শরণার্থী থেকে প্রেসিডেন্ট!

পাঁচ বছর বয়সী ভায়রা। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
পাঁচ বছর বয়সী ভায়রা। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

যুদ্ধবিধ্বস্ত লাটভিয়া থেকে পরিবারের সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিল ছোট্ট মেয়েটি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির নাৎসি বাহিনী ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যের দখলদারিতে পড়ে তার দেশ। ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে অন্য দেশে নির্বাসিত জীবন কাটাতে হয়েছে। যখন নিজ দেশে ফিরলেন, তখন তুমুলভাবেই ফিরলেন। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত লাটভিয়ার প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হন তিনি। শিশু শরণার্থী থেকে প্রেসিডেন্ট হওয়া এই নারীর নাম ভায়রা ভিকে-ফ্রেইবের্গা।

তবে জীবনের বড় একটি অংশ অন্য দেশে কাটালেও লাটভিয়ান হিসেবেই বড় হয়েছেন বলে জানিয়েছেন ভায়রা। বিবিসিকে তিনি বলেন, ‘আমার বাবা-মা কখনোই আমাকে ভুলতে দেননি যে আমি লাটভিয়ান।’

১৯৪১ সালের জুলাই মাসে জার্মানরা লাটভিয়ায় ঢুকে পড়ে এবং অনেক সোভিয়েতকে বন্দী করে। ছোটবেলায় দেশের উত্তাল পরিস্থিতির কিছু কিছু বেশ মনে আছে ভায়রার। বিশেষ করে ১৯৪৪ সালের কথা। ওই সময় তাঁর বয়স ছিল ছয় বছর। রাশিয়ার সেনাদল কমিউনিস্ট রেড আর্মি লাটভিয়ায় ফিরে এল।

ওই সময়ের কথা বলতে গিয়ে ভায়রা বলেন, ‘লাল পতাকা ও মুঠিবদ্ধ হাতের সেনাদের দেখে অভিভূত হতাম। তাদের কেউ কুচকাওয়াজ করার সময় পতাকা হাতে হাত মুঠিবদ্ধ করলে আমিও আমার হাত উঁচিয়ে মুঠি করে চিৎকার করে বলতাম “হুররে!” ওই সময় মাকে দেখতাম ল্যাম্পপোস্টে হেলান দিয়ে অসহায় ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকতেন। তাঁর গাল বেয়ে নামত অশ্রু। বলতেন, না মা, এটা কোরো না। লাটভিয়ার জন্য আজ খুব কষ্টের দিন।’

ভায়রা মনে করতে পারেন, ওই সময় বাবা রেডিওতে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস শুনতেন। যুদ্ধ কোন দিকে মোড় নিচ্ছে, তা বোঝার চেষ্টা করতেন। একপর্যায়ে তিনি লাটভিয়া ছেড়ে যাওয়ার কঠিন সিদ্ধান্ত নিলেন।

১৯৪৯ সালে জার্মানির শরণার্থীশিবিরে ভায়রা। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
১৯৪৯ সালে জার্মানির শরণার্থীশিবিরে ভায়রা। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

সাত বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে ভায়রা লাটভিয়া ছাড়েন। প্রথমে যুদ্ধবিধ্বস্ত জার্মানি, পরে ফ্রান্সশাসিত মরক্কো এবং তারও পরে কানাডায় গেলেন। ১৯৯৮ সালে ৬০ বছর বয়সে তিনি দেশে ফিরে আসেন। এর আট মাসের মধ্যে তিনি প্রেসিডেন্ট হন।

বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে শরণার্থীজীবনের কথা বলতে গিয়ে ভায়রা বলেন, ‘১৯৪৫ সালে নববর্ষের রাতে জাহাজে উঠি আমরা। ওটা একটা পণ্যবাহী জাহাজ ছিল। রণসজ্জায় সজ্জিত সৈন্যরা ছিল। তবে জাহাজটিতে কিছুসংখ্যক বেসামরিক লোকজনকে নেওয়া হয়েছিল, যাঁরা যেকোনো মূল্যে সমাজতন্ত্রের শাসন থেকে পালাতে চান। লাটভিয়ানরা জাহাজের ডেকে জড়ো হয়ে বসতেন এবং লাটভিয়ার জাতীয় সংগীত গাইতেন।’

ভায়রার পরিবার প্রথমে জার্মানির শরণার্থীশিবিরে গিয়ে আশ্রয় নেয়। তখন পরিস্থিতি খুবই খারাপ ছিল। তাঁর ১০ মাস বয়সী ছোট বোন নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। এর এক বছরের মধ্যে ভায়রার মা একটি ছেলেসন্তানের জন্ম দেন। ওই বয়সেই জীবনের কঠিন দিকটি দেখা হয়ে যায় ভায়রায়। তাঁর মায়ের সঙ্গে একই কক্ষে ১৮ বছর বয়সী একটি মেয়ে থাকত। ওই মেয়েটি একটি মেয়েসন্তানের জন্ম দেন। রুশ সৈন্যদের গণধর্ষণের কারণে তিনি অন্তঃসত্ত্বা হওয়ায় শিশুসন্তানটিকে সহ্য করতে পারতেন না। চেহারাও দেখতে চাইতেন না। নার্সরা শিশুটিকে নিয়ে এলে দেয়ালের দিকে পাশ ফিরে শুয়ে কাঁদতেন। নার্সরাই পরে শিশুটির নাম ভায়রার মৃত বোন মারার নামে রাখেন।

মরক্কোতে ১১ বছর বয়সী ভায়রা। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
মরক্কোতে ১১ বছর বয়সী ভায়রা। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

সেই ঘটনা বলতে গিয়ে ভায়রা বলেন, ‘এক মারা জন্ম নিয়েছে, বাঁচার লড়াই করছে এবং এই পৃথিবীতে অনাকাঙ্ক্ষিত। আর আমাদের মারা, যাকে আমরা প্রচণ্ডভাবে চেয়েছিলাম, যাকে আমাদের কাছ থেকে নিয়ে যাওয়া হলো। আমি উপলব্ধি করলাম, জীবন সত্যি খুব অদ্ভুত এবং অন্যায্য।’

১১ বছর বয়সে ভায়রার পরিবার জার্মানি থেকে মরক্কোতে চলে যায়। মধ্যরাতে একটি ট্রাক থেকে ছোট একটি গ্রামে নামিয়ে দেওয়া হয় তাঁদের। ওই গ্রামটাই যেন ছিল একটি মিনি বিশ্ব। ফরাসি, ইতালীয়, রাশিয়ার পুরোনো অভিবাসীরা ছিল। একদিন বাবার এক আরব সহকর্মী শিশু ভায়রাকে বিয়ে করার প্রস্তাব করেন।

বাবা বাড়িতে ফিরে মাকে সেই প্রস্তাব নিয়ে বলছিলেন, ‘তিনি (আরব সহকর্মী) বিয়ের যৌতুক হিসেবে ১৫ হাজার ফ্রাঁ দিতে চেয়েছেন। সেই সঙ্গে দুটো গাধা ও বাছুর। পরে তিনি যৌতুকের অর্থ আরও বাড়াতে থাকেন। আমি তাঁকে বললাম, মেয়ে তো বাচ্চা, ওর স্কুল আছে। সেটা শুনে তিনি বললেন, ঠিক আছে, আমরা তাকে (ভায়রা) স্কুল শেষ করতে দেব।’ এই আলোচনা করে বাবা-মা হাসছিলেন। কিন্তু ভায়রা সতর্ক হয়ে যান। ভয় ঢুকে যায় তাঁর মনে।

১৯৫৭ সালে ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোতে ভায়রা। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
১৯৫৭ সালে ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোতে ভায়রা। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

এরপর ভায়রার পরিবার কানাডায় যেতে সক্ষম হয়। ওই সময় ভায়রার বয়স ছিল ১৬ বছর। তিনি একটি ব্যাংকে চাকরি নেন। পাশাপাশি রাতের স্কুলে পড়াশোনা চালিয়ে যান। পরে ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোতে তিনি পড়েছিলেন। সেখানে লাটভিয়া থেকে আরেক নির্বাসিত ইমান্টস ফ্রেইগবার্গের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। তাঁরা বিয়ে করেন।

ভায়রা মনোবিজ্ঞানে পড়তেন। ১৯৬৫ সালে তিনি পিএইচডি করেন। তবে পড়াশোনার বিভাগ বাছাইয়ে তিনি তত মনোযোগী ছিলেন না বলেন জানান। এ ব্যাপারে মজার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, রেজিস্ট্রারের কাছে রাখা বিভিন্ন বিষয়ের দীর্ঘ তালিকায় নজর বুলাতে বুলাতে একটি লম্বা শব্দের ওপর তাঁর চোখ আটকায়। শব্দের শুরুটা ‘পি’ দিয়ে আর শেষ ‘ওয়াই’ অক্ষর দিয়ে। তিনি তাতে আঙুল রেখে বলেন, ‘স্যার, এই বিষয়টি নিতে চাই।’

ভায়রা খুব দ্রুত জেনে যান, মেয়েদের অভ্যর্থনা জানানোর বদলে সবকিছু সহ্য করেই যেতে হয়। একদিন এক অধ্যাপক এক সেমিনারে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক এক বক্তব্য রাখেন। ভায়রা বলেন, ‘আমাদের প্রিয় অধ্যাপক বলছিলেন, এই পিএইচডি প্রোগ্রামে আমাদের তিনজন বিবাহিত নারী আছেন। এটা অপচয় ছাড়া কিছু নয়। কারণ, তাঁরা বিয়ে শাদি করে সন্তান নেবেন। সত্যিকারের বিজ্ঞানী হতে পারত—এমন একটি ছেলের জায়গা তাঁরা নিয়ে নিয়েছেন।’

ভায়রা জানান, ওই সেমিনারে উপস্থিত সব মেয়ে সারা জীবন অধ্যাপকের ওই কথাগুলো মনে রেখেছিলেন। ওই মেয়েরা সংকল্প করেছিলেন, অধ্যাপককে দেখিয়ে দেবেন, তাঁর প্রিয় ছেলেদের চেয়েও নারীরা সফল হতে পারেন।

২০০৩ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর স্বামীর সঙ্গে ভায়রা। ছবি: এএফপি
২০০৩ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর স্বামীর সঙ্গে ভায়রা। ছবি: এএফপি

ভায়রা ইউনিভার্সিটি অব মন্ট্রিয়েলে ৩৩ বছর শিক্ষকতা করেন। তিনি পাঁচটি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারেন। বই লিখেছেন ১০টি। ১৯৯৮ সালে ৬০ বছর বয়সে তিনি প্রফেসর ইমেরিটাস হন এবং অবসরের সিদ্ধান্ত নেন। ওই সময় এক সন্ধ্যায় তাঁর ফোন বেজে ওঠে। ফোনের অপর প্রান্তে ছিলেন লাটভিয়ার প্রধানমন্ত্রী। তিনি ভায়রাকে লাটভিয়ার একটি নতুন ইনস্টিটিউটের প্রধান হওয়ার প্রস্তাব করেন। তবে দেশে ফিরে খুব শিগগির নিজেকে লাটভিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দৌড়ে দেখতে পান তিনি। নির্বাচনে লড়তে নিজের কানাডীয় পাসপোর্ট হস্তান্তর করেন। দেশে ফেরার মাত্র আট মাসের মধ্যে তিনি লাটভিয়ার প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

তাঁর পক্ষে ব্যাপক সমর্থন থাকলেও সমালোচনাও কম হয়নি। কিছু সংবাদমাধ্যমে সমালোচনা করা হয়, তিনি অপব্যয়ী, সুবিধাভোগী। সারা জীবন পশ্চিমে বিলাসিতায় জীবন কাটিয়েছেন। তবে এসব অভিযোগকে বানোয়াট বলেছেন ভায়রা। ২০০৩ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তিনি।

২০০৭ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ভায়রার দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ হয়। কয়েক মাস আগে ৭০ বছরে পা রেখেছেন। সাবেক নেতাদের নিয়ে গড়ে তোলা ক্লাব দে মাদ্রিদের সহপ্রতিষ্ঠাতা তিনি। সংস্থাটি গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব ও সুশাসনের লক্ষ্যে কাজ করে। তিনি নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টিতে বেশি জোর দিয়ে থাকেন।

কানাডায় নারীবিদ্বেষী সেই অধ্যাপককে এখনো খুঁজে ফেরেন ভায়রা। যদিও জানেন, এ যুদ্ধ জয়ে এখনো বহু পথ বাকি।