বার্লিনে বিশ্বসংস্কৃতির মহা মিছিল

বার্লিনের রাস্তায় বিশ্ব সংস্কৃতির মহা মিছিলে বাঙালিদের সঙ্গে নেচেছে জার্মানরাও। ছবি: সরাফ আহমেদ
বার্লিনের রাস্তায় বিশ্ব সংস্কৃতির মহা মিছিলে বাঙালিদের সঙ্গে নেচেছে জার্মানরাও। ছবি: সরাফ আহমেদ

রোববার ৯ জুন বার্লিনের আকাশ ছিল ঝকমকে নীল, তাপমাত্রা ছিল ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এত চমৎকার রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়া ১৬ ঘণ্টা পাওয়া রীতিমতো ভাগ্যের ব্যাপার! এবার বার্লিনের আকাশটা জানান দিল, যেন প্রকৃতিও আছে জার্মানিতে বসবাসকারী নানা দেশের সংস্কৃতি ও তাদের ধারকদের সঙ্গে।

এ নিয়ে ২৪ বছরে পড়ল বার্লিনের আন্তসংস্কৃতি কার্নিভ্যাল। জার্মান ভাষায় পোশাকি নাম ‘কার্নিভ্যাল ডের কলটুর’। শুরুটা ছিল ১৯৯৬ সালে জার্মানিতে বসবাসরত বিদেশিদের প্রতি বিদ্বেষের বিরুদ্ধে সংস্কৃতি দিয়ে প্রতীকী প্রতিবাদ। সেই প্রতিবাদী সংস্কৃতির মিছিল এখন বিশ্বসংস্কৃতির মহা মিছিলে পরিণত হয়েছে। তবে সেই প্রতীকী প্রতিবাদের আবেদন এখনো ফুরিয়ে যায়নি বরং বেড়েছে। জার্মান তথা ইউরোপে অভিবাসী বিরোধী জাতীয়তাবাদী কট্টরপন্থীদের রুখতে তাই বিশ্বসংস্কৃতির মহা মিছিল আরও উচ্চকিত হয়েছে।

বার্লিনের রাস্তায় বিশ্ব সংস্কৃতির মহা মিছিলে বাংলাদেশের সগৌরব উপস্থিতি। ছবি: সরাফ আহমেদ
বার্লিনের রাস্তায় বিশ্ব সংস্কৃতির মহা মিছিলে বাংলাদেশের সগৌরব উপস্থিতি। ছবি: সরাফ আহমেদ

রোববার পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নানা জাতির ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির মিলন মেলায় পরিণত হয়েছে বার্লিনের রাজপথ। দক্ষিণ ইউরোপের ব্রাজিল, পেরু, বলিভিয়ার অংশগ্রহণকারীরা, আছে আফ্রিকার নানা দেশ এবং ক্যারিবিয়ান দেশসমূহের প্রতিনিধিরা আর আছে এশিয়ার নানা দেশের সাংস্কৃতিক দলসমূহ।

এই মহা মিছিলে ছিল বাংলাদেশিরাও। সঙ্গে ছিল বাঙালিদের শুভানুধ্যায়ী জার্মানরা। চমৎকার আবহাওয়ায় নীল আকাশের নিচে প্রতিবছরের মতো এবারও বার্লিন শহরের প্রাণকেন্দ্র ক্রয়েজবার্গের ইয়র্ক সড়ক থেকে ছয় কিলোমিটার রাস্তাজুড়ে যেন বিশ্ব সংস্কৃতির মেলা বসেছিল। এশিয়া তথা বাঙালি জাতিসত্তার অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক ধারণা ও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেই বাঙালিদের এই উদ্যোগ। জার্মান প্রবাসী বাঙালিরা দীর্ঘদিন থেকেই এই মহাযাত্রার অন্যতম শরিক। আর এবারের যাত্রায় বাঙালিদের মূল বিষয় ছিল, ধর্মীয় মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে দক্ষিণ এশিয়া। সেই ২০০২ সাল থেকেই প্রবাসী বাঙালিরা, বার্লিনের বিশ্ব সংস্কৃতির মহাযাত্রার সহযাত্রী হয়েছেন।

সংস্কৃতির মহা মিছিলে অংশ নিতে বার্লিন আর সারা জার্মানি থেকে অংশ নিয়েছে বাঙালি অভিবাসীরা। ছবি: সরাফ আহমেদ
সংস্কৃতির মহা মিছিলে অংশ নিতে বার্লিন আর সারা জার্মানি থেকে অংশ নিয়েছে বাঙালি অভিবাসীরা। ছবি: সরাফ আহমেদ

বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের বর্ণাঢ্য জমকালো পোশাক আর গানবাজনার তালে বার্লিন হয়ে উঠেছিল ছন্দময়, বর্ণিল। ছয় কিলোমিটার রাস্তার দুই পাশে তাই নেমেছিল প্রায় আট লাখ মানুষের ঢল। তারা একাত্ব হয়েছেন পৃথিবীর নানা জাতির সংস্কৃতির পরিবেশনার মাধ্যমে ধর্ম, বর্ণবাদের বিরুদ্ধে প্রতীকী প্রতিবাদে।
নানা সংস্কৃতির ৭৪টি দলের প্রায় সাড়ে ৪ হাজার অংশগ্রহণকারী তাদের নিজ নিজ সংস্কৃতি স্বকীয়তা নিয়ে জয় করেছে বার্লিনের রাজপথ। এবার বাঙালিদের পরিবেশনার পরিধি আর জৌলুশ আরও বেড়েছে।

প্রতিবছরের মতো এবারও বার্লিন ও জার্মানির অন্য শহরগুলো থেকে আসা বাঙালিরা বার্লিনের রাস্তায় উৎসবে মেতেছেন। নারীরা লাল শাড়ি পরে, কপালে টিপ, খোঁপায় নানা রঙের ফুল, দেশীয় অলংকার পরেছে। আর ছেলেরা লুঙ্গি-ফতুয়া, মাথায় গামছা বেঁধে কার্নিভ্যালের সঙ্গে জনপ্রিয় দেশাত্মবোধক, আধুনিক, লোকগীতির সঙ্গে নেচে-গেয়ে যখন এগিয়ে যাচ্ছিল, তখন রাস্তার দুই পাশের লাখো মানুষ করতালি দিয়ে আর চিৎকার করে সমস্বরে তাদের অভিনন্দন জানিয়েছে।

বার্লিনের রাস্তায় বিশ্ব সংস্কৃতির মহা মিছিলে বাংলাদেশের সগৌরব উপস্থিতি। ছবি: সরাফ আহমেদ
বার্লিনের রাস্তায় বিশ্ব সংস্কৃতির মহা মিছিলে বাংলাদেশের সগৌরব উপস্থিতি। ছবি: সরাফ আহমেদ

৬০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে মাইনজ থেকে এসেছেন অপু আলম, মুনশেনগ্লাডবাগ থেকে সানজীদা, রাধিতা, ইসারলোন থেকে সিগী, হেলেন, আনা, সোলিংগেনের সাকী, হ্যানোভার থেকে এসেছিল লিপি আহমেদ, হাইডেলবের্গ থেকে আবদুল্লাহ আল ফারুক, মিউনিখ থেকে সাব্বির, ম্যাগডেবার্গ থেকে অমৃতা। প্রায় ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে এই আয়োজনে রয়েছেন বার্লিন প্রবাসী বাঙালিদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা। কার্নিভ্যালে বাঙালিদের সংগঠন বাংলাদেশ কালচারাল ফোরামের পক্ষ থেকে এ দায়িত্ব পালন করছেন বার্লিনপ্রবাসী খালেদ নোমান নমি, সৈয়দ বাবুল, মাসুদ হোসেন, মামুন আহসান খান, আবদুল্লাহ আল মামুন, ময়েন চৌধুরী, লুৎফুল খান, মকসুদুল হক, জাফর ইকবাল, জাহিদ হিমন, নূরী খান, নাজমুন নেসা, শাহেদা, উলরিকে, ফেরদৌসী প্রমুখ। তাঁরা জানালেন বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতির ধারণাকে বিদেশে তুলে ধরতেই আমাদের এই প্রয়াস।