ইয়োকোহামা ঘোষণা গ্রহণের মধ্যে দিয়ে শেষ হলো টিকাড ৭

আফ্রিকা মহাদেশের উন্নয়নে জাপানের অব্যাহত সহযোগিতার অঙ্গীকার এবং আফ্রিকার দেশগুলোর ঋণের ফাঁদে আটকে পড়ার আশঙ্কা নিয়ে সতর্কতা অন্তর্ভুক্ত থাকা একটি ঘোষণা গ্রহণ করার মধ্যে দিয়ে জাপানের বন্দর ইয়োকোহামায় আজ শুক্রবার শেষ হয়েছে আফ্রিকার উন্নয়নবিষয়ক সপ্তম টিকাড শীর্ষ সম্মেলন।

ঘোষণায় নেতারা ঋণদাতা ও গ্রহীতা উভয়ের ক্ষেত্রে কোনো দেশের সরাসরি উল্লেখ না করে অবকাঠামো উন্নয়ন ঋণ গ্রহণে ঋণ পরিশোধ সামর্থ্যের বিষয়টি বিবেচনা করে দেখায় তাঁদের সম্মতি ব্যক্ত করেছেন।

সপ্তম টিকাড সম্মেলনের স্বাগতিক দেশ জাপান শুরু থেকেই চীনের ‘ঋণের ফাঁদে’র প্রসঙ্গটি উল্লেখ করে সেই প্রবণতার বিরুদ্ধে আফ্রিকার দেশগুলোর বলিষ্ঠ অবস্থান গ্রহণের প্রত্যাশা করলেও শেষ পর্যন্ত কিছুটা নরম সুর ঘোষণায় অন্তর্ভুক্ত হতে দেখা গেছে। ঘোষণায় নেতাদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, ‘আমাদের বিশ্বাস, ব্যয়বহুল হলেও দীর্ঘস্থায়িত্বের দিক থেকে সামর্থ্যের নিশ্চয়তা দেওয়া উন্নতমানের অবকাঠামো হচ্ছে টেকসই অর্থনৈতিক রূপান্তরের ভিত্তি।’

এ রকম বক্তব্যে জাপানের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন অন্তর্ভুক্ত থাকলেও অন্য কোনো দেশ, বিশেষ করে চীনের প্রত্যক্ষ সমালোচনা এতে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। জাপান অনেক দিন থেকেই বলে আসছে, চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্প আফ্রিকার দেশগুলোকে ঋণের ফাঁদে আটকে ফেলা ছাড়াও চীনের প্রকল্পের তুলনামূলক কম খরচ এর গুণগত মানের নিশ্চয়তা দেবে না। সেদিক থেকে জাপানের উন্নতমানের অবকাঠামো ব্যয়বহুল হওয়া সত্ত্বেও এর দীর্ঘস্থায়িত্ব খরচ পুষিয়ে নিতে সহায়ক হবে বলে জাপান মনে করে। ইয়োকোহামা ঘোষণায় আফ্রিকার নেতাদের মুখ থেকে সে কথাই জাপান এখন কিছুটা পরোক্ষে বলিয়ে নিয়েছে।

তিন দিনের সম্মেলনের শেষে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে আজ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, শুধু জাপান ও চীনই নয়, অন্য অনেক দেশ আফ্রিকার উন্নয়নে অবদান রাখছে। তবে সে রকম সহায়তা লাভ করা দেশগুলোর ওপর মাত্রাতিরিক্ত ঋণের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া উচিত হবে না। সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে জাপানের প্রধানমন্ত্রী আগামী তিন বছরে আফ্রিকা মহাদেশে জাপানের বেসরকারি খাতের ২০০০ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগের নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন। তবে এই পরিমাণ হচ্ছে গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে আফ্রিকার সহায়তার জন্য চীনের ৬ হাজার কোটি ডলার সহায়তা অঙ্গীকারের তুলনায় অনেক কম।

ইয়োকোহামা ঘোষণায় আফ্রিকার উন্নয়নে বেসরকারি খাতের ভূমিকার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। নেতারা এতে বলেছেন, বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে তাঁরা একযোগে কাজ করবেন। ঘোষণায় এ ছাড়া মুক্ত ও অবাধ ভারত-প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চল গড়ে তোলায় জাপানের ধারণা সম্পর্কে বোধগম্যতা ব্যক্ত করে ন্যায়সংগত একটি সমুদ্র চলাচল ব্যবস্থা বজায় রাখার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। কয়েক বছর ধরে জাপান এই ভারত-প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের ধারণা এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে আসছে। বিশ্লেষকদের মতে, এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলজুড়ে চীনের ক্রমশ সম্প্রসারমাণ প্রভাবের বিপরীতে আরও বিস্তৃত আঙ্গিকের এই ধারণার বিষয়টি জাপান তুলে ধরলেও এখনো পর্যন্ত খুব বেশি জুতসই এক বিকল্প হিসেবে এটাকে গ্রহণ করেনি।

ইয়োকোহামা ঘোষণায় জাপানের আরেকটি দীর্ঘদিন ধরে লালন করে আসা বাসনা ‘জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সংস্কারের’ প্রয়োজনীয়তার উল্লেখ করে বলা হয়েছে, বিস্তৃত, স্বচ্ছ ও ভারসাম্যপূর্ণ উপায়ে নিরাপত্তা পরিষদের সংস্কার চালানো দরকার। বিগত কয়েকটি টিকাড সম্মেলনেও জাপান জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সংস্কারে আফ্রিকার দেশগুলোর সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যপদ লাভে জাপানের ইচ্ছার কথা গোপন রাখেনি। ইয়োকোহামা ঘোষণায় অবশ্য কোন ভূমিকা নিরাপত্তা পরিষদে জাপানের পালন করা উচিত, তার কোনো রকম উল্লেখ না করে বলা হয়েছে, নিরাপত্তা পরিষদের যেকোনো সংস্কার হতে হবে স্বচ্ছ ও ভারসাম্যপূর্ণ।

নেতারা এ ছাড়া আফ্রিকা মহাদেশজুড়ে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা চালুর অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন এবং মহাদেশের সব দেশকে অন্তর্ভুক্ত রেখে একটি অবাধ বাণিজ্য চুক্তির আশু প্রয়োজনীয়তার বিষয়টিও তুলে ধরেন এবং জলবায়ু পরিবর্তন সমস্যা সামাল দেওয়ায় সম্মিলিত পদক্ষেপ গ্রহণের অঙ্গীকার ঘোষণায় তাঁরা ব্যক্ত করেছেন।