বেকায়দায় জাপান

জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে। ছবি: রয়টার্স
জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে। ছবি: রয়টার্স

জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের জন্য বিষয়টা ছিল নতুন এক চ্যালেঞ্জের মতো। দেশে মোটামুটি শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীর অভাবে নিজের ক্ষমতার আসন পাকাপোক্ত করেছেন তিনি। এবার নজর দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ক্ষমতা বিস্তার করার দিকে। তবে খুব একটা সুখকর ফলাফল পাননি। এর জন্য অবশ্য জাপানের প্রধানমন্ত্রীকে কোনো অবস্থাতেই দায়ী করা যায় না। ইরান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যখন রীতিমতো তোলপাড় তুলে রণহুংকার দিতে ব্যস্ত, ঠিক তখনই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ বন্ধু আবে নেমে পড়েছিলেন শান্তির সন্ধানে। তেহরানের সঙ্গে টোকিওর সম্পর্ক এখনো হৃদ্যতামূলক। আবে ধারণা করেছিলেন, সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে আপাতত যুদ্ধের আশঙ্কা থেকে মধ্যপ্রাচ্যকে বের করে আনতে পারবেন। আবে ভেবেছিলেন, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সেটা তাঁর জন্য হবে খুবই ইতিবাচক এক সূচনা।

জাপানের প্রধানমন্ত্রীর এই মধ্যস্থতার চেষ্টার পেছনে অর্থনৈতিক হিসাব–নিকাশও ছিল। ইরানের ওপর একতরফা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন মিত্রদের সতর্ক করে দিয়েছিল যে তেহরানের সঙ্গে অর্থনৈতিক লেনদেন তারা বন্ধ না করলে তাদের বিরুদ্ধেও পদক্ষেপ নিতে পিছপা হবে না। যুক্তরাষ্ট্রের সেই ঘোষণার পর জাপান ও অন্য কয়েকটি মার্কিন মিত্রদেশ ছাড় পাওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ধরনা দিতে শুরু করে। মার্কিন প্রশাসন তাদের জন্য ইরানের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করার বর্ধিত যে সময়সীমা নির্ধারিত করে দিয়েছে, তা কিছুদিনের মধ্যেই উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ার কথা। ফলে, জাপানের প্রধানমন্ত্রী মধ্যস্থতা মিশন শুরু করার আগে এ রকম ধারণাও হয়তো করে থাকবেন যে মিশন সফল হলে ইরান থেকে তেল আমদানি অব্যাহত রাখার সুযোগ জাপান পাবে।

তবে আন্তর্জাতিক রাজনীতির মারপ্যাঁচ যে এতটা জটিল আর গোলকধাঁধাপূর্ণ, সেই ভাবনা হয়তো জাপানের প্রধানমন্ত্রীর মনে দেখা দেয়নি। সরল বিশ্বাসে ইরান সফর তিনি শুরু করেছিলেন। এমনকি সফরের ঠিক আগে বন্ধু ট্রাম্পের সঙ্গে টেলিফোনে পরামর্শও শুনে নিয়েছিলেন। পরোক্ষের খেলোয়াড়দের নিপুণ কিছু খলচালের মধ্যে দিয়ে এর সবটাই এখন ভেস্তে যাওয়ার পথে।

আবের তেহরানে অবস্থানের সময়েই ইরান ও উপসাগর রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বিভক্তি টেনে দেওয়া হরমুজ প্রণালিতে তেলবাহী দুটি ট্যাংকারের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। দুটি জাহাজের একটি ছিল পানামার পতাকাবাহী জাপানি একটি কোম্পানির মালিকানাধীন। সৌদি আরব থেকে পেট্রোলিয়াম পণ্য মিথানল নিয়ে জাহাজটি সিঙ্গাপুর যাচ্ছিল। জাপানের প্রধানমন্ত্রী যখন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়তুল্লাহ আল খামেনির সঙ্গে বৈঠক শেষ করছিলেন হামলা অনেকটা ঠিক সেই সময়ে ঘটে। ফলে ধরে নেওয়া যায় যে বা যারা হামলা চালিয়েছে ইরান প্রশ্নে দেখা দেওয়া যুদ্ধাবস্থার অবসান হোক, সেটা তাদের মনঃপূত নয়।

হামলার ঠিক পরপর ইরানকে দায়ী করে যুক্তরাষ্ট্র বিবৃতি দেয়। তখনই বিশ্ববাসী হরমুজ প্রণালিতে তেলবাহী ট্যাংকারের ওপর দ্বৈত হামলা সম্পর্কে জানতে পারেন। এর ঠিক পরপর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও অস্পষ্ট কিছু উপগ্রহ ফুটেজ সাংবাদিকদের দেখান। তিনি দাবি করেন, হামলার শিকার একটি ট্যাংকার থেকে অবিস্ফোরিত বোমা সরিয়ে নেওয়ার ছবি প্রমাণ করছে যে ইরানের সামরিক বাহিনী হামলা চালিয়েছে। পম্পেও আরও বলেন, ইরানের নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ থেকে নিক্ষিপ্ত টর্পেডো জাহাজ দুটিকে আঘাত করে। তিনি হুমকি দেন, আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমায় নৌ-চলাচল স্বাধীনতা রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র পদক্ষেপ গ্রহণে বিরত থাকবে না। একই সুর প্রতিধ্বনিত হতে শোনা যায় ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টনের কণ্ঠস্বরেও। ইরান অবশ্য হামলার সঙ্গে দেশের কোনোভাবে জড়িত থাকার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে। জাপানের প্রধানমন্ত্রীর সফরকে ভিন্ন খাতে পরিচালিত করার লক্ষ্যে হামলা চালানো হয় বলে অভিযোগ তোলে।

মাইক পম্পেও এবং জন বোল্টনের জোরালো কণ্ঠস্বর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গ্রহণযোগ্য হয়ে দেখা দিতে পারত। কিন্তু জাপানের জাহাজ কোম্পানির প্রধান টোকিওতে এক সংবাদ সম্মেলনে টর্পেডো হামলার অভিযোগ মিথ্যা বলে নাকচ করে দেন। ক্ষতিগ্রস্ত জাহাজের ছবি দেখিয়ে এবং জাহাজের নাবিকদের দেওয়া বর্ণনার উল্লেখ করে তিনি বলেন, টর্পেডো নয়, বরং উড়ে আসা বস্তুর আঘাতে জাহাজে আগুন ধরে যায়। ফলে যুক্তরাষ্ট্রকে পরবর্তী সময়ে অনেকটা বাধ্য হয়ে আগের ভাষ্য বদলে নিয়ে ভিন্ন কথা এখন বলতে হচ্ছে।

ঘনিষ্ঠ মিত্রের এ রকম পরস্পরবিরোধী বক্তব্য ও সেই সঙ্গে বাস্তব ঘটনাবলির সঙ্গে সে রকম বক্তব্যের বৈসাদৃশ্য কিছুটা হলেও বিপাকে ফেলে দিয়েছে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবেকে। ইরান সফর শেষ করে শুক্রবার দেশে ফিরে এসে কঠোর ভাষায় তিনি হামলার নিন্দা জানান। তবে কোনো পক্ষের দিকে সরাসরি অঙ্গুলিনির্দেশ না করে তিনি বলেছেন ঘটনা নিয়ে জাপান নিজস্ব তদন্ত চালাচ্ছে।

টোকিও ফিরে আসার ঠিক পরপর আবারও তিনি তাঁর বন্ধু ট্রাম্পের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন। প্রায় ৩০ মিনিট ধরে চলা সেই ফোনালাপ সম্পর্কে বিস্তারিত না জানালেও আবে উল্লেখ করেন যে পরিস্থিতির আরও অবনতি হওয়া বন্ধ করতে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ ধৈর্যের পরিচয় দেবে বলে তাঁর বিশ্বাস। এখানেও তিনি একক কোনো পক্ষকে ঘটনার জন্য দায়ী করা থেকে বিরত থাকেন।

আবের এই মন্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট যে জাপান সরকার এখন বিব্রতকর এক অবস্থার মধ্যে আছে। শান্তি প্রতিষ্ঠায় চেষ্টা চালানোর আন্তরিক অভিপ্রায় নিয়ে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইরান সফর করেছেন। কিন্তু সেই সফর এখন আবারও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে পেছনের দরজার খেলায় পারদর্শী যুদ্ধবাজরা শান্তির সম্ভাবনা বানচাল করে দিতে যেকোনো খেলা খেলে যেতে সব সময় প্রস্তুত।