সোনিয়ার প্রত্যাবর্তন, প্রশ্নবিদ্ধ রাহুল

সোনিয়া গান্ধী ও রাহুল গান্ধী
সোনিয়া গান্ধী ও রাহুল গান্ধী

আর কিছু হোক না হোক গতকাল শনিবার গভীর রাতে দেশের আনাচকানাচে এখনো অবশিষ্ট কংগ্রেস নেতা ও কর্মীরা নিশ্চিন্তে নিদ্রা গিয়েছেন। দিনভর দমবন্ধ অবস্থায় থেকে মাঝরাতে তাঁরা হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন এই ভেবে যে আর অন্তত দলটাকে স্কন্ধকাটা হয়ে থাকতে হবে না। কিছুকালের জন্য হলেও সোনিয়া গান্ধী ভরসা জোগাবেন।

কংগ্রেসিদের এই যে পরনির্ভরতা, নেহরু-গান্ধী পরিবারের প্রতি এই যে অন্ধ আনুগত্য ও বশ্যতা, আপাতদৃষ্টিতে তা সমর্থনযোগ্য নয় মনে হলেও এটাই তাঁদের একে অন্যকে জড়িয়ে বেঁচে থাকার অনুঘটক। এই মানসিকতা কখনো-সখনো ব্যাখ্যার অতীত মনে হতে পারে, কিন্তু সত্য হলো, কংগ্রেস এখনো যেটুকু অবশিষ্ট আছে, তা ওই অন্ধ আনুগত্যের জন্যই। এটা যদি প্রথম সত্য হয়, দ্বিতীয় সত্য তাহলে পারিবারিক এই আনুগত্য ও পরনির্ভরতাই হয়ে দাঁড়িয়েছে সোয়া শ বয়সী প্রাচীন এই দলের ক্ষয়ে যাওয়ার কারণ।

কংগ্রেসকে আচমকাই এভাবে অকূলপাথারে ফেলে দেওয়ার কোনো কারণ অবশ্য ছিল না। রাহুল গান্ধী সভাপতির পদ গ্রহণের পর এক থেকে দেড় বছর যথেষ্ট পরিশ্রম করেছিলেন। বিভিন্ন বিষয়, যা দেশ ও সমাজকে প্রভাবিত করেছে, সেগুলো নিয়ে সরব হয়েছিলেন। হতাশা কাটিয়ে দলে কিছুটা হলেও জীবন ফিরিয়ে আনতে পেরেছিলেন। পেরেছিলেন বলেই গুজরাত বিধানসভার ভোটে বিজেপির আসন এক শর নিচে নামিয়ে কংগ্রেসের আসন আশির কাছাকাছি নিয়ে গিয়েছিলেন। মরা গাঙে স্রোত কিছুটা হলেও ফিরিয়ে আনতে পেরেছিলেন বলেই রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ে বিজেপির মৌরসিপাট্টা ভেঙে কংগ্রেসের তেরঙা উড়েছিল। সেই প্রথম রাহুলকে সবাই ‘প্রাপ্তবয়স্ক’ ভাবতে শুরু করে। এমনকি বিজেপিও তাঁকে গুরুত্ব দিতে থাকে। একটা সময় এই ধারণা গেড়েও বসেছিল যে লোকসভার ভোটে না হারলেও বিজেপি বড় একটা হোঁচট খাবে। ঠিক তখনই প্রবল বুদ্ধিধর বিজেপি নেতৃত্ব নির্বাচনী ন্যারেটিভটাই বদলে দেয় জাতীয়তাবাদের ধ্বজা তুলে ধরে। ৪৪ থেকে মাত্র ৫২-তে পৌঁছে রাহুল যা করলেন, সেটাই ছিল মারাত্মক ভুল। বিপর্যয়ের সব দায় নিজের ঘাড়ে নিয়ে গোস্‌সা করে ঘরে কপাট এঁটে থাকা আর যা–ই হোক, প্রকৃত নেতাসুলভ আচরণ অবশ্যই ছিল না। রাহুলের উচিত ছিল ধাক্কা কাটিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে নতুন উদ্যমে লড়াই শুরু করা। প্রকৃত নেতা হিসেবে নিজেকে মেলে ধরা। কিন্তু তিনি পালিয়ে গেলেন! ভীরুর মতো নিজেকে সরিয়ে নিলেন। শুধু তা–ই নয়, যুক্তির চেয়ে আবেগকে বেশি প্রশ্রয় দিয়ে হুকুম জারি করলেন, গান্ধী পরিবারের বাইরের কাউকে দলের দায়িত্ব দেওয়া হোক। এবং এভাবে গোঁ ধরে কাটিয়ে দিলেন প্রায় আড়াই মাস।

কিন্তু হলোটা কী? গ্রামবাংলায় একটা কথা চালু আছে, ‘সেই মল খসালি, শুধু লোক হাসালি’। আড়াই মাস পর ওয়ার্কিং কমিটির ম্যারাথন মিটিংয়ের পর যা প্রসব হলো, তাতে এখন কোথায় মুখ লুকোবেন রাহুল গান্ধী? কার মুখ পুড়ল সোনিয়া গান্ধীকে অন্তর্বর্তীকালীন সভাপতি করায়? এ–ই যদি হওয়ার ছিল, তাহলে আড়াই মাস কেন শুধু শুধু অপেক্ষায় রাখা হলো? হতাশাকে প্রশ্রয় দেওয়া হলো? কেন দলত্যাগীদের এ কথা বলার সুযোগ দেওয়া হলো যে নেতৃত্বের সিদ্ধান্তহীনতাই তাঁদের দলত্যাগের কারণ? এখন যদি রাহুলকে প্রশ্ন করা হয়, গান্ধী পরিবারের বাইরের কাউকে বেছে নেওয়ার যে নিদান তিনি দিয়েছিলেন, কেন এবং কোন যুক্তিতে তার সঙ্গে আপস করলেন? কী উত্তর দেবেন তিনি? রাহুলকে এসব কিল এখন হজম করতেই হবে। কারণ, নিজের ডিফেন্স তিনি নিজেই ভেঙে ফেলেছেন।

সোনিয়া গান্ধীর এই প্রত্যাবর্তন নতুন করে বোঝাল, নেহরু-গান্ধী পরিবারকে মাচার মতো ব্যবহার করেই কংগ্রেস নামক লাউগাছটি বেঁচে আছে, থাকতে চায়, ফলবতীও হয়। এ এক অদ্ভুত মানসিকতা। এই মানসিকতা ভালো না মন্দ, তা বিচার করার অধিকারী একমাত্র কংগ্রেসিরাই। রাজ্যে রাজ্যে সেই কংগ্রেসিরা যদি এতশত পরেও ওইভাবে মাচা আঁকড়ে পরিচিত হতে চায়, তাহলে তার ভালোমন্দের দায় তাদেরই। তারা মনে করছে, নেতৃত্বদানের ক্ষমতা পরিবারের হাত থেকে চলে গেলে এক থাকার অনুঘটকটাই হারিয়ে যাবে। রাজ্যে রাজ্যে মাথাচাড়া দেবে গোষ্ঠপতিরা। দলটা হয়ে যাবে ছিন্নভিন্ন। এই ধারণা কংগ্রেসের ওপর কেউ জোর করে চাপিয়ে দেয়নি। কংগ্রেসিরা নিজেরাই সানন্দে এই পরনির্ভরতাকে কোল পেতে দিয়েছে।

পরিবারতন্ত্রের এই মানসিকতা থেকে দেশের বামপন্থী দলগুলো প্রায় মুক্ত। আর কিছুটা মুক্ত বিজেপি। দলগতভাবে বিজেপি মুক্ত রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের (আরএসএস) দৌলতে। যদিও আঞ্চলিক নেতারা সবাই পরিবারতন্ত্রকে ‘দূর হটো’ বলার সাহস দেখাতে পারেননি। সংঘও তাকে প্রশ্রয় দিয়েছে। কংগ্রেসে যেমন নেহরু-গান্ধী পরিবারই প্রথম ও শেষ কথা, বিজেপিতে তেমনই আরএসএস। পার্থক্য একটাই। সংঘ তার নীতি ও আদর্শ অনুযায়ী দলকে চালনা করে, কংগ্রেস চালিত হয় নেহরু-গান্ধী পরিবার নামক হাইকমান্ডের স্বার্থ ও ইচ্ছানুযায়ী।

কংগ্রেস সভানেত্রী হিসেবে সোনিয়ার প্রত্যাবর্তন সেই নিরিখে মন্দের ভালো। দলনেত্রী হিসেবে তাঁর রেকর্ড দীর্ঘতম। দল ও জোটের নেতারা তো বটেই, জোটের বাইরে বিজেপিবিরোধী দলগুলোর কাছেও তাঁর নেতৃত্ব গ্রহণযোগ্য। কংগ্রেসের প্রবীণ ও নবীন দুই প্রজন্মের কাছেও তাঁর গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নাতীত। তিনি ধৈর্যশীল এবং বিচক্ষণ। বছরখানেকের জন্য তাঁকে সভাপতি হিসেবে মেনে নেওয়ার মধ্য দিয়ে কংগ্রেসও সাংগঠনিক নির্বাচনের প্রস্তুতির সময়টা পেয়ে যাচ্ছে। গান্ধী পরিবারের বাইরের কাউকে সভাপতি করার গোঁয়ের সঙ্গে আড়াই মাসের মধ্যে যে রাহুল গান্ধী আপস করতে পারেন, তিনি যে এক বছর পর নির্বাচিত সভাপতি হতে মত দেবেন না, তা জোর দিয়ে বলা যায় না। তাঁর এই মতবদল ও ভোলবদল সেই সম্ভাবনাকেই উজ্জ্বল করে তুলছে।

গান্ধী পরিবারের বাইরে কংগ্রেসের রাশ চলে গেলে দলটা এক রাখা কঠিন। তেমন হলে বিজেপির পোয়াবারো। রাহুলের হাতে দল থাকলেও বিজেপি নিশ্চিত। বিজেপির রথ যেভাবে গড়গড়িয়ে চলছে, তাতে গান্ধী পরিবার অথবা অন্য কারও কান্ডারি হওয়ায় তাদের কোনো ক্ষতি-বৃদ্ধি নেই। কংগ্রেস তো বটেই, ২০২৪–এর ভোট নিয়েও তারা ভাবিত নয়। তারা ঠুলি পরা ঘোড়ার মতো টগবগিয়ে এগিয়ে চলেছে নিজেদের বহু প্রাচীন ঘোষিত কর্মসূচিগুলো সাকার করতে। সংবিধানের ৩৭০ ধারার অবলুপ্তি (কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা রদ) ঘটে গেছে। সারা দেশে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির প্রচলনে এক ধাপ এগিয়ে গেছে তিন তালাক বিল পাস করিয়ে। বাকি রয়েছে অযোধ্যায় রাম মন্দির স্থাপন। সুপ্রিম কোর্ট যেভাবে গতি বাড়িয়েছে, তাতে চূড়ান্ত রায় এই বছরেই আসার কথা। সংখ্যাগরিষ্ঠের মেরুকরণ হয়ে গেলে কংগ্রেসের হাল কার হাতে গেল, তা নিয়ে বিজেপির মাথাব্যথার কোনো কারণ থাকবে কি?