পরিবর্তন আনছেন ব্রাজিলের নারীরা

ব্রাজিলের ফাঙ্কসংগীতজগতের অন্যতম পুরোধা আরেথা ফ্রাঙ্কলিন। ছবি: বিবিসি।
ব্রাজিলের ফাঙ্কসংগীতজগতের অন্যতম পুরোধা আরেথা ফ্রাঙ্কলিন। ছবি: বিবিসি।

লাতিন আমেরিকার দেশ ব্রাজিলে নারীরা এখনো উপেক্ষিত। এখানকার গানের কথায় বোঝানো হয়, নারীর জন্মই হয়েছে পুরুষের ‘সেবা’ করার জন্য। যে গান দিয়ে তাঁদের ছোট করা হয়, যে গানকে পুরুষের নিজস্ব সম্পদ বলে মনে করা হয়, সে গান দিয়েই এবার নিজেদের অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে নেমেছেন ব্রাজিলের নারীরা।

ক্যারোলিনা ডি অলিভেরা ‘নারীবাদ’ শব্দটি প্রথমবার শুনেছিলেন ২০১৫ সালে। কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেওয়া বন্ধুরা শব্দটির সঙ্গে তাঁকে পরিচিত করিয়েছিলেন। সেখান থেকে তাঁর মনে জন্ম নেয় নানা প্রশ্ন। বয়স তাঁর তখন মাত্র ২২। রিও ডি জেনিরোর বিখ্যাত র‍্যাপসংগীত ক্যারিওকা ফাঙ্কজগতের উঠতি তারকা তিনি। ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে জানা যায়, হিপহপ সংগীতে র‍্যাপার ক্যারোল নামে পরিচিতি পান ক্যারোলিনা ডি অলিভেরা।

বছরখানেক পরে ‘১০০% ফেমিনিস্তা’ শিরোনামে একটি গান মুক্তি দেন ক্যারোল। সে গানের কথায় ফুটে উঠেছে তাঁর দুঃসহ শৈশবের কথা। র‍্যাপের তালে তালে বলেছিলেন, ‘মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই বুঝেছিলাম, খাবার না বানালে নারীদের মার খেতে হয়।’ দারুণ জনপ্রিয় হয় গানটি। কিন্তু সেই গানের কথাও তাঁর সাজসজ্জা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নোংরা মন্তব্য থামাতে পারেনি। নিজেকে কৃষ্ণাঙ্গ এবং স্থূল দাবি করা ক্যারোল বলেন, ‘কেবল ফাঙ্ক গান গাওয়া নারী হওয়াই কষ্টসাধ্য নয়, বরং একজন নারী হওয়াই কঠিন।’

আমেরিকান হিপহপ থেকে তৈরি হওয়া ফাঙ্কসংগীতের গায়ক মূলত ছেলেরাই। সমালোচকদের দাবি, এসব গানের কথায় নারীবিদ্বেষ, বিশৃঙ্খলা এবং অপরাধকে উসকানি দেওয়া হয়। ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানের তথ্যানুযায়ী, কান ফাটানো আওয়াজে উদ্দাম নৃত্যের তালে তালে গাওয়া ফাঙ্কসংগীত জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর—এই মর্মে ২০১৭ সালে প্রায় ২০ হাজার ব্রাজিলিয়ান কংগ্রেসে একটি আবেদনপত্রে স্বাক্ষর করেন। তবে এ বিষয়ে আইনসভা কোনো পদক্ষেপ নিতে অস্বীকৃতি জানায়।

র‍্যাপার এমসি (অনুষ্ঠানের ওস্তাদ বা মাস্টার অব সিরিমনি) ক্যারোল এবং তাঁর মতো অন্যান্য নারীবাদী ফাঙ্কসংগীতশিল্পী গানের স্টাইলে পরিবর্তন আনার ওপর প্রাধান্য দিচ্ছেন না। বরং গানটিকে নারীদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নতুন আঙ্গিকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছেন তাঁরা। ক্যারোলরা নতুন করে ‘পুতারিয়া’ গাওয়া শুরু করেছেন। যৌনতা নিয়ে লেখা নিষিদ্ধ গানের একটি শাখা পুতারিয়া। এ ধারার কিছু গানে প্রকাশ্যে উঠে এসেছে নারীবাদ।

এই ধারার একটি গান ‘এন ও সৌ ওব্রিগাদা’ (আমি করতে চাই না) স্পটিফাইয়ের বৈশ্বিকভাবে ভাইরাল হওয়া শীর্ষ ৫০টি গানের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। এই গানের ভিডিওতে এমসি পোকাহোন্তাস মাদকাসক্ত ছেলেবন্ধুকে তাঁর ওপর কর্তৃত্ব জাহির করতে চাওয়ায় ভর্ৎসনা করেন। ২০১৮ সালের আরেকটি জনপ্রিয় পুতারিয়া ‘চাই দে বোকা’ (মুখ বন্ধ রাখো) গানে এমসি রেবেকা নারীদের যৌনসুখে পুরুষের ভূমিকার কথা বলেছেন। যে পৃথিবীতে নারীকে এখনো যৌনদাসী বলে বিবেচনা করা হয়, সেখানে নারীর যৌন স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলেছেন তিনি।

সাও পাওলোতে নারী শিল্পীদের প্রশিক্ষণ দেয় ‘লিগা দা ফাঙ্ক’ নামে একটি দল। এই দলের সদস্য আন্দ্রেসা অলিভিয়েরা বলেন, নারী ফাঙ্কসংগীতশিল্পীদের হাত ধরে নতুন করে প্রাণ ফিরে পাচ্ছে ফাঙ্কের শাখা ‘বিবেকবান ফাঙ্ক’। সামাজিক ইস্যু নিয়ে ভীষণভাবে রক্ষণশীল ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জাইর বোলসোনারোর বিপরীতে শক্তি সঞ্চয় করছে গানগুলো। টুইটারে উভয় লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ দেখানো এমসি রেবেকা একটি গানের মিউজিক ভিডিওতে রংধনু পতাকায় জড়িয়েছেন নিজেকে। এ সব গান দেদার শুনছেন নারীরা। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ইউটিউবের ১৩০টি ফাঙ্ক চ্যানেলের ৪৯ দশমিক ৫ শতাংশ দর্শক নারী। ২০১৪ সালের হিসাব অনুযায়ী তা ছিল মাত্র ৩২ শতাংশ।

নারী তারকাদের হাত ধরে ব্রাজিলের ফাঙ্ক এখন বৈশ্বিক আবেদন সৃষ্টি করেছে। ফাঙ্ক গানের জগতে প্রবেশ করে ল্যারিসা মাকাদোর ইনস্টাগ্রাম অনুসারীর সংখ্যা প্রায় ৩৭ মিলিয়ন, বেশির ভাগ অনুসারীই বাইরের দেশের নাগরিক। ক্যামিলিয়া ফিয়ালহোর মার্কেটিং কোম্পানি কেটুএলের হাত ধরে ল্যারিসার সংগীতজীবন ক্রমেই উন্নতির দিকে ধাবিত হয়। নিজের সাফল্যকে তিনি বিয়ন্স এবং রিয়ানার সঙ্গে তুলনা করেন। রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় এই নারীরা যৌনক্ষমতাকে প্রাধান্য দিয়েছেন।

ক্যামিলিয়ার কোম্পানি এখন এমসি রেবেকাকে অন্যান্য জিনিসের পাশাপাশি ইংরেজি ভাষা শেখাচ্ছে। যৌনতার মতো বিষয় থেকে তরুণ ফাঙ্কেরাদের দূরে থাকতে নিষেধ করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘ভদ্র গান শুনতে চাইলে ক্ল্যাসিক গান শোনো।’