সন্তানের কী দোষ ছিল, ইসরায়েলের কাছে জবাব চান বাবা

৯ বছরের আবদেল রহমানের শিয়রের কাছে বাবা ইয়াসির ইস্তেওয়ি। ছবি: এএফপি
৯ বছরের আবদেল রহমানের শিয়রের কাছে বাবা ইয়াসির ইস্তেওয়ি। ছবি: এএফপি

৯ বছরের ফিলিস্তিনি শিশুটি বিছানায় শুয়ে আছে। মাথায় ব্যান্ডেজ করা। এক মাসের বেশি সময় ধরে সে হাসপাতালে। এখনো কথা বলছে না। বিছানার পাশে উদ্বিগ্ন মুখে বাবা বসে আছেন। ছেলের দিকে তাকালে তাঁর বুকের ভেতর হু হু করে ওঠে। ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে তাঁর ছেলে আজ সংকটাপন্ন অবস্থায়। ছেলে বেঁচে আছে, তবে পুরোপুরি সুস্থ হবে কি না, তা নিয়ে চিকিৎসকেরা নিশ্চিত কিছু জানাননি। অনিশ্চয়তার ছাপ তাঁর চেহারায়। তাঁর একটাই প্রশ্ন, ছোট্ট ছেলেটি কী দোষ করেছিল? তিনি এর জবাব চান ইসরায়েলের কাছেই।

আজ শুক্রবার বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ফিলিস্তিনি এই শিশুর কথা। আবদেল রহমান নামের শিশুটি এখন ইসরায়েলের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। গত ১২ জুলাই পশ্চিম তীরের উত্তরাঞ্চলের কুফর কাদ্দাম গ্রামে ফিলিস্তিনি বিক্ষোভকারী এবং ইসরায়েলি বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষের সময় শিশুটি গুলিবিদ্ধ হয়। ইসরায়েলি সেনার গুলি লাগে আবদেলের মাথায়।

অভিযোগ উঠেছে, শিশুটিকে লক্ষ্য করেই গুলি করা হয়েছে। দুজন প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, সংঘর্ষের সময় শিশুটি ঘটনাস্থলের কাছাকাছি ছিল না। আবদেলের পরিবার এ ঘটনার শুরু থেকেই পূর্ণ তদন্তের দাবি জানিয়ে আসছে। পরিবারটির এ দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘের দূত নিকোলায় ম্লাদেনভ।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ইসরায়েলি সেনা কর্মকর্তা এএফপিকে জানিয়েছেন, এই ঘটনার তদন্ত চলছে। তবে তাঁর দাবি, শিশুটিকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়নি। ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় বরাবরের মতো সেদিনও রাবার বুলেট ছুড়েছে সেনারা। প্রাণঘাতী কোনো গুলি ছোড়া হয়নি। শিশুটি রাবার বুলেটে আহত হয়ে থাকতে পারে।
এদিকে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের দাবি, ইসরায়েলি সেনারা প্রাণঘাতী গুলি ছুড়েছিল। এই গুলিতেই আহত হয়েছে শিশু আবদেল।

আবদেলের পরিবারের আশঙ্কা, তার মস্তিষ্ক হয়তো স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আবদেলের বাবা ইয়াসির ইস্তেওয়ি জানালেন, খুব অল্প সময়ের জন্য জেগে ওঠে আবদেল। এরপরই গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। আবদেলকে গুলি করা নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে তিনি বলেন, ‘একজনের বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে আপনি গুলি করে দেবেন?’

ইসরায়েলি ভূখণ্ড থেকে মাত্র কয়েক শ মিটার দূরে কুফর কাদ্দাম গ্রাম। চার হাজার বাসিন্দার গ্রামটিতে ইস্তেওয়ি গোত্রের বসবাস। নাবলুস নগরীতে যেতে গ্রামটির প্রধান সড়ক ইসরায়েল কর্তৃপক্ষ বন্ধ রেখেছে। ২০০০ সালের শুরুতে দ্বিতীয় ফিলিস্তিন ইন্তিফাদা নামে পরিচিত রক্তাক্ত গণবিক্ষোভের পর এই সড়ক বন্ধ করে দেয় ইসরায়েল। হামলা প্রতিহত করতে সড়কটি বন্ধ রাখার কথা জানিয়েছে ইসরায়েল। সড়কটি খুলে দিতে কয়েক বছর ধরে এখানের বাসিন্দারা প্রতি শুক্রবার বিক্ষোভ প্রদর্শন করে আসছেন।

বিক্ষোভকারীরা সাধারণত টায়ার জ্বালিয়ে এবং ইসরায়েলি সেনাদের লক্ষ্য করে পাথর ছুড়ে বিক্ষোভ করে থাকেন। আর সেনারা তাঁদের ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট ছুড়ে। তবে সেনা ও প্রত্যক্ষদর্শীদের দেওয়া তথ্য অনুসারে, গত ১২ জুলাই গ্রামটির পূর্ব দিকে বিক্ষোভটি হঠাৎ ভয়াবহ আকার ধারণ করে।
বাসিন্দাদের দাবি, সেনারা সেদিন আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে।
অন্যদিকে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের দাবি, ফিলিস্তিনি বিক্ষোভকারীদের সহিংসতা মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। অন্যবারের তুলনায় মুখ ঢেকে রাখা বিক্ষোভকারীরা সংখ্যায় অনেক বেশি ছিলেন এবং অনেক বেশি সংখ্যক পাথর ছুড়ে মারা হচ্ছিল।

ফিলিস্তিনি শিশু আবদেল রহমান। ছবি: টুইটার
ফিলিস্তিনি শিশু আবদেল রহমান। ছবি: টুইটার

দুজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, সংঘর্ষের স্থানের ৩০০ মিটার ঘিরে কয়েকজন ফিলিস্তিনি বিক্ষোভকারী পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থান নেওয়া চারজন ইসরায়েলি সেনাকে লক্ষ্য করে পাথর ছুড়ছিলেন। ওই সময় আবদেল রহমান ইস্তেওয়ি নিচ থেকে ঘটনাটি দেখছিলেন। সে এক আত্মীয়ের বাড়ির দিকের প্রবেশদ্বারে দাঁড়িয়েছিল।
রিয়াদ ইস্তেওয়ি নামের একজন জানান, বিক্ষোভকারী যুবকদের চেয়ে দেড় শ মিটার দূরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে তিনি সংঘর্ষের ঘটনা দেখছিলেন। সঙ্গে তাঁর দুই শিশুপুত্রও ছিল। তিনি খেয়াল করেছিলেন, তাঁর কাছেই আবদেল দাঁড়িয়েছিল।
আরেকজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, ওখানে দাঁড়িয়ে আঙুর খাচ্ছিল আবদেল রহমান।

ঘটনার কিছু আগে গ্রামের প্রধান একটি দোকানের ক্লোজড সার্কিট (সিসি) টিভি ফুটেজে দেখা যায়, আবদেলের পরনে ছিল কালো শার্ট এবং পায়ে স্যান্ডেল। দোকানের মালিক জানান, আবদেল দোকান থেকে কমলা ও আনারস স্বাদের আইসক্রিম কিনেছিল।
রিয়াদ ইস্তেওয়ি বলেন, স্থানীয় সময় বেলা দুইটার পর তিনি দেখতে পান, একজন সেনা তাঁর দিকে অস্ত্র তাক করেছে। সেটা দেখেই তিনি দুই ছেলেকে নিয়ে দৌড়ে পালান। তিনি বলেন, ‘পাহাড় থেকে নিচের দিকে দৌড়াতে দৌড়াতে আমি লক্ষ্য করি, আবদেলকে গুলি করা হয়েছে। ফোয়ারার মতো রক্ত ছুটছে।’

একটি ভিডিওতে দেখা যায়, রিয়াদ ইস্তেওয়ি নিচে পড়ে থাকা আবদেলের রক্তাক্ত ছোট্ট দেহটি কোলে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে তুলছেন। জায়গাটি রক্তে ভেসে যাচ্ছে।

শিশুটি সংঘর্ষের কত কাছাকাছি ছিল প্রশ্ন করা হলে কোনো জবাব দেননি ইসরায়েলি কর্মকর্তা। ঘটনাটি তদন্তাধীন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা বলছি না যে ছেলেটি বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিল।’

তেল আবিবের কাছে সেবা মেডিকেল সেন্টার নামে একটি হাসপাতালে এখন চিকিৎসাধীন আবদেল। চিকিৎসক জানিয়েছেন, আবদেল চিকিৎসকের আঙুল শক্ত করে ধরতে পারে। তবে এখনো কথা বলতে পারে না।
ইসরায়েলের একটি মানবাধিকার সংগঠন জানিয়েছে, ঘটনাটি তদন্তের পর তারা নিশ্চিত হয়েছে যে ওই দিন আবদেলকে প্রাণঘাতী অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয়েছে।
আবদেলের পরিবারও তা–ই মনে করে। তবে চিকিৎসকেরা এ ব্যাপারে তাদের নিশ্চিত কোনো তথ্য দেয়নি বলে জানিয়েছে পরিবারটি।

সেবা হাসপাতালে স্থানান্তরের আগে আবদেলকে একজন ফিলিস্তিনি চিকিৎসক অস্ত্রোপচার করেছিলেন। তিনি এএফপিকে জানান, গুলিটি কপালের উপরিভাগে লেগেছে এবং মাথার ভেতরে অসংখ্য ফাটলের সৃষ্টি করেছে। ওথমান মোহাম্মেদ ওথমান নামের ওই চিকিৎসক জানান, এ ধরনের জখম তিনি ১৭ বছরের চিকিৎসাজীবনে প্রথম দেখেছেন। তবে বুলেটটি কী ধরনের ছিল, তা বলতে তিনি অস্বীকৃতি জানান।

ছেলের শিয়রের কাছে বসে রাত কাটান বাবা ইয়াসির ইস্তেওয়ি। অপেক্ষায় আছেন ছেলেকে নিয়ে চিকিৎসকেরা কোনো সুখবর দেন কি না। চিকিৎসকদের কাছে বারবার জানতে চান, কবে ছেলে সুস্থ হবে? ছেলে পুরোপুরি সুস্থ হবে তো? তিনি বলেন, ‘আমি ডাক্তারদের জিজ্ঞাসা করি, ওর কি এক মাস, দুই মাস নাকি বছর লাগবে? ডাক্তার বলেন, “আমি বলতে পারছি না। আমি আপনাকে কিছুই বলতে পারছি না।”’