রাত পোহালেই এনআরসি প্রকাশ, আসামে আতঙ্ক

আজকের রাতটা পোহালেই কাল শনিবার আধা সামরিক বাহিনীর উপস্থিতিতে প্রকাশিত হতে চলেছে ভারতের আসামের চূড়ান্ত জাতীয় নাগরিকপঞ্জি, যা ‘এনআরসি’ নামে পরিচিত। এর খসড়া তালিকায় বাদ গিয়েছিল ৪২ লাখ মানুষের নাম, যাঁদের অধিকাংশ বাংলাভাষী হিন্দু ও মুসলমান। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর মধ্যে কারা নিশ্চিন্তে নিদ্রা যাবেন, আর কাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়বে, সেই দুশ্চিন্তা ও দোলাচল ক্রমেই তীব্রতর হয়ে উঠেছে।

খসড়া তালিকায় বাদ পড়া মানুষদের গ্রাস করেছে প্রবল আতঙ্ক। মানবাধিকার নিয়ে কাজ করে এ রকম দিল্লির একটি বেসরকারি সংগঠন ‘ন্যাশনাল ক্যাম্পেইন অ্যাগেইনস্ট টর্চার’ (এনসিএটি) এনআরসিতে বাদ পড়া মানুষদের মধ্যে সমীক্ষা চালিয়ে এক প্রতিবেদন পেশ করেছে। এতে দেখা যায়, নাম বাদ পড়া মানুষদের ৮৯ শতাংশ ‘চূড়ান্ত উদ্বেগের’ মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। তাঁদের উদ্বেগ বিতাড়িত হওয়া নিয়ে। চাকরিচ্যুত হওয়া নিয়ে। ডিটেনশন ক্যাম্পে দিন কাটানোর ভয়ে। অথবা পরিবার–পরিজন থেকে জবরদস্তি আলাদা করে দেওয়ার আশঙ্কায়। কাশ্মীরিদের মতো এই মানুষদের খিদে কমে গেছে। ঘুম আসে না। অকারণে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছেন কেউ কেউ। অবসাদে দীর্ণ হয়ে আত্মহননের পথও বেছে নিচ্ছেন অনেকে। যেমন গতকাল বৃহস্পতিবার করিমগঞ্জ জেলার সোনাইপাড়া গ্রামের প্রীতিভূষণ দত্ত আত্মহত্যা করলেন। প্রীতিভূষণ তাঁর স্ত্রী নমিতার নাম এনআরসির খসড়া তালিকায় ঢোকাতে ব্যর্থ হয়ে অবসাদে বিষণ্ন হয়ে পড়েছিলেন।

এনসিএটির প্রতিবেদন প্রকাশ্যে আসতে বিভিন্ন মহলে নড়াচড়া শুরু হয়েছে। আসাম রাজ্য নাগরিক অধিকার সুরক্ষা সমন্বয় সমিতির সভাপতি তপোধীর ভট্টাচার্যের অভিযোগ, ‘বাঙালি জাতিকে ধ্বংস করতে ফ্যাসিস্ট বিজেপি উগ্র অসমিয়া আধিপত্যবাদীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে।’ রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে অনড়। বিজেপির হিন্দু বাঙালি বিধায়ক শিলাদিত্য দেবের সাম্প্রতিকতম সাম্প্রদায়িক বিবৃতি হলো, ‘এনআরসি অসমিয়াদের সর্বনাশের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। কারণ, বাঙালি মুসলমানরা পেয়ে যাবে ভিটেমাটির অধিকার।’ শিলাদিত্যের গ্রেপ্তার দাবি করেছেন এআইইউডিএফ বিধায়ক আমিনুল ইসলাম। তাঁর দাবি আমল না দিয়ে বিজেপির রাজ্য সভাপতি রঞ্জিত দাস বলেছেন, এনআরসি প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশিরা যুক্ত। তালিকায় এখনো বহু বাংলাদেশির নাম রয়েছে। ফলে গোটা প্রক্রিয়াই অর্থহীন।

রাজ্য বিজেপি নেতারা চিন্তিত অন্য কারণে। খসড়া তালিকায় নাম না থাকাদের মধ্যে রয়েছেন বহু হিন্দু বাঙালি। এঁদের কী করে রক্ষা করা যায়, রাজ্য বিজেপি নেতৃত্বের মাথাব্যথা তা নিয়ে। আসাম রাজ্য সরকার প্রতিদিন বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। বলছে, নাম বাদ গেলেও কাউকে জেলে পোরা হবে না। তা ছাড়া নাম বাদ যাওয়ার অর্থই যে তাঁরা বিদেশি, তা নয়। কাউকে বিদেশি ঘোষণার ক্ষমতা রয়েছে একমাত্র ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের (এফটি)। আপাতত আসামে এফটির সংখ্যা ১০০। আগামী মাসে আরও ২০০ এফটি খোলা হবে। পর্যায়ক্রমে খোলা হবে মোট এক হাজার ট্রাইব্যুনাল। বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, এই ট্রাইব্যুনালে লড়াইয়ের জন্য সরকার আইনি সহায়তা দেবে। বিরোধী কংগ্রেসও জানিয়েছে, আইনি সহায়তার হাত বাড়াবে তারাও।

কিন্তু তাতে দুশ্চিন্তা দূর না হয়ে বরং বেড়েই চলেছে। এনসিএটির সমীক্ষা অনুযায়ী, এনআরসি কেন্দ্রে হাজিরা দিতে একেকজন নামছুটের গড় খরচ হয়েছে ১৯ হাজার ৬৫ রুপি। নাম সংযোজনের জন্য মোট খরচ হয়েছে ৭ হাজার ৮৩৬ কোটি টাকার বেশি। এই বিপুল খরচের পর মানুষ এখন নিঃস্ব। যাঁদের নাম ওঠেনি, তাঁরা ধন ও প্রাণ—দুটোতেই মারা পড়ছেন।

কাল শনিবার শেষ হচ্ছে এনআরসি প্রক্রিয়ার প্রথম পর্ব। তালিকায় নাম তুলতে ব্যর্থ যাঁরা, তাঁদের ভাগ্যে কী অপেক্ষায় রয়েছে, এখনো অজানা। জানা যেটুকু যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য তাঁদের যেতে হবে ট্রাইব্যুনালে। সেখানে ছাড়া পেলে এক রকম। কিন্তু না পেলে? ট্রাইব্যুনাল যাঁদের বিদেশি চিহ্নিত করবে, কী হবে তাঁদের? বিজেপির রাজনৈতিক দাবি অনুযায়ী, তাঁদের ‘ঘাড় ধাক্কা দিয়ে’ বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো যাবে না। কারণ, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর এই সেদিন ঢাকায় গিয়ে স্পষ্ট করে বলে এসেছেন, এনআরসি একান্তই ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। তাহলে ‘বিদেশিদের’ স্থান হবে কি ডিটেনশন ক্যাম্পে (ডি–ক্যাম্প)? বর্তমানে আসামে এমন শিবিরের সংখ্যা ছয়টি। তাতে বন্দী রয়েছেন প্রায় এক হাজার। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ, তিন বছরের বেশি কাউকে এভাবে বন্দী রাখা যাবে না। আরও ১০টি ডি–ক্যাম্প খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য সরকার। কত লোক তাতে আঁটবে? খুব বেশি হলে ৫০ হাজার? বাকিরা যাবেন কোথায়? থাকবেন কোথায়? খাবেন কী? খাওয়াবে কে? কোনো প্রশ্নেরই উত্তর নেই কারও কাছে।

আপাতত রাজধানী গুয়াহাটির সর্বত্র জারি হয়েছে ১৪৪ ধারা। সবাইকে সজাগ ও সতর্ক করে বলা হয়েছে, পুলিশ প্রশাসন কোনো প্ররোচনা ও হিংসা বরদাশত করবে না। বারণ করা হয়েছে অহেতুক গুজব ছড়াতে। রাত পোহালেই শুরু হচ্ছে আসামের রাজনীতি ও সামাজিক জীবনের এক নতুন অধ্যায়।