কাটমানি ইস্যুতে মমতার ডিগবাজি

পার্থ চট্টোপাধ্যায়। ছবি: ভাস্কর মুখার্জি
পার্থ চট্টোপাধ্যায়। ছবি: ভাস্কর মুখার্জি

কাটমানি ইস্যুতে অবস্থান বদল করেছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। তিনি যেন অনেকটা ডিগবাজি খেয়েছেন। রাজ্যজুড়ে কাটমানি ইস্যুতে জোর আন্দোলন চলছে। জেলায় জেলায় জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। প্রতিবাদী আন্দোলন চলছে।

মমতা তাই এ বিষয়ে তড়িঘড়ি নির্দেশ দিয়েছেন। তাঁর নির্দেশমতো দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় এক বিবৃতিতে বলছেন, একশ্রেণির সংবাদমাধ্যম মমতার বক্তব্যকে বিকৃত করে প্রচার করেছে। তৃণমূলের ৯৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ জনপ্রতিনিধি সৎ এবং পরিশ্রমী। তাঁরা দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত নন। ফলে, এই বিবৃতি দিয়ে তৃণমূল প্রকারান্তরে নিজেদের দুর্নীতিমুক্ত করতে চাইলেও মানুষ বুঝে গেছে, মমতা যা আগে বলেছেন, তাই-ই ঠিক। তৃণমূলের জনপ্রতিনিধিরা সরকারি প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সত্যিই কাটমানি বা ঘুষ খেয়েছেন।

কাটমানি ফেরত দেওয়ার আন্দোলন মূলত শুরু হয় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি নির্দেশের জেরে। গত মঙ্গলবার দুপুরে দক্ষিণ কলকাতার নজরুল মঞ্চে মমতা পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন পৌরসভার দলীয় চেয়ারম্যান ও কাউন্সিলরদের এক সভা ডেকেছিলেন। সেখানেই তিনি ঘোষণা দেন, ‘যাঁরা সরকারি প্রকল্পের কাজ করতে গিয়ে মানুষের কাছ থেকে কাটমানি বা ঘুষ নিয়েছেন, তাঁরা অবিলম্বে সেই টাকা ফেরত দিয়ে দিন। নইলে দুর্নীতি দমন শাখা তাঁদের বিরুদ্ধে মাঠে নামবে।’

মমতার এই ঘোষণার পর উত্তাল হয়ে পড়ে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি। পশ্চিমবঙ্গজুড়ে শাসক দল তৃণমূলের জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে ঘুষের টাকা বা কাটমানি ফেরতের আন্দোলন শুরু হয়। যেসব নেতা সরকারি প্রকল্পের কাজ করতে গিয়ে মানুষের কাছ থেকে ঘুষ বা কাটমানি নিয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধেই এই আন্দোলন শুরু হয়। এর মধ্যে এক কোটি টাকা নয়ছয় করার অভিযোগে তৃণমূলের এক নেতাকে গ্রেপ্তার করাও হয়েছে।

তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা কোনো সরকারি প্রকল্পের কাজ বা অনুদান দিতে নিয়মিত সাধারণ গরিব মানুষের কাছ থেকে ঘুষ বা কাটমানি আদায় করে আসছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। আরও অভিযোগ রয়েছে, তৃণমূলের জনপ্রতিনিধিরা গরিবদের গৃহনির্মাণ প্রকল্প থেকে শুরু করে বিভিন্ন সরকারি প্রকল্প—যেমন: কন্যাশ্রী, সমব্যথী, নির্মল বাংলা, ১০০ দিনের কাজ ইত্যাদি—থেকে ঘুষের টাকা নিয়মিত আদায় করতেন। নানা ভাতা ও অনুদান প্রদানের সময়ও তাঁরা সেই টাকায় ভাগ বসাতেন। তৃণমূল এত দিন এটি প্রকাশ্যে স্বীকার করেনি।

এবারের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল বুঝতে পেরেছে, গরিব মানুষের নানা প্রকল্প থেকে ঘুষ নিলে ফল ভালো হয় না। তবে বিষয়টিকে মমতা ভালোভাবে নেননি। লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলে এই ঘুষের টাকা নেওয়ার নানা স্পষ্ট ছবি দেখা গেছে। গ্রামের মানুষ তৃণমূলকে ছুড়ে ফেলেছে। তাই ফলাফল বিশ্লেষণ করে তৃণমূল বুঝতে পেরেছে, গরিব মানুষের জন্য সরকারি প্রকল্পের টাকা নেতারা যেভাবে ব্যবহার করেছেন এবং এই টাকা গরিবদের জন্য বরাদ্দ করতে গিয়ে নেতারা যেভাবে ঘুষ গ্রহণ করেছেন, সেটা এই রাজ্যের মানুষ মেনে নিতে পারেনি।

মমতার কাটমানি নিয়ে কলকাতা নজরুল মঞ্চ ও তৃণমূল ভবনে নদীয়া জেলার নেতাদের দেওয়া নির্দেশ যে দলের কত ক্ষতি করেছে, সেটি উপলব্ধি করে গতকাল রোববার রাতে তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বিবৃতিতে বলেছেন, তৃণমূলের ৯৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ জনপ্রতিনিধি সৎ এবং পরিশ্রমী। সংবাদমাধ্যমের একাংশ তৃণমূল নেত্রীর কথা বিকৃত করেছে। অন্য দল থেকে আসা কিছু লোক এখন তৃণমূলের নাম ডোবাচ্ছে। সেসব লোকই দুর্নীতি ও অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত। পঞ্চায়েত ও পৌরসভার মুষ্টিমেয় কিছু লোক বিজেপিতে গেছে। তাদের উদ্দেশ্য অসৎ। তারা ভাবছে, অপরাধ করে পার পেয়ে যাবে। বিজেপিতে গেলেও অপরাধীরা ছাড় পাবে না।

বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, মুখ্যমন্ত্রী কাটমানি নিয়ে দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো কথা বলছেন। পশ্চিমবঙ্গে তো সবকিছু ওনার অনুপ্রেরণায় হয়। কিন্তু কাটমানির বিষয়টি বুঝতে ওনার আট বছর সময় লাগল। এরপরই তিনি বলেন, উনি সব জানতেন, এখন প্রকাশ্যে স্বীকার করছেন।

দিলীপ ঘোষও মন্তব্য করেন, ‘এই ইস্যুতে মুখ্যমন্ত্রীর কালীঘাটের বাসভবন ঘেরাও করে ধরনা দেওয়া উচিত। মানুষ সেটা করতে পারে।’