এই দেশগুলো কেন রাজধানী বদলেছে?

রাজরাজড়াদের সময় নতুন নতুন শহর, রাজধানী গড়ে তোলার ঘটনা আকছারই ঘটত। সুবিধামতো তাঁরা পাল্টে নিতেন রাজধানী। তবে আধুনিক সময়ে বা নিকট-অতীতে ক্ষমতার রদবদলেও রাজধানী বদলের ঘটনা সচরাচর ঘটে না। তবে সব ঘটনার মধ্যেই ব্যতিক্রম রয়েছে। তাই এই যুগেও রাজধানী পাল্টে ফেলার ঘটনা যে একেবারে ঘটেনি, তা আর বলার সুযোগ নেই। রাজনৈতিক কৌশলগত কারণে বা পুরোনো রাজধানীর চেয়ে আরও উপযোগী স্থান পাওয়া, নতুন পরিকল্পিত নগর গঠনের তাগিদ, যানজটসহ নানা সমস্যার সমাধান হিসেবে কয়েকটি দেশ বদলে ফেলেছে তাদের রাজধানীই। সর্বশেষ এই তালিকায় হয়তো যুক্ত হতে যাচ্ছে ইন্দোনেশিয়ার নাম।

বিবিসি অনলাইনের এক প্রতিবেদনে কয়েকটি দেশের রাজধানী পরিবর্তন করা ও পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার তথ্য উঠে এসেছে।

ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় প্রায়ই তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। ছবি: এএফপি
ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় প্রায়ই তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। ছবি: এএফপি

ইন্দোনেশিয়া
যানজটে নাকাল রাজধানীবাসীকে মুক্তি দিতে রাজধানীই পাল্টে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইন্দোনেশিয়া। জাকার্তার বদলে নতুন রাজধানী হিসেবে বর্নিও দ্বীপের নাম প্রস্তাব করেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো। ১৬ আগস্ট দেশটির পার্লামেন্টে রাজধানী বদলের সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেছেন তিনি। তবে দ্বীপের ঠিক কোথায় রাজধানী হবে বা কখন, কীভাবে হবে, সে সম্পর্কে কিছু জানাননি তিনি।

যানজটের কারণে জাকার্তার দুর্নাম রয়েছে। ২০১৬ সালের এক জরিপে বলা হয়েছিল, বিশ্বের বড় বড় শহরের যানজটের দিক দিয়ে জাকার্তার অবস্থান শীর্ষে। যানজট এড়িয়ে মন্ত্রীদের সময়মতো বৈঠকে অংশ নিতে পুলিশি পাহারায় নিয়ে যেতে হয়।

তবে রাজধানী সরিয়ে নিতে চাওয়ার একমাত্র কারণ যানজট নয়। প্রতিবছর ১ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার করে ডুবছে জাকার্তা। শহরের প্রায় অর্ধেক এখন সাগরের উচ্চতার চেয়ে নিচে অবস্থান করছে। জলাভূমির ওপর এটির অবস্থান এখন। শহরটি জাভা সাগর পরিবেষ্টিত এবং এর মধ্য দিয়ে ১৩টি নদী বয়ে চলেছে।

দেশটির বড় আকারের শহুরে এলাকায় ৩ কোটি লোকের বাস। নগরবাসীর জন্য মাত্র ২-৪ শতাংশ অপরিশোধিত পানি শোধন করা হয়।

জানা গেছে, বর্নিও দ্বীপের কালিমানতান হতে পারে ইন্দোনেশিয়ার নতুন রাজধানী। রাজধানী স্থানান্তরে খরচ হতে পারে ৩৩০০ কোটি মার্কিন ডলার। আয়তন হতে পারে ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার হেক্টর। যেখানে ৯ লাখ থেকে ১৫ লাখ মানুষের ঘরবাড়ি বানানো যেতে পারে। কালিমানতানের কেন্দ্রে পালাংকারাইয়া। ভৌগোলিকভাবে এর অবস্থান ইন্দোনেশীয় দ্বীপপুঞ্জের কেন্দ্রের কাছাকাছি। দেশটির জনক বলে আখ্যায়িত সুকর্ণও এটিকে রাজধানী করার প্রস্তাব করেছিলেন।

তবে ইন্দোনেশিয়াই একমাত্র দেশ নয়, যারা রাজধানী বদল করতে যাচ্ছে। আরও কয়েকটি দেশ তাদের রাজধানী বদলে ফেলেছে।

১৯৯৭ সালে কাজাখস্তানের নতুন রাজধানী হিসেবে গড়ে তোলা হয় আসতানা। ছবি: এএফপি
১৯৯৭ সালে কাজাখস্তানের নতুন রাজধানী হিসেবে গড়ে তোলা হয় আসতানা। ছবি: এএফপি

কাজাখস্তান
১৯৯৭ সালে কাজাখস্তানের প্রেসিডেন্ট নুরসুলতান নজরবায়েভ আলমাতি থেকে রাজধানী সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার উত্তরে ধূলি আচ্ছাদিত এক প্রাদেশিক শহরকে রাজধানী করার জন্য বেছে নেন। প্রথমেই তিনি জায়গাটির নাম আকমলা থেকে পরিবর্তন করে আসতানা করেন। এরপর তিনি বিশ্বের নানা দেশ থেকে স্থপতিদের নিয়ে আসেন রাজধানীটি গড়ে তোলার জন্য।

শহরটির উল্লেখযোগ্য স্থাপনার একটি খান শাতইয়ার, বিশ্বের সবচেয়ে বড় তাঁবু। এটির নকশা করেন নরমান ফস্টার। এর ভেতরে শপিং মল ও বিনোদনকেন্দ্র রয়েছে। আরেকটি স্থাপনা রয়েছে বায়তারেক টাওয়ার নামে। এটি দেখতে গাছের মাথায় ডিম বসানোর মতো। টাওয়ার থেকে অন্যান্য ভবন দেখার সুযোগ রয়েছে। রয়েছে সাদা ভবনের ওপর হালকা নীল রঙের গম্বুজের প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ। সবুজাভ নীল রঙের সুদৃশ্য সেন্ট্রাল কনসার্ট হল রয়েছে। স্থাপনাটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যেন কোনো স্পেসশিপ মাটিতে অবতরণ করে তার দরজা খুলছে।

এমন সব স্থাপনার নতুন রাজধানী তৈরি করা সম্ভব হয়েছে দেশটির তেল সম্পদের কারণে। তেল সমৃদ্ধির কারণে গত বছর দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেড়েছে ৪ দশমিক ৮ শতাংশ। এই বছরের মার্চে ক্ষমতা ছেড়েছেন প্রেসিডেন্ট নজরবায়েভ। তবে নতুন শহর গড়ার কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তাঁর নামে রাজধানীর নামকরণ করতে দেশটির পার্লামেন্ট একটি প্রস্তাব পাস করেছে।

এখন কাজাখস্তানের নতুন রাজধানীর নাম নুরসুলতান সিটি। মঙ্গোলিয়ার উলানবাটারের পর এটাই বিশ্বের সবচেয়ে শীতল শহর।

মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোতে পার্লামেন্ট ভবন। ছবি: রয়টার্স
মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোতে পার্লামেন্ট ভবন। ছবি: রয়টার্স

মিয়ানমার
মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোর ইতিহাস খুবই ছোট। ২০০৫ সালে তৎকালীন সামরিক শাসনামলে এটি রাজধানী হিসেবে আবির্ভূত হয়। নেপিডো নামের অর্থ ‘রাজার আসন’। তবে মিয়ানমার কেন ইয়াঙ্গুন (পূর্বের রেঙ্গুন) থেকে রাজধানী সরিয়ে নিল, তা কখনো স্পষ্ট হয়নি। ওই সময় দেশটির তথ্যমন্ত্রী বিবিসিকে বলেছিলেন, জায়গাটি অনেক বেশি সুবিধাজনক ও উপযোগী। তবে বিশ্লেষকেরা এই জবাবে সন্দেহ পোষণ করেন। তাঁদের মতে, বিদেশি দখলদারির আশঙ্কায় সামরিক শাসকেরা রাজধানী সরিয়ে নিয়েছেন। অথবা তাঁরা সীমান্ত অঞ্চলে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ওপর আরও বেশি নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্য এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

অনেকের মতে, মিয়ানমারের নেতাদের নিজেদের গোপন রাখার দুর্নাম রয়েছে। ঔপনিবেশিক যুগের আগে বার্মিজ রাজাদের স্বভাব অনুসারে হয়তো সামরিক শাসকেরা নতুন রাজধানী করেছেন। বার্মিজ রাজারা ভবিষ্যৎ গণকদের কথার ওপর ভিত্তি করে নতুন নতুন শহর ও প্রাসাদ গড়ে তুলতেন।

একটি পরিকল্পিত নগরীতে যা থাকা উচিত সবই রয়েছে নেপিডোতে। পার্লামেন্ট থেকে প্রেসিডেন্ট ভবনের দিকে যাওয়ার সড়ক ২০ লেন চওড়া। যানজট হয় না বললেই চলে। চারপাশে ঝকঝকে শপিং মল, বিলাসবহুল হোটেল। সাফারি পার্ক, চিড়িয়াখানা, কমপক্ষে তিনটি স্টেডিয়াম আছে। শহরটিতে সর্বক্ষণ বিদ্যুৎ থাকে। তবে দেশটির অন্য অঞ্চলে এমন নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ-ব্যবস্থা নেই।

বলিভিয়ার রাজধানী লা পাজের একটি দৃশ্য। ছবি: ফেসবুক
বলিভিয়ার রাজধানী লা পাজের একটি দৃশ্য। ছবি: ফেসবুক

বলিভিয়া
বলিভিয়ার দুটি রাজধানী। একটির নাম সুকরে, অপরটি লা পাজ। ১৮৯৯ সাল পর্যন্ত সুকরে ছিল দেশটির একমাত্র রাজধানী। ছোট্ট এক যুদ্ধে লা পাজের কাছে হেরে যায় সুকরে। এরপরই পার্লামেন্ট ও সরকারি সংস্থা বলিভিয়ার সবচেয়ে বড় শহর লা পাজে স্থানান্তরিত হয়। তবে বিচারিক কার্যক্রম এখনো সুকরেতে রয়েছে। সুকরে বলিভিয়ার একদম কেন্দ্রে অবস্থিত। সেখানেই বলিভিয়া প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮২৫ সালে। এর জনসংখ্যা আড়াই লাখ। আর লা পাজের জনসংখ্যা ১৭ লাখ।

২০০৭ সালে সুকরেতে পার্লামেন্ট ও সরকার ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার এক প্রস্তাব করা হয়। ওই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ওই সময় ক্ষোভে ফেটে পড়ে লা পাজ। এখন পর্যন্ত ওই বিক্ষোভকেই দেশটির সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ বলা হয়।

প্রেসিডেন্ট ইভো মরালেসের সমর্থক বলিভিয়ার পশ্চিমাঞ্চলের দরিদ্র অধিবাসীদের সঙ্গে পূর্বের সমৃদ্ধিশালী বিরোধীদের দ্বন্দ্ব থেকেই এই প্রস্তাব উঠে এসেছিল। তবে বিক্ষোভের মুখে শেষ পর্যন্ত তা বাতিল করা হয়। ফলে এখন পর্যন্ত বলিভিয়ায় দুটো রাজধানীই বহাল আছে।

পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হয়েছে নাইজেরিয়ার রাজধানী আবুজা। ছবি: রয়টার্স
পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হয়েছে নাইজেরিয়ার রাজধানী আবুজা। ছবি: রয়টার্স

নাইজেরিয়া
১৯৯১ সালের আগ পর্যন্ত নাইজেরিয়ার রাজধানী ছিল দেশটির সবচেয়ে বড় শহর লাগোস। তবে লাগোস থেকে আবুজায় রাজধানী স্থানান্তরের নানাবিধ কারণ রয়েছে। প্রথমেই রয়েছে এর অবস্থান। একদম কেন্দ্রে রয়েছে আবুজা, যা উপকূল থেকে বেশ দূরে। উত্তর-পূর্বের মাইদুগুরি শহর থেকে বাসে করে ১৬০০ কিলোমিটার দূরত্বের লাগোসে যেতে দুদিন লাগে। সেই তুলনায় আবুজা অনেক কাছে। লাগোস বেশ ঘনবসতিপূর্ণ। সাব সাহারা আফ্রিকার মধ্যে সবচেয়ে জনবহুল শহর সেটি। রাজধানী স্থানান্তরে এটিও ছিল আরেকটি কারণ।

ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও রাজনৈতিক মতাদর্শের দিক দিয়ে আবুজা বেশ নিরপেক্ষ। লাগোসে ইয়োরুবা গোত্রের আধিপত্য ছিল। অন্যদিকে ইগবোস গোত্রের পশ্চিমে এবং হাউসাস গোত্রের উত্তরে আধিপত্য রয়েছে। বিষয়টি ছোটখাটো কিছু নয়। ১৯৬৭ থেকে ১৯৭০ সালে নাইজেরিয়া বায়াফ্রান যুদ্ধের শিকার হয়। ওই সময় ইগবোসরা নাইজেরিয়া থেকে পৃথক হওয়ার চেষ্টা করেছিল।

লাগোস প্রাকৃতিকভাবেই গড়ে উঠেছে। আর আবুজা হচ্ছে নাইজেরিয়ার প্রথম পরিকল্পিত শহর। যানজটের দিক দিয়েও লাগোসের দুর্নাম রয়েছে। আবুজায় শুরু থেকেই সড়কগুলো প্রশস্ত করে তৈরি করা হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট, ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি, প্রেসিডেন্ট ভবনসহ নানান জাতীয় ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে আবুজায়। তবে কেন্দ্রীয় অনেক সংস্থা অনানুষ্ঠানিকভাবে এখনো লাগোসে রয়ে গেছে।

পর্তুগালের সাময়িক রাজধানী হয়েছিল ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরো। ছবি: এএফপি
পর্তুগালের সাময়িক রাজধানী হয়েছিল ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরো। ছবি: এএফপি

পর্তুগাল
১৩ বছর পর্তুগালের রাজধানী হিসেবে লিসবনের নাম ছিল না। ছিল ব্রাজিলের সাগরঘেঁষা বিশালাকার শহর রিও ডি জেনিরোর নাম। রাজধানী পরিবর্তনের কারণ হিসেবে আসে ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্টের নাম।

উপদ্বীপ যুদ্ধের সময় (১৮০৭-১৪) ফ্রান্স কমপক্ষে তিনবার পর্তুগাল দখলে নেয়। দখলের কয়েক দিন আগে ১৮০৭ সালের ডিসেম্বরে রাজকীয় ব্রাগানজা পরিবার ও রাজসভা পর্তুগাল ছেড়ে ব্রাজিলে চলে যায়। ১৮০৮ সালের মার্চে তাঁরা রিওতে পৌঁছান। উনিশ শতাব্দীর শুরুতে রিও ছিল সমৃদ্ধ নগরী। সেখানে সোনা, হীরা ও চিনি ছিল। সেখানে ১০ লাখের মতো দাস ছিল। সেখানের মোট সংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ ছিল দাস।

রাজপুত্র ষষ্ঠ দোম জো ও পর্তুগাল, ব্রাজিল এবং আলগার্ভস রাজ্য গড়ে তোলেন। এরপর থেকেই উপনিবেশ থেকে পর্তুগালের সম-উচ্চতায় উঠে আসে ব্রাজিল। ব্রাজিলকে প্রশাসনিক বেশ কিছু স্বাধীনতাও দেওয়া হয়। ১৮১৬ সালে রানি মারা যাওয়ার পর দোম জো ও রাজা হন। ১৮২১ সালে পর্তুগিজ রাজসভা লিসবনে ফিরে আসে। ১৯১০ সালে সাম্রাজ্য শেষ হওয়া পর্যন্ত তা বহাল ছিল। রিওতে অল্প সময়ের জন্য থাকলেও ব্রাজিলের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং স্বাধীনতার তাগিদ দেওয়ার মাধ্যমে তারা তাদের স্থায়ী ছাপ রেখে গেছে।