশি হেরফের হয়নি। কিন্তু গেরুয়া ঝড়ে একেবারে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে বামদূর্গ। এবারের লোকসভায় বামেরা একটি আসনও পায়নি। এবার তাদের ভাগ্যে ভোট পড়েছে প্রায় ৮ শতাংশ। আগের বিধানসভার নির্বাচনের চেয়ে এ সংখ্যা ২২ শতাংশ কম। ৪২টি আসনের মধ্যে ৪১টিতেই জামানত হারিয়েছে বামেরা। ১৯৬৪ সালে সিপিএম প্রতিষ্ঠার পর এত খারাপ অবস্থা আর হয়নি। সিপিএম নেতা সূর্যকান্ত মিশ্র এ ফলকে বলেছেন, ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’। সিপিএম বা বামেদের এই ভোট কোথায় গেছে, তা মোটামুটি একটা ধারণা করা যায়।

বাম বলয় থেকে ভোটার শ্রেণির এই অক্ষ পরিবর্তন কী গেরুয়া হাওয়ারই ফল? পুরোপুরি হয়তো নয়। যদি বলা হয়, ক্ষমতাসীন তৃণমূলের মাস্তানি এবং জনরায়কে অগ্রাহ্য করার জবাব দিয়েছে মানুষ? উদাহরণ দিয়ে বলি। পশ্চিমবঙ্গে গেল বছরের পঞ্চায়েত (স্থানীয় সরকারের নিম্নতম কাঠামো) নির্বাচনে চতুর্দিকে ছিল তৃণমূলের ‘জয়জয়কার’। রাজ্যের বিরাট অংশে তৃণমূল জিতেছে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। কাউকে দাঁড়াতেই দেয়নি। এক প্রহসনে পরিণত হয়েছিল নির্বাচন। এখনো স্মরণ করতে পারি তৃণমূলের বীরভূম জেলার ‘বিখ্যাত’ সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের কথা। ওই নির্বাচনের আগে পশ্চিমবঙ্গের বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার ডটকমকে দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন ‘কেষ্টদা’ নামে অধিক পরিচিত এই নেতা। অনুব্রত মণ্ডল হাসতে হাসতে বলছিলেন, তাঁর এলাকায় পঞ্চায়েতের কোনো ভোট নেই। যে দু-একজন মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন, ‘মনের কষ্টে’ তাঁরা তা তুলে নিয়েছেন। যাঁরা এখনো তোলেননি, তারাও মনঃকষ্টে আছেন। শিগগিরই তুলে নেবেন। অনুব্রত নির্বাচনে মানুষকে ‘গুড়-বাতাসা’ খাওয়াবেন। বাজাবেন জয়ঢাক। সেই ঢাকের শব্দে সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি নির্বাচন করতে না পারার কষ্ট চাপা পড়ে গেছে। সেই কষ্ট কেষ্টদারা বুঝেও বোঝেননি। মজা করেছেন, মানুষকে হেয় করেছেন। অনুব্রত মণ্ডল পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূলীয় রাজনীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। রাজ্যের মানুষ দাঁতে দাঁত চেপে এসব অনায্যতা সহ্য করে গেছেন। কিন্তু এবার তাঁরা সুযোগ পেয়েছিলেন। নির্বাচনের আগে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন, নির্বাচন কমিশনের বাড়তি নজরদারিতে ভোট না দিতে পারা মানুষেরা জবাব দিয়েছেন। তাঁরা ক্ষয়িষ্ণু বাম শক্তিকে সহায়ক মনে করেনি। আশ্রয় খুঁজেছে বিজেপিতে। সাত দফায় নির্বাচন করার ফলে নজরদারি করা গেছে ভালোভাবে। তাই ভোটের আগে এই গরমেও গুড়–বাতাসা তেমন জমেনি। মজার ঘটনা হলো, যেসব জায়গায় তৃণমূল গতবার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছিল, এবার সেগুলো গেছে বিজেপির দখলে। একসময়ের বাম বলয় কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, বালুরঘাটে বিজেপি ভালো করেছে। জিতেছে বাঁকুড়া, বিষ্ণুপুর, রানাঘাট, বর্ধমান, হুগলি, মেদিনীপুরের একাধিক আসনে। এসব এলাকায় পঞ্চায়েতে ভোট করতে দেয়নি তৃণমূল।

ভোটের নামে প্রহসন ও মাস্তানতন্ত্রের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে ছড়িয়েছে ধর্মীয় উসকানি। রাজ্যে সংখ্যালঘু ভোট প্রায় ৩০ শতাংশ। এর বড় অংশ তৃণমূলের পক্ষেই যায়। সংখ্যালঘু ভোট পেতে মমতা বা যে কেউ, যেকোনো কৌশল নিতেই পারেন। তবে সংখ্যালঘুদের নিয়ে তৃণমূলের এই নীতিকে বিজেপি ব্যবহার করেছে। আর সেটাতে সফলও হয়েছে। এই যেমন, ইমামদের ভাতা দেওয়া হয়। কিন্তু রাজ্যের মন্দিরের পুরোহিতেরা কোনো ভাতা পান না। এসব নানা কথা বলা হয়েছে। এতে সত্য–মিথ্যার মিশেল আছে। তবে বাস্তবতা হলো, বিজেপি এর সফল ব্যবহার করেছে।

সাম্প্রদায়িকতার ব্যবহারের আরও কিছু উদাহরণ আছে। এবারে নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহ যেসব সভা করেছেন পশ্চিমবঙ্গে, সেখানে বারবার ফিরে এসেছে তথাকথিত অনুপ্রবেশকারী, নাগরিক নিবন্ধনের (এনআরসি) মতো বিষয়গুলো। মোদি বারবার বলেছেন, হিন্দু শরণার্থীদের নাগরিকত্বের প্রশ্নে তিনি কী কী করেছেন। রাজ্যের বেকারত্ব, শিক্ষা—এসব বিষয় উপেক্ষিতই ছিল তাঁদের মুখে। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আগে ও পরে বিভিন্ন সময়ে এখান থেকে যাওয়া একটি বিশাল গোষ্ঠীর বসবাস যে পশ্চিমবঙ্গে, সেখানে এসব কথা কিছু কাজ যে দিয়েছে, তা বলা বাহুল্য। ওপরে জাতীয়তা আর ভেতরে সাম্প্রদায়িকতা ভরা এসব ইস্যুর কোনো জুঁতসই জবাব দিতে পারেননি। আর ব্যর্থ হয়েছেন, সংঘ পরিবারের জোর বুঝতে। সাংগঠনিকভাবে বিজেপি এখনো পশ্চিমবঙ্গে তাদের ডালপালা বিস্তার করতে পারেননি। কিন্তু কয়েক দশক ধরে আরএসএসের গোপন এবং সুসংগঠিত তৎপরতা চলছে পশ্চিমবঙ্গে। সহায়ক শক্তি হিসেবে তারা বিজেপিকে সহায়তা করেছে। তৃণমূলের একাধিক নেতা গণমাধ্যমের কাছে স্বীকার করেছেন, সংঘের মতো ‘প্রশিক্ষিত’ কর্মী তাঁদের নেই। যেসব নেতা-কর্মী আছেন, তাঁদের অনেককে নিয়ে সাধারণ মানুষের প্রশ্ন আছে।

৩৪ বছর ধরে চলা বাম অচলায়তন ভাঙতে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের বিকল্প হয়ে উঠেছিল তৃণমূল। বামদের প্রতি মানুষের বিতৃষ্ণার ফসল ছিল তৃণমূলের বিজয়। তৃণমূল জোয়ারে দলটিতে নানা দল-মত থেকে নেতা-কর্মী এসে জুটেছে। এসব নেতা-কর্মীর অনেকের আচরণ এখন সাধারণ মানুষ অপছন্দ করতে শুরু করেছেন।

এ ছাড়া বিজেপির শক্তিশালী তথ্যপ্রযুক্তি বাহিনী এবার পশ্চিমবঙ্গে গেরুয়া বাহিনীর জয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে। এর তুলনায় তৃণমূল ছিল ম্রিয়মাণ। এবার পশ্চিমবঙ্গে নরেন্দ্র মোদি যত সভা করেছেন, তত সভা কোনো রাজ্যেই করেননি। পশ্চিমবঙ্গে যে তাদের বড় লক্ষ্য ছিল, তা স্পষ্ট। এই ক্ষুরধার প্রচারণার ফল পেয়েছে বিজেপি। গতকাল দিল্লিতে বিজেপির সদর দপ্তরের সামনে সন্ধ্যার বিজয় সমাবেশে বার কয়েক এ বাক্যটি উচ্চারণ করেন অমিত শাহ। সেটি হলো ‘বাঙ্গাল কি অন্দর।’ জয়ী সমর্থকের হর্ষধ্বনির মধ্যে শাহর বাকি কথাগুলো হারিয়ে গেছে। আর কী বলতে চেয়েছেন বোঝা যায়নি। শাহর কথা অশ্রুত থাকলেও এটি তো নিশ্চিত, বাংলার আরও অন্দরে ঢুকতে মোদি-শাহের চেষ্টা চলবেই। সেই চাপ তৃণমূল কীভাবে সামলায়, সেটাই এখন দেখার বিষয়।