ওরা আইএস, তাই চোখের জলে ছেড়ে গেলেন মা

ইয়াজিদি মা জিহান কাসেম। তিন সন্তানকে ছেড়ে আসার বিনিময়ে বাড়ি ফিরতে পারছেন তিনি। ছবি: এএফপি
ইয়াজিদি মা জিহান কাসেম। তিন সন্তানকে ছেড়ে আসার বিনিময়ে বাড়ি ফিরতে পারছেন তিনি। ছবি: এএফপি

বছরের পর বছর জঙ্গিদের হাতে বন্দী থাকার পর মুক্তি পেয়েছেন তিনি। তাঁর তো খুশি হওয়ারই কথা! কিন্তু তিনি খুশি হতে পারছেন না। ‘যৌন দাসত্ব’ থেকে মুক্তি লাভও তাঁকে আনন্দ দিতে পারছে না সন্তানদের কারণে। মুক্তির স্বাদ তিনি অনুভব করতে পারছেন না। জিহান কাসেম নামের এমন এক ইয়াজিদি নারীর মানসিক যন্ত্রণার কথা উঠে এসেছে বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে।

আজ শুক্রবার এএফপির ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসলামিক স্টেট বা আইএস জঙ্গিদের হাতে বন্দী ছিলেন ইয়াজিদি তরুণী জিহান কাসেম। সেখানে আইএস যোদ্ধার ঔরসে জন্ম নেয় তাঁর তিন সন্তান। এই সন্তানদের নিয়ে নিজ সম্প্রদায়ে গেলে কেউ তাঁদের গ্রহণ করবে না। দোটানায় জেরবার হতে হতে একসময় কঠিন সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। জিহান বলেন, ‘আমি তাদের সঙ্গে নিয়ে যেতে পারব না। তারা দায়েসের (আইএস) সন্তান।’ তাঁর তিন ভাইবোন এখনো আইএস জঙ্গিদের হাতে বন্দী বলে জানান জিহান।

জিহানের মতো এমন পরিস্থিতিতে আরও বহু ইয়াজিদি নারী। ইরাকের সিনজারে তাঁদের বাড়ি। ২০১৪ সাল থেকে তাঁরা আইএসের হাতে অপহরণের শিকার হয়ে হাতবদল হয়েছেন। ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, বারবার বিক্রি হয়েছেন, আইএস যোদ্ধাদের বিয়ে করতে হয়েছে, জন্ম দিতে হয়েছে সন্তান।

অনেকেই এখন মুক্তি পেয়েছেন। এই কয়েক বছরে মনের ভেতর যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে, তা পূরণে নিজেদের ভেতর তাগিদ বোধ করেন। কিন্তু সেই তাগিদ পর্যন্তই। আইএস যোদ্ধারা এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছে যে তাঁরা ভালো থাকার চেষ্টার কথা শুধু ভাবতে পারছেন, ভালো থাকতে পারছেন না।

জিহান যখন অপহরণের শিকার হয়েছিলেন, তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৩ বছর। ১৫ বছর বয়সে এক তিউনিসীয় যোদ্ধার সঙ্গে তাঁকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়। সিরিয়ার প্রতিরোধের মুখে চার মাস আগে বাগহুজ থেকে স্বামী–সন্তানের সঙ্গে পালিয়ে আসেন। জিহান ইয়াজিদি জানতে পেরে মার্কিন–সমর্থিত বাহিনী সিরিয়ার উত্তর–পূর্বের একটি আশ্রয়কেন্দ্রে তাঁকে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে তাঁর সঙ্গে ছিল দুই বছর বয়সী ছেলে, এক বছর বয়সী মেয়ে ও চার মাস বয়সী সন্তান।
নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্রটিকে ইয়াজিদি হাউস বলা হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে তাঁর ছবি প্রচার করার পর তাঁর বড় ভাই সামান হারিয়ে যাওয়া বোনকে শনাক্ত করেন। তিনি বোনকে বাড়ি ফিরিয়ে নিতে চান। কিন্তু নিতে চান না বোনের সন্তানদের।

দুশ্চিন্তায় জর্জরিত জিহান শুধু ভাবতেই লাগলেন, কী করবেন তিনি। একসময় সিদ্ধান্ত নিলেন, সন্তানদের ছেড়ে যাবেন। নিজের পরিবারে ফিরে যাওয়ার বিনিময়ে সন্তানদের রেখে যাবেন সিরিয়ার কুর্দি কর্তৃপক্ষের কাছে।

বিড়বিড় করে জিহান বলছিলেন, ‘ওরা এত ছোট। ওরা আমার সঙ্গে জড়িয়ে থাকত, আমিও ওদের সঙ্গে...কিন্তু ওরা দায়েস শিশু।’ তিনি জানান, সন্তানদের কোনো ছবি নেই তাঁর কাছে। সন্তানদের তিনি আর মনেও রাখতে চান না। বললেন, ‘প্রথম প্রথম কষ্ট হবে। এরপর কষ্ট কমে যাবে। একসময় ওদের ভুলে যাব।’

শতাব্দী ধরে ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের প্রথা হচ্ছে, কেউ গোত্রের বাইরে বিয়ে করলে বা গোত্রের অমতে বিয়ে করলে সমাজচ্যুত হতে হয়। ২০১৪ সালে আইএস ইয়াজিদি মেয়েদের অপহরণের পর ওই মেয়েদের সেই ভাগ্য বরণ করতে হয়। তাঁদের সমাজচ্যুত হতে হয়। তবে ইয়াজিদি ধর্মীয় নেতা বাবা শেখ সম্প্রতি এক মাইলফলক অধ্যাদেশ জারি করে জানান, আইএসের যৌন দাসত্ব থেকে মুক্ত মেয়েদের সম্প্রদায়ে সম্মানিত হতে হবে। তবে এটা প্রযোজ্য হবে না ইয়াজিদি নারীর গর্ভে জন্ম নেওয়া আইএস সন্তানদের জন্য।

গত এপ্রিল মাসে উচ্চ পর্যায়ের ইয়াজিদি ধর্মীয় কাউন্সিল এক অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে ইয়াজিদি মা ও আইএস বাবার সন্তানদের ঘরে ফিরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দেয়। তবে রক্ষণশীল গোষ্ঠীর ভয়াবহ প্রতিক্রিয়ায় শুধু ইয়াজিদি মা–বাবার সন্তানদের গ্রহণ করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়।

কাউন্সিলের প্রতিনিধি আলী খেদার জানান, ইরাকি আইন অনুসারে, বাবা নিখোঁজ এমন সন্তানদের মুসলিম বলে গণ্য করা হয়। বাবার ধর্মই হয় সন্তানের ধর্ম। ইয়াজিদি সম্প্রদায় তাদের মেয়েদের অপহরণের বিষয়টি নিয়ে এতটাই ভীত যে নির্যাতনের ফলে জন্ম নেওয়া সন্তানদের তারা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে মানসিকভাবে প্রস্তুত নয়। এখনো আইএসের হাতে বন্দী রয়েছেন হাজার হাজার ইয়াজিদি নারী। কেউ তাঁদের কথা জানতে চায় না। হাতে গোনা কয়েকটি শিশুর ব্যাপারে তারা জানতে চায়।

কাউন্সিল জানিয়েছে, মুক্তি পাওয়া ইয়াজিদি নারী এবং ধর্ষণের ফলে জন্ম নেওয়া শিশুদের পরিসংখ্যান রাখেনি তারা।
ইয়াজিদিদের ভাষায়, তাদের সম্প্রদায়ের চার হাজার বছরের দুর্ভোগের ইতিহাসে ২০১৪ সালে ৭৪তম ‘গণহত্যার’ ঘটনা ঘটে। এর সমাপ্তি ঘটেনি এখনো। হাজর হাজার নারী, পুরুষ, শিশু নিখোঁজ হয়েছে। মার্চে আইএসের পতনের পর তাদের খোঁজ পাওয়া যাবে বলে আশা করা হয়েছিল।
খেদার বলেন, গণহত্যার ঘটনা এখনো ঘটেই চলেছে। সিনজারে ফিরতে পারছে না ইয়াজিদিরা। নারীরা নিখোঁজ হচ্ছেন। প্রত্যেকে ইউরোপে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটছেন।

আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়া বেশির ভাগ ইয়াজিদি মা তাঁদের সন্তানদের ছেড়ে ফিরে যাচ্ছেন নিজ সমাজে। সেই সব সন্তানের কাউকে কাউকে ইরাকের বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে। এক ইয়াজিদি নারী এক বছর বয়সী সন্তানসহ বাড়ি ফেরার জন্য পরিবারের কাছে জোর দাবি জানিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি পারেননি। শেষ পর্যন্ত সন্তানকে দত্তক দিয়ে দেন।
১৮ বছর বয়সী আরেক তরুণী যখন মুক্তি পান, তখন তিনি সন্তান জন্ম দেওয়ার শেষ সময় পার করছিলেন। পরিবারের অজান্তে আশ্রয়কেন্দ্রে তাঁর সন্তান প্রসব করানো হয়। নবজাতকে রেখে দিয়ে সেই তরুণীকে ফেরত পাঠানো হয় পরিবারে।

এভাবে মায়ের কাছ থেকে সন্তানকে বিচ্ছিন্ন করার দীর্ঘস্থায়ী মানসিক প্রভাব পড়ছে। জিহানের মধ্যেই তা দেখা গেছে। একজন কর্মীর কাছে তিনি সন্তানদের দেখিয়ে দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘ওরা আমার রক্ত–মাংস। ওদের কথা আমার অনেক মনে পড়বে।’ এএফপির সঙ্গে যখন জিহানের কথা হচ্ছিল, তখন সন্তানদের কথা মনে করে তাঁর মুখে এক টুকরো হাসি খেলা করছিল। তাঁর ভাই একসময় সেখান থেকে সরে গেলে ভাইয়ের কান বাঁচিয়ে নিঃশব্দে কাঁদছিলেন। বললেন, ‘বিষয়টি আমার ওপর থাকলে আমি ওদের নিয়ে আসতাম।’