আফ্রিকাকে নিয়ে চীন-জাপানের অসুস্থ প্রতিযোগিতা

আফ্রিকা মহাদেশকে নিয়ে চীন ও জাপান অসুস্থ এক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। এখন দুই দেশই মহাদেশটির দিকে যেন ‘শকুনের চোখে তাকিয়ে’।

দ্রুত শেষ হয়ে আসা প্রাকৃতিক সম্পদ আফ্রিকার দিকে এই দুই দেশের নজর সরিয়ে নিয়েছে।

অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখার পাশাপাশি উৎপাদন যন্ত্র সচল রাখাও জরুরি। এ জন্য সম্পদের চলান আসার কনভয়ের বেল্ট সক্রিয় রাখাও প্রয়োজন। ফলে, আফ্রিকার মন জয় করে মহাদেশটির সম্পদের ওপর ভাগ বসাতে নানা রকম পথ অবলম্বন করছে চীন ও জাপান।

ধনী দেশগুলোর অন্যের সম্পদ লুটে নেওয়ার এই মানসিকতা নতুন কিছু নয়। পশ্চিমের অগ্রসর দেশগুলো অতীতে আরও নগ্নভাবে একই কাজ করে গড়ে নিয়েছে সম্পদের পাহাড়। তবে সময়ের বিবর্তনে আগের মতো বাহুবল প্রয়োগের মাধ্যমে সম্পদ লুটের পরিবেশ এখন আর নেই। ফলে, আফ্রিকাকেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক রাজনীতির নবীন খেলোয়াড়দের অন্য পথের আশ্রয় নিতে হচ্ছে।

সে রকম একটি পথ হচ্ছে আফ্রিকার উন্নয়নে দেওয়া নানা রকম প্রতিশ্রুতি এবং সেসব প্রতিশ্রুতি পূরণে ঋণ ও অন্য ধরনের সাহায্য অঞ্চলটির দেশগুলোর দিকে বাড়িয়ে দেওয়া।

চীন ও জাপানের মধ্যে পকেট ভারী থাকার দিক থেকে চীন আজকাল অনেকটা এগিয়ে। ফলে, আফ্রিকা মহাদেশজুড়ে নানা রকম উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে দেশটি সহজেই জড়িত হতে পারছে। আফ্রিকার দেশগুলোয় চীনের প্রভাব ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ রকম অবস্থায় প্রতিযোগিতা থেকে পিছিয়ে পড়া জাপানের বিষয়টি মনঃপূত হচ্ছে না। তাই অন্য পথে অগ্রসর হয়ে চীনকে ঘায়েল করার দিকে জাপান এখন অনেক বেশি মনোযোগী।

অন্য সেই পথের দুটি উপাদান জাপানের ইয়োকোহামা শহরে সদ্য শেষ হওয়া টিকাড নামে পরিচিত আফ্রিকার উন্নয়নবিষয়ক টোকিও সম্মেলনে পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠতে দেখা গেছে।

উপাদান দুটি হলো চীনের কাছ থেকে পাওয়া সহজ ঋণ আফ্রিকা মহাদেশকে কীভাবে ফাঁদে ফেলে আর্থিক দায়বদ্ধতা থেকে নতুন একধরনের গোলামির দিকে নিয়ে যেতে পারে, তা নিয়ে অঞ্চলটির দেশগুলোকে সতর্ক করে দেওয়া। দ্বিতীয়ত, চীনের অর্থায়নে অপেক্ষাকৃত কম খরচে তৈরি বিভিন্ন অবকাঠামো গুণগত মানের দিক থেকে জাপানের চেয়ে কতটা নিকৃষ্ট, তা দেখিয়ে দেওয়া। এর মধ্য দিয়ে জাপানের তুলনামূলক ব্যয়বহুল অবকাঠামো উন্নয়নের দিকে আফ্রিকাকে আকৃষ্ট করা।

এই দুই ক্ষেত্রেই টিকাড সম্মেলনে আফ্রিকার জন্য নতুন কিছু প্রস্তাব জাপান পেশ করেছে। সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে আগামী তিন বছরে আফ্রিকা মহাদেশে জাপানের বেসরকারি খাতের দুই হাজার কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগের নিশ্চয়তা দিয়েছেন। সম্মেলনের সমাপ্তি অধিবেশনে তিনি বলেছেন, আফ্রিকার দেশগুলো যেন ঋণ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে আরও ভালোভাবে জ্ঞাত হয়। ঋণের ফাঁদ কীভাবে এড়িয়ে যাওয়া যায়, তারা যাতে তা জেনে নিতে পারে, সে জন্য আফ্রিকার ৩০টি দেশে জাপানের ঋণ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞদের পাঠাবেন তিনি।

শিনজো আবের উভয় প্রস্তাবের পেছনে চীনকে ঘায়েল করার মনোবৃত্তি রয়েছে। তবে চীন এতে আদৌ ঘায়েল হবে বলে মনে হয় না।

জাপানের দুই হাজার কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগে দেশের বেসরকারি খাতকে উদ্বুদ্ধ করার বিপরীতে বলতে হয়, চীন ইতিমধ্যে অনেকটা একই সময়সীমার মধ্যে ছয় হাজার কোটি ডলার সহায়তা প্রদানের অঙ্গীকার আফ্রিকাকে করেছে। চীনের সেই সহায়তায় আফ্রিকায় ইতিমধ্যে গড়ে ওঠা রেল ও সড়ক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক আরও সম্প্রসারিত হওয়ার বাইরে মহাদেশের বিভিন্ন দেশের অন্যান্য খাতও উপকৃত হবে।

জাপান যদি মনে করে থাকে, তাদের বুলেট ট্রেন প্রযুক্তি আফ্রিকা মহাদেশে নিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে নতুন চমক নিয়ে আসতে পারবে, সেই ধারণা হবে সবদিক থেকে ভুল।

আফ্রিকা মহাদেশে আন্তমহাদেশীয় যোগাযোগ চীনের অবকাঠামো প্রকল্প হাতে নেওয়ার আগে পর্যন্ত ছিল খুবই ভঙ্গুর। আর একেবারেই অনির্ভরশীল। সেই তুলনায় আফ্রিকার লোকজন এখন মহাদেশের এক বিস্তৃত অঞ্চলজুড়ে তুলনামূলক কম খরচে যাতায়াত করতে পারছে। পণ্য পরিবহনের মধ্য দিয়ে নতুন বাজারে প্রবেশের সুযোগও তারা পেয়ে যাচ্ছে। ফলে, ঠিক এই মুহূর্তে বুলেট ট্রেনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে তারা খুব বেশি চিন্তিত নয়।

অন্যদিকে, চীনের তৈরি সেতু ভেঙে পড়ছে না। আর রাস্তাও তৈরি হওয়ার ঠিক পরপর চল্টা উঠে গিয়ে খানাখন্দে রূপান্তরিত হচ্ছে না।

আফ্রিকার ঠিক এই মুহূর্তে যা প্রয়োজন, তা হলো প্রাথমিক প্রযুক্তি; মহাকাশ জয় বা রোবটকে মানবশ্রমের স্থলাভিষিক্ত করার অতি উচ্চ প্রযুক্তি নয়। আর প্রাথমিক প্রযুক্তির বেলায় চীন যে জাপানের চেয়ে খুব বেশি পিছিয়ে আছে, তা নয়।

অন্যদিকে, ঋণের সম্ভাব্য ফাঁদ থেকে মুক্ত হতে জাপানের ঋণ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞদের আফ্রিকা মহাদেশের ৩০টি দেশে পাঠানোর যে প্রস্তাব শিনজো আবে দিয়েছেন, সেটা অনেক বেশি হাস্যকর। হাস্যকর কেন, তা বুঝতে হলে জাপানের নিজের ঋণের অবস্থার দিকে দৃষ্টিপাত করা দরকার।

জাপান হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে ঋণগ্রস্ত দেশ। জাপানের অর্থ মন্ত্রণালয়ের সবশেষ হিসাবে দেখা যায়, জুন মাসে শেষ হওয়া ২০১৯ অর্থবছরের প্রথম ত্রৈমাসিকে দেশটির জাতীয় ঋণের মোট পরিমাণের যে হিসাব করা হয়েছে, তা সংখ্যায় বিপুল। অন্য হিসাবে জাপানের জনগণের ওপর মাথাপিছু চেপে বসা ঋণের পরিমাণ হচ্ছে প্রায় ৯০ লাখ ইয়েন, বাংলাদেশি টাকার হিসাবে আনুমানিক ৮৫ লাখ টাকা। যে শিশুটি ঠিক এই মুহূর্তে ভূমিষ্ঠ হয়েছে, তার জন্ম কিন্তু এই ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে।

দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের তুলনামূলক হিসাবে জাপানের ঋণের হার জিডিপির ২৩৬ শতাংশ। অর্থাৎ সারা বছর ধরে অর্থের হিসাবে জাপানের যে উৎপাদন, দেশের জাতীয় ঋণের পরিমাণ হচ্ছে তার চেয়ে ২ দশমিক ৩৬ গুণ বড়। বিশ্বের অন্য কোনো দেশ ঋণভারে এতটা জর্জরিত নয়।

জাপানের জাতীয় ঋণের পরিমাণ এতটা বিশাল হওয়া সত্ত্বেও দেশটিকে কিন্তু গ্রিস বা অন্য দেশের মতো ঋণ সংকটে পড়তে হয়নি। এর কারণ মূলত ঋণের উৎসের সঙ্গে সম্পর্কিত।

জাপানের জাতীয় ঋণের সবটাই দেশের ভেতরের ঋণ, বিদেশের কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নেওয়া ঋণ নয়। সেদিক থেকে অন্যান্য অনেক দেশের চেয়ে সুবিধাজনক এক অবস্থানে জাপান রয়েছে। ফলে গ্রিসের মতো আর্থিক সংকটের মধ্যে সহজে পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি জাপানের বেলায় নেই। তবে তারপরও বলতে হয়, ঋণ হচ্ছে ঋণ এবং ঋণ পরিশোধের দায়বদ্ধতা সবার ওপরেই বর্তায়। আর তাই সে রকম অবস্থা তৈরি হওয়ার বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া সবার কাম্য।

জাপানের এ রকম ঋণ পরিস্থিতির পাশাপাশি আফ্রিকার ঋণের অবস্থা কেমন?

বিশ্বের সবচেয়ে ঋণগ্রস্ত ১২টি দেশের তালিকায় আফ্রিকা মহাদেশের যে একটি মাত্র দেশের উপস্থিতি দেখা যায়, সেই দেশটি হচ্ছে জিম্বাবুয়ে। বিশ্বের সবচেয়ে কম ঋণগ্রস্ত দেশ হচ্ছে ব্রুনেই। আফ্রিকা মহাদেশের যে দুটি দেশ কম ঋণগ্রস্ত দেশের তালিকায় স্থান পেয়েছে, সেই দেশ দুটি হলো বতসোয়ানা ও গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গো। মোট জাতীয় উৎপাদনের আনুপাতিক হারে এই দুই দেশের ঋণ যথাক্রমে ১২ দশমিক ৮৪ ও ১৩ দশমিক ৩১ শতাংশ।

এই সব হিসাব-নিকাশের আলোকে আফ্রিকা মহাদেশকে ঋণমুক্ত হওয়ার উপায় বাতলে দিতে মহাদেশের ৩০টি দেশে জাপানের ঋণ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ পাঠানোর যে প্রস্তাব জাপানের প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন, সেটাকে হাস্যকর হিসেবে না দেখার উপায় নেই। ফলে, শুরুতেই যেমন উল্লেখ করা হয়েছে, আফ্রিকার সম্পদের দখল নিতে নবীন খেলোয়াড়দের মধ্যে চলছে প্রতিযোগিতা, সেটাকে ‘অসুস্থ প্রতিযোগিতা’ না বলে অন্য কিছু বলার উপায় আছে কি?