কেন তাঁরা খুন করেন?

৮৫ জন রোগীকে হত্যার অভিযোগ আনা হয় নিলস হুগেলের বিরুদ্ধে। ছবি: এএফপি
৮৫ জন রোগীকে হত্যার অভিযোগ আনা হয় নিলস হুগেলের বিরুদ্ধে। ছবি: এএফপি

জার্মানির দুটো হাসপাতালে ৮৫ জন রোগী হত্যা করার দায়ে ৬ জুন নার্স নিলস হুগেলকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। গুরুতর বা মৃত্যুপথযাত্রী রোগীদের দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন যাঁরা, তাঁদের হাতে রোগী হত্যার ঘটনা নতুন কিছু নয়। নিলস হুগেলের মতো এ তালিকায় আছেন আরও অনেকে। হুগেল বা হুগেলের মতো এমন সিরিয়াল কিলারদের (ক্রমিক খুনি) ব্যাপারে একটি সাধারণ প্রশ্নই সবার মনে আসে। তা হলো কেন তাঁরা খুন করেন?

এ ধরনের সিরিয়াল কিলারদের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি অনলাইন। এতে তুলে আনা হয়েছে বিভিন্ন সময়ের সিরিয়াল কিলার নার্সদের কথা এবং তাঁদের হত্যার ঘটনা নিয়ে মনোবিদদের বিশ্লেষণ।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অভিযুক্ত ব্যক্তিরা এ ব্যাপারে খুব কমই কথা বলে থাকেন। হত্যার কারণ সম্পর্কে তাঁদের কাছ থেকে সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায় না।

বার্মিংহাম সিটি ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এলিজাবেথ ইয়ার্ডলির মতে, ‘এসব লোককে বিশ্বাস করা থেকে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।’

অভিযুক্ত ব্যক্তিদের অনেকে অজুহাত দেন, রোগীর দুর্ভোগের সমাপ্তি টানতে তাঁরা রোগীর জীবন নিয়েছেন। আবার কেউ কেউ জটিল রোগী দেখভাল থেকে মুক্তি পেতেই এ পথ বেছে নিয়েছিলেন।

এমন অজুহাতের ক্ষেত্রে নাম বলা যেতে পারে মার্কিন নার্স চার্লস কুলেনের। ২৯ জন রোগী হত্যার কথা তিনি স্বীকার করেন। তিনি দাবি করেন, গুরুতর অসুস্থ রোগীরা কষ্ট পাচ্ছিলেন, ওষুধের মাত্রা বাড়িয়ে তিনি মৃত্যু ত্বরান্বিত করেছিলেন। যদিও জানা গিয়েছিল, তাঁর রোগীদের বেশ কয়েকজন সুস্থ হয়ে উঠছিলেন।

কানাডার নার্স এলিজাবেথ ওয়েটলোফের স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন, তাঁর হত্যার শিকার আটজন রোগীর ক্ষেত্রে তিনি প্রচণ্ড রাগ বোধ করতেন। তাই মাত্রাতিরিক্ত ইনসুলিন প্রয়োগ করে হত্যা করেন। তাঁর প্রথম হত্যার শিকার হন ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে ৮৪ বছর বয়সী জেমস সিলকক্স নামের এক রোগী।

নিলস হুগেলের ব্যাপারে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি বলেন, সহকর্মীদের কাছে হুগেল নিজেকে রোগীর জন্য নিবেদিতপ্রাণ হিসেবে জাহির করতেন। রোগীদের বাঁচানোর চেষ্টা করার বিষয়টি তিনি এতটাই দেখাতেন যে সহকর্মীরা তাঁকে ‘নবজীবন দান করা র‌্যাম্বো’ বলে ডাকতেন।

৪২ বছর বয়সী নিলস হুগেলর জন্ম জার্মানির উত্তরে উপকূলীয় শহর ভিলহেমসাফনে। বাবাও ছিলেন নার্স। বাবার মতো ১৯ বছর বয়সে তিনি নার্স পেশায় প্রবেশ করেন। ১৯৯৯ সালে তিনি জার্মানির ওডেনবার্গের একটি প্রধান হাসপাতালে নার্স হিসেবে যোগ দেন। ২০০৩ সালে তিনি পাশের ডেমেনহোর্স্ট জেলায় বদলি হন।

এক কন্যার বাবা হুগেলকে সাবেক সহকর্মীরা পরিশ্রমী ও পছন্দসই ব্যক্তি হিসেবেই মনে করতেন। কিন্তু তাঁরা হঠাৎ লক্ষ করা শুরু করেন, হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) হুগেলের তত্ত্বাবধানে থাকা বেশ কয়েকজন রোগীর মৃত্যুর ক্ষেত্রে ‘সমস্যা’ রয়েছে। ২০০০ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে মৃত্যুপথযাত্রী বেশির ভাগ বয়স্ক রোগীর ওষুধের মাত্রাতিরিক্ত ডোজ প্রয়োগ করে তিনি মৃত্যু ত্বরান্বিত করতেন। ২০০৫ সালে তিনি হাতেনাতে ধরা পড়েন।

হুগেলের ব্যাপারে মনোচিকিৎসক জানিয়েছেন, তিনি (হুগেল) নারসিসসিসটিক ডিসঅর্ডারে ভুগছেন। নারসিসসিসটিক পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার (এনপিডি) একটি ব্যক্তিত্বসংক্রান্ত অসুস্থতা। এ সমস্যায় ভোগা মানুষের মধ্য দীর্ঘ সময় ধরে অস্বাভাবিক আচরণ দেখা যায়। তাঁরা নিজেদের বেশি গুরুত্ব দেন। বেশি বেশি প্রশংসাপ্রাপ্তির চাহিদা থাকে তাঁদের। সেই সঙ্গে তাঁদের মধ্যে সহানুভূতিরও অভাব দেখা যায়।

এদিকে ফরেনসিক মনোবিদ্যার অধ্যাপক ক্যাথেরিন রামসল্যান্ড নার্সদের এমন হত্যায় জড়িত হওয়ার কারণ সম্পর্কে বলেন, তাঁদের জন্য (অভিযুক্ত নার্স) শক্তিহীন এই দুনিয়ায় হত্যার মাধ্যমে নিজেকে হয়তো শক্তিশালী ভাবেন তাঁরা। হতাশা কাটাতে অথবা কাজের ভার কমাতেও তাঁরা হত্যা করে থাকতে পারেন।

অধ্যাপক ইয়ার্ডলির মতে, হত্যার মাধ্যমে এই ব্যক্তিদের মধ্যে একধরনের ক্ষমতাপ্রাপ্তির অনুভূতি কাজ করে। অতীতেও তাঁরা লোকজনের ক্ষতি করে আনন্দ পেয়েছেন। হাসপাতালে চাকরির সুবাদে তাঁদের এ আচরণ বৃদ্ধির আরও সুযোগ এসেছে। এ কাজে (হত্যাকাণ্ড) সহজে প্রবেশাধিকার পাওয়া ও সুবিধা পাওয়ার বিষয়টি তাঁদের আরও উৎসাহিত করেছে। এ ক্ষেত্রে তিনি বেভারলি এলিট নামের এক নার্সের উদাহরণ টেনে বলেন, ১৯৯১ সালে ল্যাঙ্কাশায়ারে আট সপ্তাহে এলিট তাঁর তত্ত্বাবধানে থাকা ১৩ শিশুর গুরুতর ক্ষতি করেছিলেন। ওই শিশুদের হত্যার আগে সাবেক প্রেমিকের প্রতি খুব অনুগত আচরণ দেখাতেন এলিট।

অধ্যাপক ইয়ার্ডলি বলেন, মেডিকেল সিরিয়াল কিলাররা তাঁদের হাতে থাকা ক্ষমতা ও কোনো কিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারার অনুভূতি থেকে হত্যার মতো ভয়াবহ অপরাধে জড়িত হন। তিনি বলেন, ‘জীবন ও মৃত্যুর নিয়ন্ত্রণ তাঁদের হাতে। এ বোধ থেকে তাঁরা এ ধরনের রোগীর ওপর এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ ও অধিকারবোধ অনুভব করতেন। তাঁরা ভাবতেন, এ রোগীদের ক্ষতি করা বা হত্যার জন্য তিনিই নিযুক্ত ব্যক্তি।’