আফ্রিকা মহাদেশে জাপানের বিনিয়োগ বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি

জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে আফ্রিকার উন্নয়ন সংক্রান্ত টোকিও আন্তর্জাতিক সম্মেলন (টিকাড) উপলক্ষে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, আগামী তিন বছরের মধ্যে তাঁর দেশের বেসরকারি খাত আফ্রিকা অঞ্চলে দুই হাজার কোটি মার্কিন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করবে। জাপানের বন্দর নগরী ইয়োকোহামায় সমবেত আফ্রিকা মহাদেশের নেতৃবৃন্দকে এই প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।

জাপানের প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনী ভাষণের মধ্যে দিয়ে আজ বুধবার শুরু হয়েছে তিন দিনের উচ্চ পর্যায়ের এই সম্মেলন। এবার যেখানে জাপানের বেসরকারি খাতের উপস্থিতি হচ্ছে চোখে পড়ার মতো। আবে বলেছেন, আফ্রিকার উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় জাপান দীর্ঘ সময় ধরে জড়িত আছে এবং ভবিষ্যতে জাপানের এই সম্পৃক্ততা মহাদেশের শান্তি, নিরাপত্তা ও অগ্রগতির সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি আফ্রিকা মহাদেশের উন্নয়নে জাপানের নেওয়া নতুন উদ্যোগের ঘোষণা দেন।

জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে এবং আফ্রিকান ইউনিয়নের বর্তমান সভাপতি দেশ মিসরের প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফাত্তাহ আল-সিসির যৌথ সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আজকের উদ্বোধনী অধিবেশনে আরও বক্তব্য রেখেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস, আফ্রিকান ইউনিয়ন কমিশনের সভাপতি ও শাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুসা ফাকিহ মাহামাত।

টিকাডের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৯৩ সালে টোকিওতে আয়োজিত প্রথম সম্মেলনের মধ্য দিয়ে। শুরুতে প্রতি পাঁচ বছরে একবার বৈঠক অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হলেও ২০১৩ সাল থেকে বিরতির স্থায়িত্ব তিন বছরে নামিয়ে আনা হয়। এর আগের ছয়টি সম্মেলনে প্রধানত আফ্রিকা মহাদেশে জাপানের সরকারি উন্নয়ন সাহায্যের বিষয়টি প্রাধান্য পেলেও, এবারই প্রথম আফ্রিকার দেশগুলোর উন্নয়নে জাপানের বেসরকারি খাতকে ব্যাপকভাবে জড়িত করার দিকটি অনেক বেশি গুরুত্ব পায়।

আফ্রিকার প্রায় পঞ্চাশটি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান কিংবা উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিরা বুধবার থেকে শুরু হওয়া সপ্তম টিকাড সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন। জাপানের পক্ষ থেকে যত বেশি সম্ভব দেশের সরকার ও রাষ্ট্র প্রধানদের টিকাড-৭ সম্মেলনে নিয়ে আসার লক্ষ্য ধরে নেওয়া হলেও, শেষ পর্যন্ত আফ্রিকা মহাদেশের ৫৪টি দেশের মধ্যে ৩০টির মতো দেশের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা এতে যোগ দিয়েছেন। বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, চীনের পরোক্ষ চাপের কারণে কিছু কিছু দেশ টিকাড সম্মেলনে যোগ দেয়নি।

সম্মেলন চলাকালে অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধিরা টেকসই সমাজ গড়ে তোলার জন্য করণীয় পদক্ষেপের পাশাপাশি মহাদেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিয়েও আলোচনা করবেন। আগামী শুক্রবার সম্মেলনের শেষ দিনে যৌথ ঘোষণার পাশাপাশি একটি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে শেষ হবে টিকাড ৭-এর কার্যক্রম। যৌথ ঘোষণায় আফ্রিকার কিছু কিছু দেশের মাত্রাতিরিক্ত ঋণ গ্রহণ নিয়ে উদ্বেগের বিষয়টি জাপান অন্তর্ভুক্ত রাখতে চাইলেও, অন্যান্য দেশ এতে কতটা আগ্রহী হবে তা এখনো পরিষ্কার নয়। কারণ সেই উদ্বেগের মধ্য দিয়ে জাপান যেটাকে ফাঁদে ফেলার ঋণ হিসেবে আখ্যায়িত করছে, আফ্রিকা মহাদেশজুড়ে চীনের সেরকম আগ্রাসী সম্প্রসারণের পরোক্ষ সমালোচনা করা হবে বলে অনেকে মনে করছেন।

আফ্রিকা মহাদেশে চীনের ব্যাপক উপস্থিতির বিষয়টি গত কয়েক বছর ধরে জাপানকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। বিশেষ করে আফ্রিকার অবকাঠামো উন্নয়নে চীনের ভূমিকা টোকিওকে, বিশেষ করে জাপানের বেসরকারি খাতের কোম্পানিগুলোকে বেকায়দায় ফেলে দেয়। আফ্রিকার অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকা অবস্থায় দেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য সুবিধাজনক অবস্থান জাপান এখন তৈরি করে দিতে চাইছে। তবে চীনের ব্যাপক উপস্থিতির কারণে এবং প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান থেকে জাপান পিছিয়ে পড়ায় জাপানের কোম্পানিগুলোর পক্ষে আফ্রিকার অবকাঠামো খাতের উন্নয়নে যুক্ত হওয়া সহজ হচ্ছে না। ফলে জাপান এখন চীনের খোলা হাতে ঋণ দেওয়ার বিষয়টির সরাসরি সমালোচনা করে যাওয়ার পাশাপাশি জাপানি প্রযুক্তির গুণগত মানের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে আফ্রিকার ক্রমশ সম্প্রসারিত হয়ে ওঠা বাজারে ঢোকার চেষ্টা করছে।

তবে চীনকে পাশ কাটিয়ে অন্যদের হাত ধরে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আফ্রিকার দেশগুলো কতটা আগ্রহী হবে—তা স্পষ্ট নয়। বিগত দুই দশকে আফ্রিকা মহাদেশের এগিয়ে যাওয়ার ওপর খুব বেশি আলোকপাত করা না হলেও আফ্রিকার অগ্রগতি কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্য। দারিদ্র্য ও সামাজিক সমস্যা থেকে আফ্রিকা মুক্ত হতে না পারলেও অর্থনৈতিক অগ্রগতির সূচকে খুব বেশি পিছিয়ে নেই অবহেলিত মহাদেশটি। আর আফ্রিকার এই অগ্রযাত্রায় চীনের ভূমিকা অগ্রাহ্য করা কোনো অবস্থাতেই সম্ভব নয়। ২০০০ সালে আফ্রিকার সঙ্গে চীনের বাণিজ্যের আর্থিক পরিমাণ ছিল প্রায় ১ হাজার কোটি ডলার। ২০১৭ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে ১৪ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। সেই সঙ্গে চীনের আর্থিক সহায়তায় মহাদেশের বিভিন্ন দেশে সড়ক, রেলপথ, সমুদ্র ও বিমানবন্দর তৈরি হওয়ায় আন্তমহাদেশীয় বাণিজ্যিক লেনদেন এখন অনেক সহজ হয়ে উঠেছে। আর একারণেই জাপানের পাশাপাশি পশ্চিমের দেশগুলো আফ্রিকার ঋণের ফাঁদে আটকা পড়ে যাওয়া নিয়ে হইচই চালিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও আফ্রিকার নেতৃবৃন্দের পাশাপাশি মহাদেশের বিভিন্ন রাষ্ট্রের জনগণ বিষয়টিকে সেভাবে দেখছেন না। আফ্রিকায় অনেকেই মনে করেন চীনের আগমন মহাদেশের জন্য সুবিধাজনক অনেক কিছু নিয়ে এসেছে। যোগাযোগ নেটওয়ার্ক ব্যবস্থার অসাধারণ উন্নতি আফ্রিকা মহাদেশকে সমগ্র মহাদেশ জুড়ে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদনের পথে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছে। ফলে পশ্চিমের মুখে চীনের সমালোচনার ভিন্ন মূল্যায়ন আফ্রিকায় লক্ষ্য করা যায়। দক্ষিণ আফ্রিকার অর্থমন্ত্রী টিটো এমবওয়েনি যেমন ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘চীনের সঙ্গে আফ্রিকার ব্যবসায় লিপ্ত হওয়া এ কারণে ওরা দেখতে চায় না যে, ওরা মনে করে মহাদেশটি হচ্ছে ওদের বাড়ির পেছনের খোলা জায়গা।’

ফলে আফ্রিকা মহাদেশের উন্নয়নে জড়িত হওয়ার পাশাপাশি চীনের সমালোচনা করা কারও জন্যই লাভবান হতে পারে না। এ কারণেই টিকাড সম্মেলনকে ঘিরে নতুন যে চিন্তা জাপানের করা উচিৎ তা হলো, মহাদেশের উন্নয়নে সম্মিলিতভাবে জড়িত হওয়ার মধ্য দিয়ে সবার জন্য উপকারী একটি পরিবেশ কীভাবে তৈরি করা যায়—সেই ধারণা এগিয়ে নেওয়া।