শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানকে এড়ালেন মোদি

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ফাইল ছবি
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ফাইল ছবি

অনুমতি পাওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানের আকাশপথ ব্যবহার করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিশকেক যাচ্ছেন না। পাকিস্তানকে এড়িয়ে ওমান, ইরান ও মধ্য এশিয়া হয়ে তিনি কিরঘিজস্তানের রাজধানী বিশকেকে যাবেন। ১৩ ও ১৪ জুন বিশকেকে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ‘সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন’ বা এসসিও-এর ১৯ তম শীর্ষ সম্মেলন। সেখানে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির প্রথম দেখা হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে ভারতে এই মুহূর্তে জল্পনা চরমে।

বালাকোটকান্ডের পর গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে পাকিস্তানের আকাশপথ ভারতীয় উড়োজাহাজের জন্য বন্ধ। নরেন্দ্র মোদির বিশকেক সফরের জন্য পাকিস্তানের আকাশপথ ব্যবহারের অনুমতি চেয়েছিল ভারত। পাকিস্তান সেই অনুমতি দিয়েছে বলে ভারতীয় সংবাদ সংস্থা পিটিআই তিন দিন আগে খবরও দিয়েছিল। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেই খবর অস্বীকার করেনি। কিন্তু যাত্রার ঠিক আগের দিন, আজ বুধবার দুপুরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, প্রধানমন্ত্রীর উড়োজাহাজ ওমান, ইরান ও মধ্য এশিয়ার অন্য দেশ হয়ে কিরঘিজস্তানের রাজধানী বিশকেকে যাবে। সরকারিভাবে বলা হয়, বিশকেকে পৌঁছানোর দুই ‘রুট’ বা উপায় নিয়েই চিন্তা-ভাবনা চলছিল। এখন ঠিক হয়েছে ওমান, ইরান ও মধ্য এশিয়া হয়ে যাওয়া হবে।

পাকিস্তানকে উপেক্ষা ও অবজ্ঞা করার এই দৃষ্টান্ত নবতম। ইমরান খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর এখনো মোদির সঙ্গে তাঁর দেখা হয়নি। দ্বিতীয় দফার প্রধানমন্ত্রিত্বের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে ইমরানকে আমন্ত্রণ জানাননি মোদি। ইমরান অবশ্য প্রধানমন্ত্রী হয়ে পর পর দুটি চিঠি লিখে মোদিকে অনুরোধ করেছেন বন্ধ থাকা দ্বিপক্ষীয় আলোচনা শুরু করতে। মোদি এখনো ইতিবাচক মনোভাব দেখাননি। বিশকেকের আসরে দুই নেতার মধ্যে আনুষ্ঠানিক কোনো বৈঠকও যে হচ্ছে না—ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তাও স্পষ্ট করে বলে দেওয়া হয়েছে।

ঘুরপথে বিশকেক যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন উঠেছে, কেন তা হলে পাকিস্তানের অনুমতি চাওয়া হলো? অনুমতি পাওয়ার পর কেনই বা তা গ্রহণ করা হলো না? সরকারিভাবে এর কোনো ব্যাখ্যা নেই। যদিও মনে করা হচ্ছে, পাকিস্তানের আকাশসীমা ব্যবহারের অনুমতি চাওয়ার পর সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে যে সমালোচনার ঝড় উঠেছে, তা দেখেই সরকারের এই সিদ্ধান্ত।

ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব বিবেক কাটজু পাকিস্তানের আকাশপথ ব্যবহারের অনুমতি চাওয়ায় সরাসরি হতাশা প্রকাশ করেছেন। এক সর্বভারতীয় ইংরেজি দৈনিকে লেখা নিবন্ধে এই হতাশার কথা জানিয়ে তিনি বলেছেন, গত মে মাসে বিশকেকে এসসিও-এর পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়েছিলেন ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। ঘুরপথে না গিয়ে পাক আকাশপথ পাড়ি দেওয়ার অনুমতি তখনো চাওয়া হয়েছিল। পাকিস্তান অনুমতিও দিয়েছিল। সেই অনুমতি চাওয়ার একটা কারণ ছিল। সুষমা ছিলেন অসুস্থ। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তো অসুস্থ নন। কাটজু লিখেছেন, ভারতের জন্য পাকিস্তান তার আকাশপথ বন্ধ করে দেওয়ায় হাজার হাজার সাধারণ মানুষকে প্রবল অসুবিধার মধ্যে পড়তে হচ্ছে। তাঁদের প্রতি, বিশেষ করে উপসাগরীয় দেশগুলোয় কাজ করে যাঁরা ভারতের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছেন, প্রধানমন্ত্রী তাঁদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে ঘুরপথেই বিশকেক যেতে পারতেন। বিবেক কাটজু মনে করেন, পাকিস্তানের কাছে এই ‘উপকারটুকু’ চাওয়াই ভারতের উচিত হয়নি।

সামান্য সময়ের ব্যবধানে পর পর দুবার পাকিস্তানের আকাশপথ ব্যবহারের আরজি জানানো ভারতের নমনীয় হওয়ার ইঙ্গিত কি না—এই প্রশ্নও উঠেছে। এর জবাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সূত্র গত মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারের মনোভাব অপরিবর্তিত। সন্ত্রাস ও আলোচনা একসঙ্গে চলতে পারে না। বিশকেকের অবসরে আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের কোনো সম্ভাবনা নেই।’

কিন্তু, আচমকা বৈঠক? সেই সম্ভাবনা কেউ উড়িয়ে দিচ্ছেন না। কেউ কেউ মনে করছেন, ২০১৭ সালের ৯ জুন কাজাখস্তানের রাজধানী আস্তানায় এসসিও-এর শীর্ষ সম্মেলনে যেভাবে আচমকা মোদি-নওয়াজ শরিফের দেখা হয়ে গিয়েছিল, এবারও তার পুনরাবৃত্তি হতে পারে। ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব শ্যাম শরণ সম্প্রতি এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘এসসিও-এর আসরে ইমরান খানের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির মুখোমুখি দেখা হয়েই যেতে পারে। হলে দুই নেতা কিছুটা সময় অবশ্যই কথা বলবেন, বলা উচিতও। আমাদের দ্বিধাগ্রস্ত হওয়া উচিত নয়। কথা বলা অথবা না বলা পাকিস্তানের মোকাবিলা করার কৌশল হতে পারে না।’

পাকিস্তান প্রশ্নে বিবেক কাটজু বরাবরই কট্টর। সাবেক কূটনীতিক রাজীব ভাটিয়া ও পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী তাঁর বিপরীত। দুজনেই মনে করেন, পাকিস্তানের আকাশপথ ব্যবহারের অনুমতি চাওয়ার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে জড়ানো ঠিক নয়। প্রথম আলোকে রাজীব ভাটিয়া বলেন, চিরকালীন শত্রুতা বলে কিছু হয় না। আলোচনাই প্রথম ও শেষ কথা। পাকিস্তানের সঙ্গেও ভারতের কথা হবে। কখন, কোন পরিস্থিতিতে, কীভাবে—সেটাই প্রশ্ন। তিনি মনে করেন, বিশকেকে মোদি-ইমরান আচমকা দেখা হওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্টই প্রবল।

একই অভিমত পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তীরও। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, তাগিদটা বেশি ইমরানের। বারবার তিনি মোদিকে চিঠি লিখছেন। বন্ধ আলোচনা শুরুর প্রস্তাব দিচ্ছেন। তাঁর ওপর চাপও প্রবল। পিনাকরঞ্জন বলেন, ‘আমার তো মনে হয় বিশকেকে মোদির মুখোমুখি হতে ইমরান মুখিয়ে রয়েছেন। পরিস্থিতি তেমন হলে প্রধানমন্ত্রী মোদিও নিশ্চয় সুভদ্র আচরণ করবেন।’