কট্টরবাদীদের উত্থান থামাল ইউরোপীয় জনগণ

২৩ থেকে ২৬ মে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ছবি: সংগৃহীত
২৩ থেকে ২৬ মে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ছবি: সংগৃহীত

বিশ্বের একমাত্র উপমহাদেশীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী ও বর্ণবাদী কট্টরপন্থী দলগুলোকে প্রত্যাখ্যান করেছে ইউরোপের জনগণ। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন জোটে নানা সংকট ও কট্টরবাদী দলগুলোর আস্ফালনের মুখে নবম ইইউ পার্লামেন্ট নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী ও বর্ণবাদী কট্টরপন্থী দলগুলো বিশাল জয়ের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। এবারের ইইউ পার্লামেন্ট নির্বাচনে ভালো করেছ পরিবেশবাদী সবুজ দল।

চার দিন আগে শুরু হওয়া (২৩ থেকে ২৬ মে) ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচন গতকাল রোববার রাতে শেষ হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার প্রথম দিন যুক্তরাজ্য ও হল্যান্ডে নির্বাচন হয়। শুক্র ও শনিবার কিছু দেশে নির্বাচন হয়। তবে অধিকাংশ সদস্য দেশে গতকাল রোববার নির্বাচন শেষ হয়েছে। ইতালিতে স্থানীয় সময় রাত ১১টায় ইইউ পার্লামেন্ট নির্বাচনের ভোট বুথ বন্ধ হয়।

ইইউ জোটের ২৮ সদস্য দেশের ভিন্ন ভিন্ন নির্বাচন নিয়মের রেওয়াজ অনুযায়ী ভোট গ্রহণ করা হয়। এবারের নির্বাচনে ৬১ শতাংশ ভোটার অংশ নেয়, যা গত ২৫ বছরের মধ্য রেকর্ড। ৪০ কোটি জনগণ সরাসরি ভোটে পাঁচ বছরের জন্য তাঁদের ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রতিনিধিদের নির্বাচিত করেছেন।

নবম ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নির্বাচনকে ঘিরে কয়েক মাস ধরেই আলোচনা চলছিল। সবার মনেই এক প্রশ্ন, কে হতে যাচ্ছেন ইউরোপীয় রাজনীতির নিয়ন্ত্রক।

৭৫১ আসনবিশিষ্ট ইইউ পার্লামেন্ট নির্বাচনে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত সর্বোচ্চ ১৭৩টি আসন পেয়েছে ইউরোপের ক্রিশ্চিয়ান গণতান্ত্রিক ধারার জোট। এর পরে ১৪৭টি আসন পেয়েছে সামাজিক গণতান্ত্রিকদের জোট। লিবারেল গণতান্ত্রিক জোট পেয়েছে ১০২টি আসন। পরিবেশবাদী সবুজ দলের জোট ৭১, বামপন্থী দলগুলোর জোট ৪১, ইইউবিরোধী ডানপন্থীরা ৫৬ ও জোটবিহীন দলগুলো পেয়েছে ৮টি আসন।

ইউরোপের ক্রিশ্চিয়ান গণতান্ত্রিক ধারার জোট এবং সামাজিক গণতান্ত্রিকদের জোট ইইউ পার্লামেন্টে প্রথম ও দ্বিতীয় অবস্থানে রইলেও উভয় জোট পাঁচ বছর আগের তুলনায় কম ভোট পেয়েছে। সেদিক থেকে নতুন প্রজন্মের ভোটারদের ভোটে জলবায়ু ও পরিবেশবাদী সবুজ দলটির জোট পাঁচ বছর আগের তুলনায় ভালো করেছে।

২০১৬ সালের জুনে ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) যুক্তরাজ্যের থাকা না থাকা নিয়ে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিচ্ছেদের পক্ষে রায় দেন ব্রিটিশরা। এরপর দুই বছর পার হলেও ইইউ জোট ছেড়ে যাওয়ার কৌশল বা ব্রেক্সিট নিয়ে উভয় পক্ষ কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেনি। এ ছাড়া ইউরোপের নানা দেশে কট্টর জাতীয়তাবাদীদের আস্ফালন ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ইইউ জোটবিরোধী নানা বিবৃতি ইইউ জোটকে সংকটের মুখে ঠেলে দেয়।

ইইউ পার্লামেন্ট নির্বাচনের দুই সপ্তাহ আগে জার্মানির দুটি পত্রিকার অনলাইনে অস্ট্রিয়ার দুই ক্ষমতাসীন কট্টরবাদী রাজনীতিকদের কেলেঙ্কারিপূর্ণ ভিডিও প্রকাশ পায়। অস্ট্রিয়ায় ২০১৭ সালে নির্বাচনের আগে অবৈধ রাশিয়ান পুঁজি ব্যবহার করতে দেওয়ার কথোপকথনের একটি ভিডিও প্রকাশিত হওয়ার পর ক্ষমতাসীন অস্ট্রিয়ার জোট সরকারের ওপর চাপ বেড়ে যায়। জার্মানির দুটি স্বনামধন্য পত্রিকা ডের স্পিগেল ও সুদ ডয়েচে জাইটুং গোপনে ধারণ করা ভিডিওটি তাদের অনলাইন সংস্করণে খবরসহ প্রকাশ করে। অবৈধ রাশিয়ান পুঁজি অস্ট্রিয়াতে ব্যবহার করতে দেওয়ার এই ভিডিও প্রকাশ হওয়ার পর অস্ট্রিয়ার কট্টরবাদী ফ্রিডম পার্টির প্রধান ও দেশটির সহকারী চ্যান্সেলর হাইঞ্জ ক্রিস্টিয়ান স্ট্রাখে পদত্যাগ করেন। এই ঘটনা প্রকাশ হওয়ার পর ধারণা করা হচ্ছিল, ইইউ জোটকে অস্থিতিশীল করার জন্য রাশিয়া ইউরোপের কট্টর জাতীয়তাবাদী দলগুলোর শক্তি বাড়ানোর স্বার্থে অর্থায়ন করেছে।

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ অভিযোগ করেন, কয়েকটি বিদেশি শক্তি ইইউ জোটে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করছে। ইইউবিরোধী ষড়যন্ত্রের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক সচিব ডোনাল্ড ট্রাম্পের উপদেষ্টা স্টিভ ব্যাননের দিকেও অভিযোগের তির ছোড়েন তিনি। ফ্রান্সের জাতীয়তাবাদী দল ন্যাশনাল ফ্রন্ট নেত্রী মেরিন লে পেন এবং ইতালির জাতীয়তাবাদী দল লেগা নর্ড দলের নেতা মাটেয়ো সালভানির সঙ্গে রাশিয়ার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের বিষয়েও অভিযোগ করেন মাখোঁ।

নির্বাচনে ইউরোপের কট্টর ও জাতীয়তাবাদী দলগুলো তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী ভোট না পেলেও ফ্রান্সের মেরিন লে পেন ও এমানুয়েল মাখোঁ বেশি ভোট পেয়েছেন।

ইউরোপীয় ইউনিয়নে তিনটি প্রধান প্রতিষ্ঠানের মধ্য ইউরোপীয় পার্লামেন্ট অন্যতম। এ ছাড়া রয়েছে ইউরোপিয়ান কমিশন ও ইউরোপীয় কাউন্সিল। ইউরোপীয় পার্লামেন্ট বা পার্লামেন্টের সদস্যরা মূলত জোটভুক্ত দেশগুলোর জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে। জোটের বিভিন্ন বিষয়ে আইনপ্রণেতা হিসেবে কাজ করে। জোটের বাজেটের ক্ষেত্রেও ইইউ পার্লামেন্টে সম্মতির প্রয়োজন হয়। ইইউ পার্লামেন্টের সদস্যরাই পছন্দমতো ভোট দিয়ে পাঁচ বছরের জন্য ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেন।

এবারের ইইউ পার্লামেন্ট নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগে ইউরোপের বিভিন্ন শহরে হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভ করেন। ইউরোপের জাতীয়তাবাদী শক্তিকে রুখে দেওয়ার ডাক দেন তাঁরা। জার্মানির বিভিন্ন শহরে ১৫০ সংগঠনের ডাকে দেড় লাখ মানুষ বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। অন্যদিকে, ইতালির মিলান শহরে ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদী দলের নেতারা ভোট দেওয়ার জন্য একযোগে আহ্বান জানান।