তাফিদার সুচিকিৎসায় সই দিন

তাফিদা
তাফিদা

যুক্তরাজ্যে লন্ডন রয়েল হাসপাতালে গভীর ঘুমে অচেতন শিশুটি। সে বাংলাদেশ ও ব্রিটেনের দ্বৈত নাগরিক। পাঁচ বছরের ফুটফুটে ওই শিশুর নাম তাফিদা। মস্তিষ্কের কঠিন অসুখে আক্রান্ত সে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলেছে, শিশুটি মারা গেছে। লাইফ সাপোর্ট খুলে তাকে দ্রুত দাফন করার পরামর্শ দিয়েছে তারা।

কিন্তু লাইফ সাপোর্ট খুলে ফেলা সহজ নয়। এটা খুলে ফেলতে তাফিদার বাবা-মায়ের সম্মতি দরকার। আর খুব স্বাভাবিক, তাফিদার বাবা-মা তাতে মত দিলেন না। তাঁরা বরং তাঁদের আদরের ধনকে কী করে ধরে রাখা যায়, সেই চেষ্টায় নামলেন। সন্তানের জীবন বাঁচাতে বাবা-মা কতটা কী করতে পারেন, এটি তারই একটি নতুন গল্প।

ব্যক্তিগত উদ্যোগে, বাবা-মা প্রথমে লন্ডনে ও পরে ইতালীয় নিউরোলজিস্টদের সঙ্গে পরামর্শ করলেন। তাঁরা কিন্তু লন্ডন রয়েল হাসপাতালের সিদ্ধান্তের সঙ্গে দ্বিমত করলেন। ইতালির চিলড্রেন হাসপাতাল খুব নামকরা। তারা রয়েল হাসপাতালের চিকিৎসকদের সঙ্গে এক ভিডিও কনফারেন্সেও যোগ দেন। সব বুঝেশুনে ইতালির চিকিৎসকেরা পাকাপাকিভাবে বললেন, তাফিদাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ইতালিতে আনা হোক। তাঁরা অবিলম্বে চিকিৎসা শুরু করতে চান।

কিন্তু অবাক বিষয়, এতে বাদ সাধল লন্ডন রয়েল হাসপাতাল। তারা বরং লাইফ সাপোর্ট খুলে শিশুটিকে সমাহিত করার পক্ষে। এমনকি এ জন্য তাফিদার বাবা–মাকে তারা রীতিমতো চাপ দিল। বিবৃতি দিল, অধিকতর চিকিৎসায় লাভ হবে না। চেষ্টা ব্যর্থ হবে।

তাফিদার দিশেহারা, বিহ্বল জননী, যিনি কিনা পেশাগতভাবে একজন দায়িত্বশীল সলিসিটার; তিনি লন্ডনের হাইকোর্টে তাঁর মেয়েকে ইতালিতে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি চেয়ে এক দরখাস্ত দিয়েছেন। বিরল এই মামলা করা হয়েছে ১৬ জুলাই। কিন্তু লন্ডনের সংবাদমাধ্যম ঘেঁটে বোঝা যায়নি, হাইকোর্টে কবে এর শুনানি হবে। তবে কেউ আশা করবেন না যে আদালতের সিদ্ধান্ত পেতে কোনো দীর্ঘসূত্রতার বিষয় ঘটবে।

আদালতের সিদ্ধান্ত যা–ই হোক, লন্ডনের রয়েল হাসপাতালের বিদ্যমান নীতি প্রশ্নবিদ্ধ। বিষয়টি এমন মোটেই নয় যে রয়েল হাসপাতাল কোনোমতেই কম দায়িত্বশীল বা কম বিচক্ষণ। প্রশ্নটি হলো বিশেষজ্ঞ জ্ঞানলব্ধ মতভিন্নতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা।

লন্ডনের স্বাধীন নিউরোলজিস্টারা বললেন, তাফিদার ‘ব্রেন ডেড’ ঘটেনি। সে আছে ‘ডিপ কোমায়’। এই চিকিৎসকেরা আরও বলছেন, ডিপ কোমা থেকে মানুষ ফেরে। তবে ডিপ কোমা থেকে ফিরতে কখনো এক বছরও গড়াতে পারে। তাফিদার বাবা-মা তাই লাইফ সাপোর্ট খোলার অনুমতি দেননি।

আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধি অনুযায়ী, বাবা-মা বা তাদের স্বজনদের আহাজারি কিংবা আবেগ নিশ্চয় লন্ডন রয়েল হাসপাতাল বা কেন হাসপাতাল বা কর্তৃপক্ষ বিবেচনায় নেবে না। কিন্তু এখানে প্রশ্নটি ভিন্নতর। কেউ হলফ করে অন্য বিশেষজ্ঞদের নাকচ করতে পারেন না। বিলাতের দ্য ইনডিপেনডেন্ট, বিবিসিসহ উল্লেখযোগ্য সংবাদমাধ্যমে শিশু তাফিদাকে নিয়ে সচিত্র খবর ছাপা হয়েছে। এসব খবর পড়েই এই লেখা।

তবে সার্বিক বিবেচনায় তাফিদার লাইফ সাপোর্ট খুলে নিতে তার বাবা-মাকে চাপ দেওয়ার যে নীতি, তার নৈতিকতার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে চিরকালের জন্য ফয়সালা হওয়ার দাবি রাখে।

লন্ডনের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসে কাছাকাছি ধরনের আরও দুটি ঘটনা আছে। শার্লি গার্ড ও আলফি ইভান্স তাফিদার মতোই মস্তিষ্কের রোগে আক্রান্ত ছিল। ২০১৭ সালে শার্লিকে তার অভিভাবকেরা নিউইয়র্ক সিটি হাসপাতালে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু চাপের মুখে ভেন্টিলেটর খোলার পরে ১১ মাস বয়সে মারা যায়। আলফিও যেতে পারেনি ইতালি। ভেন্টিলেটর খুলে ফেলার পরে সে পাঁচ দিন বেঁচে ছিল।

তাফিদার জীবন হতে পারে রূপকথার সেই রাজকন্যার মতো, যে কিনা ঠিক এক বছর পরে ঘুম থেকে জেগে উঠবে। তখন তার হয়তো সব মনে পড়ে যাবে, হয়তো সে সব ভুলে যাবে। আবার তাফিদার এই ঘুম হয়তো কখনো ভাঙবে না। তাফিদা দুরারোগ্য ব্যাধি আর্টিরিওভিনাস মালফরমেশনে (এভিএম) আক্রান্ত। গত ৯ ফেব্রুয়ারি ভোর সোয়া পাঁচটায় মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে আক্রান্ত হয় তাফিদা।

কিন্তু অনাগত দিনগুলোতে শারলি, আলফি ও তাফিদার মতো অন্য কারও ক্ষেত্রে হয়তো একই প্রশ্ন উঠবে। তাই মানবাধিকারের সব দাবিতেই শিশু তাফিদার চিকিৎসায় সম্পূর্ণতা টানা অপরিহার্য। লন্ডনের রয়েল হাসপাতাল লাইফ সাপোর্ট খুলে ফেলার অনুমতির আশায় তারাও ছুটেছে আদালতে।

পত্রিকায় দেখলাম, তাফিদার মা-বাবার বাড়ি সিলেটের বালাগঞ্জে। তাঁর আইনজীবী মা সেলিনা রাকিব মেয়েকে ইতালি নেওয়ার ছাড়পত্র নিতে ব্রিটেনে বাংলাদেশের হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনীমের সঙ্গে দেখা করে সহযোগিতা চেয়েছেন। তিনি লন্ডন সফররত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছেন। আমরা জানি না, তাফিদা দ্বৈত নাগরিকত্বের কারণে কোনো আইনি সুবিধা পাবে কিনা।

তবে এই লেখা যাঁরা পড়বেন, তাঁরা আমাদের একটি অনুরোধে সাড়া দিতে পারেন। ‘সিটিজেন গো ডট অরগ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান তাফিদার জন্য দরখাস্তে কমপক্ষে এক লাখ সই সংগ্রহের একটি উদ্যোগ নিয়েছে। তারা বলেছে, কমপক্ষে এক লাখ সই পেলে সেটা তাফিদার চিকিৎসা সম্পূর্ণতায় সহায়ক হবে। মানবিক কারণে এতে সাড়া দিতে সবার প্রতি অনুরোধ রেখেছেন তাফিদার মা সেলিনা রাকিব।

রাত নয়টার একটু আগে আমি সই করি। তখন ছিল ৬৮ হাজারের নিচে। রাত ১১টায় দেখি ৭২ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। আপনারা সই করে সংহতি প্রকাশ করুন।