যেভাবে রাস্তা থেকে ফোর্বসের তালিকায় তরুণ আলোকচিত্রী

ফোর্বসের ‘এশিয়া থার্টি আন্ডার থার্টি’ তালিকায় নাম এসেছে তরুণ আলোকচিত্রী ভিকি রায়ের। ছবি: ফেসবুক থেকে সংগৃহীত
ফোর্বসের ‘এশিয়া থার্টি আন্ডার থার্টি’ তালিকায় নাম এসেছে তরুণ আলোকচিত্রী ভিকি রায়ের। ছবি: ফেসবুক থেকে সংগৃহীত

ক্ষুধা মেটাতে অন্যের ফেলে যাওয়া খাবার খেতে হতো তাঁকে। মাথার ওপর ছাদ না থাকায় রাস্তায় কাটাতে হয়েছে বহু রাত। সেই রাস্তা থেকেই ভিকি রায় উঠে এসেছেন বিশ্ববিখ্যাত মার্কিন সাময়িকী ফোর্বসের তালিকায়। এশিয়া মহাদেশের ৩০ বছরের কম বয়সী তরুণ উদ্যোক্তাদের একটি তালিকা তৈরি করে ফোর্বস। রাস্তা থেকে উঠে এসে সেই তালিকাতেই নাম তুলেছেন ভিকি।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মুম্বাইভিত্তিক জনপ্রিয় ফেসবুক পেজ ‘হিউম্যানস অব বোম্বে’তে উঠে এসেছে ভিকির এই বিস্ময়কর উত্থানের গল্প। সুন্দর ভবিষ্যতের আশায় মাত্র ১১ বছর বয়সে ঘর ছেড়ে পালিয়ে দিল্লিতে চলে এসেছিলেন তিনি। ভিকি নিজেই শুনিয়েছেন সে কথা, ‘তিন বছর বয়সে আমার মা–বাবা আমাকে দাদুর কাছে রেখে যান। কিন্তু দাদু আমাকে প্রায়ই মারধর করতেন। প্রায়ই শুনতাম, সুন্দর ভবিষ্যতের আশায় অনেক মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসেন। সেই কারণে ১১ বছর বয়সে দাদুর থেকে অর্থ চুরি করে ট্রেনে উঠে দিল্লি চলে আসি আসি।’

দিল্লিতে ভিকির চেনাজানা কেউ ছিল না, ছিল না কোনো আত্মীয়স্বজন। যে কারণে রাস্তায়ই রাত কাটাতে হতো তাঁকে, খাবারের জন্য চেয়ে থাকতে হতো অন্যের দিকে। ভিকি বলেছেন, ‘দিল্লিতে এসে আমি অকূলপাথারে পড়ে যাই। বেঁচে থাকার জন্য আমাকে ট্রেনে পানি বিক্রি করতে হতো, প্রায়ই খোলা রাস্তায় রাত কাটাতে হতো। একটি বাসায় থালা-বাসন ধোয়ার কাজ করতাম। সারা দিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর রাতে কোনো খাবারও দিত না। লোকে খেয়ে যাওয়ার পর যা অবশিষ্ট থাকত, সেগুলোই খেতে হতো আমাকে।’

কিন্তু এই দুঃসময় বেশি দিন স্থায়ী হয়নি ভিকির। একটি বেসরকারি সংস্থার সহায়তায় জীবন পাল্টাতে শুরু করে ভিকির, ‘এত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকতে হতো, প্রায়ই অসুস্থ হয়ে যেতাম আমি। একবার চিকিৎসার জন্য এক চিকিৎসকের কাছে যাই। আমার অবস্থা দেখে উনি আমাকে একটি এনজিওর সন্ধান দেন। রাস্তার পরিত্যক্ত শিশুদের পুনর্বাসন নিয়ে কাজ করত সংস্থাটি। ওখানে গিয়ে আমার জীবন পাল্টাতে শুরু করে। তিনবার খাবার পেতে শুরু করি, নতুন কাপড় পেতে শুরু করি। তারা আমাকে স্কুলেও ভর্তি করে।’

তবে ভিকির জীবন সত্যিকার অর্থেই পাল্টাতে শুরু করে এক ব্রিটিশ আলোকচিত্রীর সংস্পর্শে আসার পর থেকে। ভিকি শুনিয়েছেন তাঁর আলোকচিত্রী হয়ে ওঠার গল্প, ‘একবার এক ব্রিটিশ আলোকচিত্রী আমাদের এনজিওতে আসেন। তাঁর কাজ দেখে আমি মুগ্ধ হই। রাস্তার মানুষের জীবন আমাকে এমনভাবে টানতে শুরু করে, যা আগে কখনো হয়নি। তখন থেকেই রাস্তার মানুষের দুর্দশার চিত্র আমি আমার ছবির মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করি।’

এনজিও থেকেই একটি ক্যামেরা পান ভিকি। সেই ক্যামেরা নিয়েই শুরু হয় তাঁর নতুন জীবনে পথচলা, ‘যখন আমার বয়স ১৮ হলো, এনজিও থেকে ৪৯৯ রুপি দিয়ে একটি ক্যামেরা কিনে দেওয়া হলো আমাকে। স্থানীয় একজন আলোকচিত্রীর অধীনে প্রশিক্ষণ নেওয়ার সুযোগও করে দেওয়া হয়। তিনিই আমার প্রথম প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করে দেন। এরপর থেকেই আমার জীবন পাল্টে যায়। লোকে আমার ছবি কিনতে শুরু করে, আর আমি বিশ্বজুড়ে ঘুরে বেড়াতে শুরু করি! আমাকে নিউইয়র্ক, লন্ডন, দক্ষিণ আফ্রিকা এমনকি সান ফ্রান্সিসকো থেকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়। আমি কখনোই ভাবিনি, আমার ভাগ্য এভাবে পরিবর্তিত হবে।’

ভিকির অর্জনের বাকি ছিল আরও। ২০১৪ সালে ‘এমআইটি মিডিয়া ফেলোশিপ’ পান ভিকি। আর ২০১৬ সালে জায়গা করে নেন ফোর্বসের ‘এশিয়া থার্টি আন্ডার থার্টি’ তালিকায়।

নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে অন্য তরুণদের পরামর্শও দিয়েছেন ভিকি। হাল না ছেড়ে নিজের স্বপ্নকে তাড়া করার পরামর্শই দিলেন তিনি, ‘আমি এটা বুঝতে পেরেছি, আমাদের সবার সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মানোর সৌভাগ্য হয় না। একসময় আমার হাতে কিছুই ছিল না। কিন্তু আমি এখন আমার স্বপ্নকে ছোঁয়ার খুব কাছাকাছি চলে এসেছি। শীর্ষে পৌঁছাতে হলে তাই ধৈর্য থাকতে হবে। বিশ্বাস রাখতে হবে, ঝড়ের পর সূর্যও ওঠে।’