আদালত থেকে রাজনীতির মাঠ - সবখানে স্বচ্ছ ছিলেন তিনি

অরুণ জেটলি এইমসে চিকিৎসাধীন অবস্থা মারা গেছেন। ছবি: টুইটার
অরুণ জেটলি এইমসে চিকিৎসাধীন অবস্থা মারা গেছেন। ছবি: টুইটার

রাজনীতিবিদ, আইনজীবী, ক্রিকেট প্রশাসক, দুর্দান্ত বক্তা, নাগরিক অধিকারকর্মী—কতভাবেই না তাঁর পরিচয় দেওয়া যায়! তাঁর মৃত্যুর কিছুক্ষণ পরই ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি টুইট বার্তায় বলেছেন, গভীর প্রজ্ঞা আর জ্ঞানের অধিকারী এক নেতা ছিলেন। মানুষকে উদ্দীপ্ত করার এক অসামান্য ক্ষমতা ছিল তাঁর। তাঁর অভাব অপূরণীয়।

তাঁর দল বিজেপিও বলেছিল, অরুণ জেটলির অভাব পূরণ হবে না। প্রণব মুখার্জির কথায় স্পষ্ট, ভারতের পুরো রাজনীতির অঙ্গনই এই শূন্যতা বোধ করবে। দল ছাপিয়ে অরুণ জেটলির মতো মানুষেরা একটি দেশের সম্পদে পরিণত হন। কংগ্রসে নেতা শশী থারুর যর্থাথই বলেছেন, তাঁর মৃত্যু ভারতের জন্য বিরাট ক্ষতি।

ভারতের সাবেক অর্থমন্ত্রী বিজেপি নেতা অরুণ জেটলি আজ মারা গেলেন। মাত্র ৬৬ বছর বয়সেই ঝরে পড়লেন ভারতীয় রাজনীতির এই নক্ষত্র। ভারতের স্থানীয় সময় দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে দিল্লির এইমস হাসপাতালে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।

দিনকয়েক আগেই বিজেপির অন্যতম বড় নেত্রী সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের পর চলে গেলেন আরও এক বিশিষ্ট নেতা অরুণ জেটলিও।

অসুস্থতার কারণেই এ বছর নির্বাচন ও মন্ত্রিসভা থেকে দূরে ছিলেন অরুণ জেটলি। গত পাঁচ বছরের মোদি সরকারের মন্ত্রিসভায় তিনি ছিলেন অর্থমন্ত্রী। শুধু অর্থমন্ত্রীই নন, কিছুদিনের জন্য প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও সামলেছেন তিনি। শুধু নিছক মন্ত্রীই নন, মোদি-অমিত শাহের অন্যতম ভরসা ছিলেন জেটলি।

দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসা চলছিল অরুণ জেটলির। ৯ আগস্ট গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় তাঁকে এইমস হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাঁকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছিল।

ভারতের সাবেক অর্থমন্ত্রী বিজেপি নেতা অরুণ জেটলি। ছবি: টুইটার
ভারতের সাবেক অর্থমন্ত্রী বিজেপি নেতা অরুণ জেটলি। ছবি: টুইটার

২০১৮ সালের মে মাসে চিকিৎসকেরা অরুণ জেটলির কিডনি প্রতিস্থাপন করেন। এরপর ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি অরুণ জেটলি।

শুরু আইন পেশায়
বিজেপি নেতা জেটলি জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯৫২ সালের ২৮ ডিসেম্বর। সেন্ট জেভিয়ার্সে স্কুলের পড়াশোনা করার পর দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছিলেন অরুণ জেটলি। সক্রিয় রাজনীতির আগে আইন পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন অরুণ জেটলি। ১৯৮৭ সালে সুপ্রিম কোর্টে আসার আগে হাইকোর্টে সাফল্যের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।

১৯৯১ সালে বিজেপির জাতীয় এক্সিকিউটিভ সদস্য হন অরুণ জেটলি। ১৯৯৯ সালে সাধারণ নির্বাচনের সময় তিনি দলের মুখপাত্র ছিলেন। বাজপেয়ি মন্ত্রিসভায় তিনি তথ্য সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। প্রথমবার নরেন্দ্র মোদি সরকারের মন্ত্রিসভায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন অরুণ জেটলি।

জরুরি সময়ে ১৯ মাস কারাগারে ছিলেন জেটলি
ছিলেন তুখোড় ছাত্রনেতা। সেখান থেকে হয়ে ওঠেন জাতীয় রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব।
রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হলেও পেশাগতভাবে আইনজীবী ছিলেন অরুণ জেটলি। নরেন্দ্র মোদি সরকারের প্রথম আমলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। এ ছাড়া প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও আইন মন্ত্রণালয় সামলেছেন বিভিন্ন সময়ে। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ছিলেন তিনি।

ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত অরুণ জেটলি। দিল্লি ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময়ই রাজনীতিতে জড়ান।

দিল্লির সেন্ট জেভিয়ার্সে পড়াশোনা শেষ করে শ্রীরাম কলেজ থেকে বিকম পাস করেন অরুণ জেটলি। এরপর দিল্লি ইউনিভার্সিটি থেকে আইন নিয়ে পড়াশোনা শেষ করেন। দিল্লির ছাত্র সংসদের প্রেসিডেন্টও হয়েছিলেন তিনি। ভারতের জরুরি সময় পুলিশের হাতে আটক হয়েছিলেন। সে সময় ১৯ মাস কারাগারে ছিলেন তিনি। কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে জনসঙ্ঘের সঙ্গে যুক্ত হন তিনি।

প্রথমে দিল্লি এবিভিপি-র প্রেসিডেন্ট ও এবিভিপি-র অল ইন্ডিয়া সেক্রেটারি করা হয় তাঁকে। এরপর যুব বিজেপির দিল্লির ইউনিটের সেক্রেটারিও হয়েছিলেন।

অটল বিহারি বাজপেয়ির মন্ত্রিসভায় তথ্য সম্প্রচার মন্ত্রী ছিলেন অরুণ জেটলি। ছবি: টুইটার
অটল বিহারি বাজপেয়ির মন্ত্রিসভায় তথ্য সম্প্রচার মন্ত্রী ছিলেন অরুণ জেটলি। ছবি: টুইটার

আইনজীবী হিসেবে দিল্লি হাইকোর্টেও কাজ করেছেন। একাধিক বইও লিখেছেন। পেপসিকো ও কোকা–কোলার মতো সংস্থার জন্য আইনি লড়াই করেছেন তিনি।

১৯৯৯ লোকসভা নির্বাচনের সময় বিজেপির মুখপাত্র নির্বাচিত হন জেটলি। সে বছর অটল বিহারি বাজপেয়ির মন্ত্রিসভায় প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। ২০০০ সালে আইন মন্ত্রণালয়ের পূর্ণ মন্ত্রী করা হয় তাঁকে। ২০০৯ সালে রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালে কংগ্রেসের কাছে ভোটে হেরে যান তিনি। রাজ্যসভায় নির্বাচিত হন।

নরেন্দ্র মোদি সরকারের অর্থমন্ত্রী করা হয় তাঁকে। এরপর মনোহর পারিক্কর অসুস্থ থাকার সময় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সামলেছেন। ২০১৯ সালে অসুস্থতার জন্য ভোটে লড়েননি তিনি।

জম্মু ও কাশ্মীরের সাবেক অর্থমন্ত্রী গিরিধারী লাল ডোগরার মেয়ে সঙ্গীতাকে বিয়ে করেন জেটলি। তাঁদের দুই সন্তান রোহন ও সোনালি। দুজনেই পেশায় আইনজীবী।

বিজেপির সনাতনী নেতৃত্বের বাইরে এসে আধুনিক ধারার পুরোধা হিসেবে গণ্য করা হয় জেটলিকে। ইংরেজি ভাষায় অসামান্য দক্ষতা ছিল তাঁর। চোস্ত বক্তৃতা করতেন। এক দশকের বেশি সময় ধরে বিজেপির মুখপাত্র ছিলেন। ভারতের ইংরেজি দৈনিক হিন্দুস্তান টাইমসের কলাম লেখক কুমার উত্তম লিখেছেন, গণমাধ্যমে বিজেপির এক উন্নত ভাবমূর্তি নির্মাণে কৃতিত্বের অধিকারী জেটলি।

দিল্লির অশোক রোডে সরকারি বাসভবনে থাকতেন না কখনোই। এটি ছিল দলের ‘গণমাধ্যম যুদ্ধক্ষেত্র’। নিত্যদিনের কাজ শেষে সন্ধ্যায় সেই বাড়িতে যেতেন জেটলি। জেসমিন চায়ে চুমুক দিয়ে দলের নীতিনির্ধারণী নিজের মতামত তুলে ধরতেন।

প্রথমবার নরেন্দ্র মোদি সরকারের মন্ত্রিসভায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন জেটলি।ছবি: টুইটার
প্রথমবার নরেন্দ্র মোদি সরকারের মন্ত্রিসভায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন জেটলি।ছবি: টুইটার

নীতির প্রশ্নে দলের অবস্থানের বিরোধিতা করতে দ্বিধান্বিত হননি। রাজনৈতিক দূরত্ব ছিল, কিন্তু কী নীতিশ কুমার কী শশী থারুর—কারও সঙ্গে সদ্ভাব নষ্ট হয়নি কখনোই।

১০ বছর পর দলকে ক্ষমতায় নিয়ে আসার পেছনে জেটলির ভূমিকাকে কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করে বিজেপি। সৌম্য দর্শন মানুষটি স্বচ্ছ থেকেছেন সব সময় রাজনীতিতে, আইন পেশায়।

কয়েক বছর ধরে শারীরিক সমস্যায় ভুগছিলেন অরুণ জেটলি৷ ২০১৮ থেকে কিডনি সমস্যায় ভুগতে থাকেন তিনি। ডায়ালিসিস শুরু হয়। কিডনি প্রতিস্থাপনও হয়। তারপর ধরা পড়ে ক্যানসার। এরপরই সেই ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য তিনি পাড়ি দেন যুক্তরাষ্ট্রে। সে জন্যই ফেব্রুয়ারি মাসে অর্থমন্ত্রী হয়েও প্রথম মোদি সরকারের অন্তর্বর্তী বাজেট পেশ করতে দেখা যায়নি তাঁকে। তাঁর দায়িত্ব পালন করেন পীযূষ গোয়েল। এমনকি দ্বিতীয়বার মোদির সরকার ক্ষমতায় এলে মন্ত্রিত্বের দৌড় থেকে সরে দাঁড়ান বর্ষীয়ান এই নেতা। দলের হয়ে কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন তিনি। শারীরিক অসুস্থতার জেরে মে মাসেও একবার এইমসে ভর্তি হন জেটলি। সেই থেকে সক্রিয় রাজনীতিতে আর দেখা যায়নি তাঁকে।

অসুস্থ অরুণ জেটলিকে দেখতে হাসপাতালে গিয়েছিলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ, উপরাষ্ট্রপতি রাজ্যসভার চেয়ারম্যান ভেঙ্কাইয়া নায়ডু, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ, অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ, কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষবর্ধন এবং লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লাসহ অনেকে।