বড় সংকটে বৈশ্বিক অর্থনীতি

গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানি তেল পরিবহনের রুট হরমুজ প্রণালিতে পরপর দুটি তেলবাহী ট্যাংকারে হওয়া হামলাকে পুরো বিশ্বের অর্থনীতির জন্যই হুমকি হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকেরা। ছবি: রয়টার্স।
গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানি তেল পরিবহনের রুট হরমুজ প্রণালিতে পরপর দুটি তেলবাহী ট্যাংকারে হওয়া হামলাকে পুরো বিশ্বের অর্থনীতির জন্যই হুমকি হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকেরা। ছবি: রয়টার্স।

মাত্র কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে মধ্যপ্রাচ্যে জ্বালানি তেলের ট্যাংকারসহ জ্বালানি তেলসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন স্থাপনায় ছয়টি হামলা হয়েছে। সব হামলাতেই যুক্তরাষ্ট্র ও মধ্যপ্রাচ্যে তাদের মিত্রদের অভিযোগের আঙুল ইরানের দিকে। সর্বশেষ যে দুটি হামলা হয়েছে, তাও গুরুত্বপূর্ণ তেল পরিবহন রুটে। ফলে জ্বালানি তেলের বাজারে এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে।

মধ্যপ্রাচ্যে বর্তমান পরিস্থিতি ১৯৭৩ সালের শেষ দিককার ঘটনার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। সে সময় আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে বৈশ্বিক জ্বালানি তেলের বাজারে ভয়াবহ প্রভাব পড়েছিল। ব্যারেলপ্রতি জ্বালানি তেলের দাম ২ ডলার থেকে বেড়ে কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে ১১ ডলার হয়েছিল। মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্ব গিয়েছিল বেড়ে। বিপরীতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চাকা প্রায় থমকে গিয়েছিল। অনেকটা ১৯৩০ সালের মহামন্দার সময়ের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। ফলে গত বৃহস্পতিবার হরমুজ প্রণালিতে দুটি তেলবাহী ট্যাংকারে বিস্ফোরণের ঘটনা ব্যাপক শঙ্কার সৃষ্টি করেছে।

বৃহস্পতিবারের হামলার পরপর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে গিয়েছিল। চাহিদা কম থাকায় এ দাম এক দিনের ব্যবধানে নিয়ন্ত্রণে এলেও শঙ্কা থেকে যাচ্ছে, উত্তেজনার নিরসন না হলে এটি আয়ত্তের বাইরে চলে যাওয়ার। সঙ্গে রয়েছে অন্যান্য রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট। সব মিলিয়ে এ ধরনের কোনো পরিস্থিতি দীর্ঘসূত্রি হলে, তা সরাসরি বৈশ্বিক উৎপাদনে প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। ‘ইকোনমিক টাইমস’-এ প্রকাশিত এ-সম্পর্কিত প্রতিবেদনে বর্তমান পরিস্থিতিকে আরেকটি অর্থনৈতিক মন্দার পূর্বলক্ষণ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।

এখন পর্যন্ত এ হামলাগুলোর সঙ্গে কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতার দায় অস্বীকার করেছে ইরান। দায় যারই হোক, ঘটনাটি ঘটছে। এই পরপর কয়েকটি হামলা, এরই মধ্যে জ্বালানি তেলের বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। এই মুহূর্তে বৈশ্বিক অর্থনীতির অবস্থাও তেমন শক্তিশালী নয় যে এই শঙ্কাকে ছোট কিছু মনে করা যেতে পারে। ব্রিটিশ পত্রিকা ‘দ্য গার্ডিয়ান’-এর বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের আগে বৈশ্বিক অর্থনীতি মোটামুটি প্রতিবন্ধকহীন ছিল। এবারের পরিস্থিতিকে বরং সত্তরের দশকের শেষভাগে ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময়ের পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করা যায়।

সত্তরের দশকের প্রথম ভাগে হওয়া আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর বৈশ্বিক অর্থনীতির অবস্থা সে সময় এমনিতেই খারাপ ছিল। এর মধ্যে আরেকটি যুদ্ধ বৈশ্বিক অর্থনীতির নাভিশ্বাস তুলে দিয়েছিল। এবারও অবস্থা অনেকটা তেমনই। ইরাক যুদ্ধ, আফগানিস্তান যুদ্ধসহ মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে একটানা চলা আঞ্চলিক যুদ্ধ এবং হালে শুরু হওয়া চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যিক যুদ্ধের বাস্তবতায় বৈশ্বিক অর্থনীতি এমনিতেই খুব সংকটের মধ্যে রয়েছে। এর সঙ্গে রয়েছে ২০০৮ সালের বৈশ্বিক মন্দা-পরবর্তী প্রভাব। কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো যদিও কয়েক বছর ধরে নিয়মিতই বলে যাচ্ছে যে, মন্দার পর মানুষের জীবন স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। কিন্তু এই স্বাভাবিক হয়ে ওঠার বিষয়টি ঠিক সন্তোষজনক নয়। ফলে এবারের চলমান উত্তেজনা জ্বালানি তেলের বাজারে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে পারে।

২০০৮ সালের মন্দার পর অর্থনীতি পুনরুদ্ধার কার্যক্রম হাতে নেয় মন্দার সবচেয়ে বড় শিকার হওয়া পশ্চিমা দেশগুলো। এ ক্ষেত্রে অনেক অর্জনও এর মধ্যে রয়েছে। বাড়ছে কর্মসংস্থান। বিশেষত ধনী দেশগুলোয় চাকরির বাজার বেশ ইতিবাচক অবস্থায় রয়েছে। বেকারত্বের হার অনেক দেশেই অনেক কম। কিন্তু এই তথ্যকে ঠিক আমলযোগ্য মনে করেন না ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের মুদ্রানীতি-বিষয়ক কমিটির সাবেক সদস্য ডেভিড ব্লাঞ্চফ্লাওয়ার। ‘গার্ডিয়ান’কে তিনি বলেন, সত্যিকার অর্থেই যদি যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের চাকরির বাজার এমন শক্তিশালী অবস্থানে থাকে, তাহলে মজুরি হারে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি হওয়ার কথা। কিন্তু তেমনটি হয়নি বা হচ্ছে না। ফলে এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সঙ্গে যে বিবাদে জড়াচ্ছে, তার জন্য অনেক বড় মূল্য চোকাতে হতে পারে। এমনিতেই যুক্তরাষ্ট্রের এবারের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি ধীর হওয়ার কথা। এর সঙ্গে শুল্ক যুদ্ধ ও ইরানের সঙ্গে বিবাদ মিলিয়ে একটা গোটা বিশ্বকেই আরেকটি মন্দার দরজায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।