সাহস দিয়েই চাপ মোকাবিলা করতে হবে

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

দেশে দেশে কর্তৃত্ববাদী সরকারের উত্থান স্বাধীন সাংবাদিকতার পথে বড় বাধা তৈরি করেছে। কেবল অর্থনৈতিক চাপ তৈরি নয়; সাংবাদিকদের হত্যা, জেল ও নানা হুমকি-ধমকি দিয়ে সত্য গোপন করার চেষ্টা এখন এক বৈশ্বিক প্রবণতা। সাহসের সঙ্গে সত্য প্রকাশে অবিচল থেকেই গণমাধ্যমগুলোকে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে।

বুধবার লন্ডনে অনুষ্ঠিত গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষায় বৈশ্বিক সম্মেলনের (গ্লোবাল কনফারেন্স ফর মিডিয়া ফ্রিডম) প্রথম দিনে এটিই ছিল মূল বার্তা। সরকারের অন্যায্য নিয়ন্ত্রণ এবং প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর কাছে রাজস্ব হারানোর কারণে বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমগুলো যে কঠিন সময় পার করছে, তা থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজতে দুদিনব্যাপী এই সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এর যৌথ আয়োজক যুক্তরাজ্য ও কানাডা। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষার দাবিতে এটি প্রথম কোনো বৈশ্বিক সম্মেলন। যার মূল প্রতিপাদ্য—গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষা করুন (ডিফেন্ড মিডিয়া ফ্রিডম)।

প্রথম দিনের সম্মেলন শেষে সংবাদ সম্মেলনে প্রখ্যাত মানবাধিকারবিষয়ক আইনজীবী আমাল ক্লোনি ফ্রিডম হাউসের হিসাব তুলে ধরে বলেন, গত ১৩ বছরের মধ্যে বৈশ্বিকভাবে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা তলানিতে নেমে এসেছে। বিশ্বের মাত্র ১৩ শতাংশ মানুষ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ভোগ করছে। কেবল পেশাগত দায়িত্ব পালনের কারণে দেশে দেশে সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা ঘটছে। সৌদি আরবের সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে একটি বিদেশি দূতাবাসে হত্যা করা হলেও বিশ্বনেতারা কেবল নিন্দা জানানো ছাড়া আর কিছুই করেননি। তিনি উপস্থিত ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেরেমি হান্ট ও অন্যান্য রাজনীতিকদের উদ্দেশে বলেন, বিশ্বনেতারা কেবল বক্তব্য দিয়ে দায়িত্ব শেষ করতে পারে না। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার এমন দৈন্যদশার জন্য আন্তর্জাতিক আইনের ত্রুটিকে দায়ী করেন তিনি।

লন্ডনের কানাডা ওয়াটার এলাকার সুবিশাল ‘প্রিন্ট ওয়ার্কস’ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেরেমি হান্ট বলেন, এই সম্মেলন করেই যুক্তরাজ্য দায়িত্ব শেষ করবে না। বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষার প্রচারণায় তাঁর দেশ নেতৃত্ব দিয়ে যাবে। বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষায় পরবর্তী করণীয় হিসেবে পাঁচটি উদ্যোগের ঘোষণা দেন তিনি। এর মধ্যে আছে জাতিসংঘের নেতৃত্বে বৈশ্বিক ঐকমত্য গঠন এবং সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ ও আইনি সহায়তা প্রদানের ব্যবস্থা এবং যুক্তরাজ্যের তরফ থেকে ৩০ লাখ পাউন্ড বরাদ্দের ঘোষণা। তিনি বলেন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কোনো পশ্চিমা মূল্যবোধ নয়; এটি সর্বজনীন মূল্যবোধ। তিনি জানান, শতাধিক দেশ থেকে সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ এবং মানবাধিকার কর্মীরা এই সম্মেলনে অংশ নিয়েছে।

আফ্রিকার একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক নিজের চেহারা ঢেকে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন। তিনি নিজের ‍নিরাপত্তাহীনতার কথা তুলে ধরেন।

সম্মেলনে মত প্রকাশের স্বাধীনতায় আগামী এক দশকের চ্যালেঞ্জ এবং এসব মোকাবিলায় করণীয় নিয়ে জাতিসংঘের নেতৃত্বে একটি যৌথ ঘোষণা প্রকাশ করা হয়। এতে স্বাধীন মত প্রকাশের অনুকূল পরিবেশ তৈরি, ইন্টারনেটের সর্বজনীন ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং মত প্রকাশের কল্যাণকর নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

মত প্রকাশের স্বাধীনতা সুরক্ষায় ১৯৯৯ সাল থেকে কোনো সুনির্দিষ্ট চ্যালেঞ্জকে গুরুত্ব দিয়ে এমন যৌথ ঘোষণা দিয়ে আসছে জাতিসংঘ। তবে এই সম্মেলনকে উপলক্ষ করে দেওয়া এবারের ঘোষণায় মতপ্রকাশ ও গণমাধ্যমের সামগ্রিক চ্যালেঞ্জগুলোকে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।

কাউন্সিল ফর ল অ্যান্ড ডেমোক্রেসির টোবি মেনড্যাল বলেন, প্রযুক্তির বিকাশ এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আবির্ভাব সামনের দিনগুলোতে মতপ্রকাশ ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তার ক্ষেত্রে আরও বড় চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসবে। গণমাধ্যম এবং সরকারকে একসঙ্গে মিলেই এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।

পাবলিক মিডিয়া অ্যালায়েন্সের প্রধান নির্বাহী স্যালি এন উইলসন বলেন, কার্যকর গণতন্ত্রের অন্যতম অনুষঙ্গ হলো গণমাধ্যমের স্বাধীনতা। গণমাধ্যম স্বাধীন না হলে মানুষ তথ্যের জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, যা কোনো দেশের স্থিতিশীলতার জন্য সহায়ক নয়।

‘গণমাধ্যমের মালিকানার ওপর গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নির্ভরশীল: বিতর্ক’-শীর্ষক এক সেশনে একাধিক বক্তা বলেন, যারা প্রকৃত সাংবাদিকতার পক্ষে, তারা ভয়ে বিনিয়োগ করতে পারছেন না। কিন্তু অসাধু ব্যক্তিরা ভিন্ন উদ্দেশে গণমাধ্যমে বিনিয়োগ করছেন। এটিও সাংবাদিকতার স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে।

ফিলিপাইনের র‍্যাপলার অনলাইন নিউজের প্রধান নির্বাহী মারিয়া রেসা তাঁর দেশে গণমাধ্যমের ওপর প্রেসিডেন্ট দুতার্তের নিপীড়নের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, গণমাধ্যমেগুলোকে টিকে থাকতে হলে তথ্যের সত্যতার ওপর বেশি করে নজর দিতে হবে এবং সাহসের সঙ্গে সেটি প্রকাশ করতে হবে।

সম্মেলনের একটি সেশনে বাংলাদেশে ভিন্নমত দমনে সরকারের বলপ্রয়োগের অভিযোগ নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এক সাংবাদিক। জবাবে যুক্তরাজ্যের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী হ্যারিয়েট বল্ডউইন বলেন, বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে তিনি অবগত আছেন। বাংলাদেশ সরকারের কাছে যুক্তরাজ্য এসব বিষয়ে অবস্থান স্পষ্ট করেছে।

সম্মেলনের প্রথম দিনে গণমাধ্যমের চলমান রূপান্তর, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন গণমাধ্যমের গুরুত্ব, সাংবাদিকদের নিরাপত্তা এবং বিশ্বব্যাপী সাংবাদিক হত্যার বিচার না হওয়া সহ গণমাধ্যমের নানা চ্যালেঞ্জ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন সেশনে আলোচনা হয়।