পশ্চিমবঙ্গে চিকিৎসকেরা ধর্মঘট প্রত্যাহারে রাজি, তবে...

এনআরএস হাসপাতালে আজকের বিক্ষোভ। ছবি: ভাস্কর মুখার্জি
এনআরএস হাসপাতালে আজকের বিক্ষোভ। ছবি: ভাস্কর মুখার্জি

কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছয় দিন ধরে চলা জুনিয়র চিকিৎসকদের ধর্মঘট প্রত্যাহার হতে চলেছে। আজ রোববার বিকেলে জুনিয়র চিকিৎসকদের গড়া জেনারেল বডি বা জিবির বৈঠক শেষে জুনিয়র চিকিৎসকেরা ঘোষণা দিয়েছেন, মানুষের কষ্টের কথা বিবেবচনা করে তাঁরা তাঁদের ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নিতে রাজি আছেন। তাঁরা তাঁদের দাবিদাওয়া নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করতেও রাজি আছেন। তবে সেই বৈঠক কোনো বদ্ধ ঘরে নয়; হতে হবে প্রকাশ্যে পশ্চিমবঙ্গের সব মেডিকেল কলেজের প্রতিনিধিকে নিয়ে। আর সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরার সামনে হতে হবে সেই বৈঠক।

জুনিয়র চিকিৎসকেরা গতকাল শনিবার বিকেলে মুখ্যমন্ত্রীর ডাকা তাঁদের প্রতিনিধিদের নিয়ে তাঁর সচিবালয়ে প্রস্তাবিত বৈঠক প্রত্যাখান করেছিলেন। আজ জুনিয়র চিকিৎসকদের জেনারেল বডি প্রায় ৫ ঘণ্টা বৈঠক শেষে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করতে রাজি হন। তবে তাঁরা ঘোষণা দেন বৈঠক কোনো বদ্ধ ঘরে হতে পারবে না। বৈঠক হতে হবে সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরার সামনে, সব মেডিকেল কলেজের প্রতিনিধিদের নিয়ে।
আজকের এই জুনিয়র চিকিৎসকদের জিবির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় কলকাতার এনআরএস মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একাডেমিক ভবনে। এই বৈঠকে বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ এবং ছাত্রছাত্রী প্রতিনিধিরা অংশ নেন। এই বৈঠকে জুনিয়র চিকিৎসকদের নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সমালোচনাকে নিন্দা করা হয়। তবে রোগীর স্বার্থে চিকিৎসা পরিষেবা দ্রুত শুরু করার পক্ষে মত দেওয়া হয়। এই বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য-শিক্ষা কর্মকর্তা প্রদীপ মিত্রও। এই সভায় প্রস্তাব ওঠে রাজভবনে রাজ্যপালের সামনে মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠক করার। তবে সর্বশেষ সিদ্ধান্ত হয়, বৈঠক হবে প্রকাশ্যে সংবাদমাধ্যমের সামনে। এখন বৈঠকের জায়গা ঠিক করবে রাজ্য সরকার।

ইতিমধ্যে জুনিয়র চিকিৎসকদের আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বিভিন্ন কলেজের কয়েক শ চিকিৎসক কাজে ইস্তফা দিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে কলকাতার পিজি হাসপাতালের বিভিন্ন কলেজের ১৭৫, কলকাতা মেডিকেল কলেজের ৬৫, এনআরএস মেডিকেল কলেজের ১০৮, আরজিকর মেডিকেল কলেজের ১২৬, সাগর দত্ত মেডিকেল কলেজের ২০, ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের ১৬, উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজের ১১৯, মুর্শিদাবাদ মেডিকেল কলেজের ৩২, নদীয়ার জেএমএম হাসপাতালের ৪০ এবং মেদিনীপুরেরর মেডিকেল কলেজের ১০ জন চিকিৎসক আছেন।

চিকিৎসক ধর্মঘটের সূচনা হয় গত সোমবার রাতে। কলকাতার এনআরএস মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এক প্রবীণ রোগীর মৃত্যুকে ঘিরে অশান্ত হয়ে ওঠে হাসপাতাল। এই মৃত্যুতে চিকিৎসকদের গাফিলতির অভিযোগ এনে ওই রোগীর আত্মীয়রা চড়াও হন চিকিৎসকদের ওপর। একপর্যায়ে হাসপাতালের চিকিৎসক পরিবহ মুখোপাধ্যায় প্রচণ্ড মার খান। তাঁর মাথায় আঘাত লাগে। তাঁর অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ায় তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় কলকাতার ইস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্স হাসপাতালে। সেখানে তাঁর মাথায় অস্ত্রোপচার করা হয়। ওই ঘটনায় ওই দিন আরও ৫ চিকিৎসক আহত হন।

এ ঘটনার প্রতিবাদে এনআরএসএর জুনিয়র চিকিৎসকেরা কাজ বন্ধ করে দিয়ে ধর্মঘটে নামেন। ফলে অচল হয়ে পড়ে হাসপাতালের চিকিৎসা পরিষেবা। জুনিয়র চিকিৎসকদের এই ধর্মঘটের প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করেন কলকাতার বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের জুনিয়র এবং সিনিয়র চিকিৎসকেরা।

এ ঘটনার জেরে গত বৃহস্পতিবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতার এসএসকেএম বা পিজি হাসপাতালে এসে চিকিৎসকদের হুমকির সুরে কাজে যোগদানের সময় বেঁধে দেন ওই দিন বেলা দুইটা পর্যন্ত। এ ছাড়া মমতা উত্তেজনাপূর্ণ ভাষণ দেন চিকিৎসকদের উদ্দেশ্যে। এতে ক্ষুব্ধ হয় চিকিৎসক সমাজ। এরপরই চিকিৎসকেরা দাবি তোলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে। ফলে চিকিৎসকেরা সেই মঙ্গলবার থেকে অব্যাহত রাখেন তাঁদের ধর্মঘট। তবে তাঁরা জরুরি বিভাগ চালু রাখলেও আউটডোর বন্ধ রাখেন পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন হাসপাতালে।

এদিকে এ ঘটনার জেরে দিল্লির এইমসসহ বিভিন্ন রাজ্যের সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকেরাও এসে দাঁড়ান পশ্চিমবঙ্গের চিকিৎসকদের এই আন্দোলনের পাশে। চিকিৎসকেরা দাবি তোলেন, হাসপাতালে তাঁদের নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন হাসপাতালে যেসব চিকিৎসক লাঞ্ছিত হয়েছেন, আহত হয়েছেন, সেই সব ঘটনার বিচার করে অভিযুক্তদের শাস্তি দিতে হবে।
এদিকে চিকিৎসকদের কেন্দ্রীয় সংগঠন মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়া ঘোষণা দিয়েছে, এ ঘটনার প্রতিবাদে ১৭ জুন দেশব্যাপী চিকিৎসকেরা ধর্মঘট পালন করবেন।
চিকিৎসকদের এই ধর্মঘটের জেরে কার্যত অচল হয়ে পড়ে কলকাতার সব সরকারি হাসপাতাল। রোগীরা এসে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। আবার রোগীরা হাসপাতালে চিকিৎসা না পাওয়ায় ইতিমধ্যে বেশ কজন রোগীর মৃত্যু হওয়ারও অভিযোগ ওঠে।