বেয়ার গ্রিলসের সঙ্গে জল-জঙ্গলে মোদির দুঃসাহসিকতা

ভারতের অনেক দর্শক গতকাল রাতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অংশ নেওয়া ‘ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড’ অনুষ্ঠান উপভোগ করেন। ছবি: এএফপি
ভারতের অনেক দর্শক গতকাল রাতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অংশ নেওয়া ‘ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড’ অনুষ্ঠান উপভোগ করেন। ছবি: এএফপি

দুঃসাহসী অভিযাত্রী বেয়ার গ্রিলসের আলোচিত অনুষ্ঠান ‘ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড’। একা একা জল-জঙ্গলে দুঃসাহসী সব কর্মকাণ্ড করে বেড়ান তিনি। এবার এই দুঃসাহসী অভিযানের সঙ্গী করেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে। মোদির সঙ্গে তাঁর জলে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানোর অনুষ্ঠান ‘ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড উইথ বেয়ার গ্রিলস অ্যান্ড প্রাইম মিনিস্টার মোদি’ গতকাল সোমবার রাতে প্রচার করে ডিসকভারি চ্যানেল।

আগে থেকেই ব্যাপক প্রচারের কারণে ভারতের বিপুলসংখ্যক দর্শক অনুষ্ঠানটি উপভোগ করেছে। আর বিষয়টি বুঝতে পেরে মোদিও পুরো অনুষ্ঠানে নিজের ব্র্যান্ডিং করতে ভুল করেননি। তিনি যে ভিতু নন, তিনি যে সামনে থেকে কঠিন বিপদেও মাথা ঠান্ডা রেখে জাতিকে এগিয়ে নিতে পারেন—সেই ধারণা জোরালোভাবে দিতে চেয়েছেন নিজের দেশের জনগণকে। আর বিশ্বকে বলেছেন, ভারত আদিকাল থেকেই প্রকৃতির কাছাকাছি থাকে। পুরো দুনিয়াটাই একটা পরিবার। আর একে রক্ষা করা সব মানুষের দায়িত্ব।

অনুষ্ঠানের শুরুতেই দেখা যায়, ভারতের উত্তরাখন্ডের জিম করবেট জাতীয় উদ্যানে মোদির জন্য অপেক্ষা করছেন বেয়ার গ্রিলস। প্রধানমন্ত্রী মোদিকে বহনকারী গাড়ি সেখানে আসতেই তাঁকে স্বাগত জানান বেয়ার গ্রিলস। এরপর দুজনে মিলে বাঘ, সিংহসহ অসংখ্য হিংস্র প্রাণীর অভয়ারণ্যে হাঁটতে শুরু করেন। পথে চলতে চলতে তিনি বেয়ার গ্রিলসকে শোনান নিজের জীবনের নানা গল্প, দর্শন, পরিবেশ, প্রকৃতি সংরক্ষণ, জলবায়ু পরিবর্তনের সংকট ও পর্যটনের সম্ভাবনার কথা।

বেয়ার গ্রিলসের সঙ্গে কথোপকথনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শুনিয়েছেন ছোটবেলায় বাড়ির কাছের জলাশয় থেকে কুমিরছানা ধরে আনার গল্প। তখনই এল ভয় আর স্নায়ুচাপের প্রসঙ্গ। স্পষ্ট ভাষায় মোদি জানিয়ে দেন, স্নায়ুচাপ কখনো তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতার অংশ নয়। তাঁর ভাষায়, ‘আমার কখনো ভয়ের অভিজ্ঞতা নেই। স্নায়ুচাপ কী, এটা আমি মানুষকে ব্যাখ্যা করতে পারব না। কারণ আমার এই অভিজ্ঞতা নেই। আমি ভেতর থেকে খুবই ইতিবাচক। আমি সবকিছু ইতিবাচকভাবে দেখি। আর এ কারণে আমি কখনো হতাশ হই না।’

এর মধ্যেই ‘বাঘ এলে কাজ লাগবে’ বলে বেয়ার গ্রিলস হাতে বানানো বল্লম ধরিয়ে দেন মোদিকে। মোদি তখন বলেন, ‘আমি যে সংস্কৃতিতে বড় হয়েছি, তাতে কাউকে মারতে পারব না।’ এমন উত্তর শুনে তখনই বল্লমটি ফেরত নিতে চান বেয়ার গ্রিলস। যদিও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর চটপট জবাব ছিল, ‘আপনার হয়ে আমি এটা আমার হাতেই রাখছি।’ বনে ভয়ের পরিবেশে ঘুরে বেড়ানোর সময় বেয়ার গ্রিলস যেকোনো সময় যেকোনো বিপদের মুখোমুখি হতে পারেন বলে শঙ্কা প্রকাশ করলে মোদি বলেন, ‘স্রষ্টা সবকিছু দেখভাল করেন।’

ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে বেয়ার গ্রিলসের করা ‘ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড’ অনুষ্ঠানের একটি চিত্র। ছবি: টুইটার
ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে বেয়ার গ্রিলসের করা ‘ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড’ অনুষ্ঠানের একটি চিত্র। ছবি: টুইটার

মোদি অকপটে দারিদ্র্যের মধ্যে কাটানো নিজের জীবনের গল্প বলেছেন। বলেছেন, তাঁর বাবা একজন চা-বিক্রেতা ছিলেন। বাবাকে সাহায্য করতে তিনিও চা বিক্রি করেছেন। দোকানের পাশাপাশি রেলস্টেশনে ঘুরে ঘুরেও চা বিক্রির কাজ করেছেন। তবে স্কুলের সময় স্কুলে গেছেন। এখনের মতো ছোটবেলায়ও পরিপাটি থাকতেন তিনি। কাঁসার বাটিতে গরম কয়লা নিয়ে সেই তাপে পোশাক ইস্ত্রি করতেন।

প্রকৃতির সঙ্গে ছোটবেলা থেকেই গভীর সম্পর্ক বলে বেয়ার গ্রিলসকে জানান মোদি। বলেন, তাঁর বাবা ২০-৩০টা পোস্টকার্ড কিনতেন। গ্রামের প্রথম বৃষ্টির খবর আত্মীয়দের লিখে পাঠাতেন। গুজরাটের খরায় বৃষ্টি যে প্রকৃতির কত বড় আশীর্বাদ, সেটা সেখান থেকেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। তরুণকালে আধ্যাত্মিক সাধনার উদ্দেশ্যে একা হিমালয়ে গিয়েছিলেন—সেটাও বলেছেন মোদি। তিনি বলেন, ‘প্রতিটি গাছ একটি ফুল। আমরা প্রতিটি গাছে স্রষ্টাকে দেখি।’

অনুষ্ঠান শেষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ছবি তোলেন ‘ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড’ অনুষ্ঠানের সঞ্চালক বেয়ার গ্রিলস। ছবি: টুইটার
অনুষ্ঠান শেষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ছবি তোলেন ‘ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড’ অনুষ্ঠানের সঞ্চালক বেয়ার গ্রিলস। ছবি: টুইটার

অনুষ্ঠানে দেখা যায়, হাতের কাছে পাওয়া উপাদান দিয়ে বানানো নৌকায় চড়ে প্রচণ্ড ঠান্ডা নদী পার হয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। এ সময় মোদির চোখে-মুখে ভয়ের ছাপ দেখা যায়নি। তিনি বেশ গল্প করতে করতে ওই নৌকায় করে নদী পার হন। পরিবেশ নিয়ে তিনি বলেন, ‘পরিবেশকে রক্ষা করা প্রতিটি মানুষের দায়িত্ব। তবে আমাদের জীবনযাপন এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা। আমাদের আনন্দের জন্য আমরা প্রকৃতিকে ধ্বংস করি। আর এটাই সব সমস্যার জন্ম দেয়।’

নতুন প্রজন্মের উদ্দেশে মোদি এই অনুষ্ঠানে বলেন, ‘আমি বলব, জীবনে উত্থান-পতন থাকবেই। পতনে ভয় পেয়ো না। কারণ, উত্থানের শুরুটা সেখান থেকেই।’ কখনো প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখেছেন কি না—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি সব সময় জাতির উন্নয়নের প্রতি জোর দিয়েছি। আমি প্রথমে একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলাম। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে আমি ১৩ বছর কাজ করেছি। সেটা আমার জন্য নতুন যাত্রা ছিল। এরপর দেশ আমাকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আমি এই দায়িত্ব পাঁচ বছর পালন করেছি। তবে সব সময় একটা বিষয়ের ওপরই জোর দিয়েছি, সেটা হলো উন্নয়ন। আমি আমার কাজে সন্তুষ্ট।’ তিনি অবকাশ যাপন করেন না জানিয়ে বলেন, ‘বলতে গেলে গত ১৮ বছরে এই প্রথম আমি অবকাশে এলাম।’

অনুষ্ঠানের একপর্যায়ে হাতের কাছে পাওয়া উপাদান দিয়ে বানানো নৌকায় শীতল পানির নদী পার হন নরেন্দ্র মোদি। ছবি: টুইটার
অনুষ্ঠানের একপর্যায়ে হাতের কাছে পাওয়া উপাদান দিয়ে বানানো নৌকায় শীতল পানির নদী পার হন নরেন্দ্র মোদি। ছবি: টুইটার

অনুষ্ঠানের শেষ দিকে বেয়ার গ্রিলস মোদিকে ‘আইকনিক বিশ্বনেতা’ বলে উল্লেখ করেন। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ ভারত ও দেশটির প্রধানমন্ত্রী মোদির জন্য শুভকামনা জানান তিনি। এরপর বেয়ার গ্রিলস প্রধানমন্ত্রী মোদিকে অক্ষত অবস্থায় ‘সিক্রেট সার্ভিস’-এর লোকজনের হাতে তুলে দেন। এমন দুঃসাহসী অভিযাত্রায় অংশ নেওয়ায় মোদির খেলোয়াড়সুলভ মনোভাবের ভূয়সী প্রশংসা করেন বেয়ার গ্রিলস।

অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ টুইট করে প্রধানমন্ত্রীর ব্যাপক প্রশংসা করেন। তবে ওই উদ্যানে হেলিকপ্টার ও গাড়ি নিয়ে গিয়ে বন্য প্রাণীর অবাধ চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করেছেন বলে মনে করেন বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞরা। বন্য প্রাণী সংরক্ষণে পদ্মশ্রী পুরস্কারজয়ী প্রশান্ত কুমার সেন বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর এই অনুষ্ঠান নিছকই পর্যটনের প্রচার। এর সঙ্গে বন, বন্য প্রাণী সংরক্ষণের সম্পর্ক আছে বলে মনে হয় না।’ বাঘ বিশেষজ্ঞ বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী বলেন, ‘মোদি উল্টো বনের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করেছেন।’

ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে বেয়ার গ্রিলসের করা ‘ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড’ অনুষ্ঠানের একটি চিত্র। ছবি: টুইটার
ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে বেয়ার গ্রিলসের করা ‘ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড’ অনুষ্ঠানের একটি চিত্র। ছবি: টুইটার

মোদি বরাবরই চমক দেখাতে পছন্দ করেন। ধারণা করা হচ্ছে, এই অনুষ্ঠানেও তিনি এ কারণেই অংশ নিয়েছেন। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা দুঃসাহসী অভিযাত্রী বেয়ার গ্রিলসের সঙ্গী হয়েছিলেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমবান্ধব মোদি টুইটারে বেশ সক্রিয়। টুইটার তাঁর অনুসারী ৪ কোটি ৯০ লাখ। ৬৮ বছর বয়সী মোদি নিয়মিত যোগব্যায়াম করেন এবং সেই ভিডিও পোস্ট করতে পছন্দ করেন। ‘ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড’ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আবারও মানুষের কাছে নিজেকে সফলভাবে তুলে ধরার সর্বোচ্চ চেষ্টা করলেন মোদি।