বিজেপি বলছে, ভুলে ভরা তালিকা মানি না

আসামের বিজেপি নেতারা বলছেন, এনআরসির নামে রাজ্যে যা হলো, তা পর্বতের মূষিক প্রসব। ছবি: রয়টার্স
আসামের বিজেপি নেতারা বলছেন, এনআরসির নামে রাজ্যে যা হলো, তা পর্বতের মূষিক প্রসব। ছবি: রয়টার্স

মুখ লুকোনোর জায়গা পাচ্ছে না বিজেপি। ভারতের সব রাজ্যে নাগরিকপঞ্জি তৈরির দাবি জানিয়ে তারা এখন বলছে, আসামের চূড়ান্ত নাগরিক তালিকা (এনআরসি) ভুলে ভরা নথি ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ, হিন্দুস্তানে কোনো হিন্দু কখনো ‘বিদেশি’ হতে পারে না। এদিকে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, নাগরিক তালিকায় যাঁদের নাম ওঠেনি, তাঁদের একজনকেও আটক করা হবে না। শেষ আইনি প্রক্রিয়া পর্যন্ত তাঁরা সব ধরনের রাষ্ট্রীয় অধিকার ভোগ করবেন।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রবীশ কুমার গতকাল রোববার সন্ধ্যায় এক বিবৃতিতে বলেন, নাগরিকপঞ্জি তৈরি একটা স্বচ্ছ, বিধিসম্মত ও আইনি প্রক্রিয়া। সবকিছুই হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ও তদারকিতে। আর যে পদ্ধতিতে এনআরসি তৈরি করা হয়েছে, তা বিজ্ঞানভিত্তিক। বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য জোগাড় করা হয়নি। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে নাগরিকদের আবেদনের ভিত্তিতে।

তবে এই তালিকা পেয়ে ক্ষমতাসীন বিজেপি বিস্মিত, ক্ষুব্ধ। কেননা, যে ১৯ লাখ মানুষের নাম তালিকায় ওঠেনি, তাঁদের অধিকাংশই বাঙালি হিন্দু। আসামের বিজেপির নেতারা তাই বলতে শুরু করেছেন, এনআরসির নামে রাজ্যে যা হলো, তা পর্বতের মূষিক প্রসব।

আসাম বিজেপির সভাপতি রঞ্জিত কুমার দাস গতকাল বলেছেন, লাখ লাখ ভারতীয়র নাম তালিকায় ওঠেনি। ওই মানুষজন উত্তর প্রদেশ, হরিয়ানা, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা থেকে যুগ যুগ ধরে এই রাজ্যে বাস করছেন। বৈধ নথিও তাঁদের রয়েছে। বহুবার তাঁরা নাম তোলার আবেদনও জানিয়েছেন। অথচ নাম ওঠেনি। হিন্দুস্তানিদের স্বার্থেই সারা দেশে এনআরসি করা দরকার। কারণ, হিন্দুস্তানে হিন্দুরা কিছুতেই বিদেশি হতে পারেন না।

>তালিকা পেয়ে ক্ষমতাসীন বিজেপি বিস্মিত-ক্ষুব্ধ
তালিকায় নাম না থাকাদের অধিকাংশই বাঙালি হিন্দু
যাঁদের নাম ওঠেনি, তাঁদের কাউকে আটক করা হবে না
আইনিপ্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় অধিকার বহাল থাকবে

বিজেপি বিস্মিত নাগরিকপঞ্জিতে লাখ লাখ হিন্দু বাঙালির নাম নেই দেখে। আর ক্ষুব্ধ, লাখ লাখ মুসলমান বাঙালির নাম স্থান পেয়েছে দেখে। আসামের শিলচর বিধানসভা কেন্দ্রের বিজেপির বিধায়ক দিলীপ কুমার পাল বলেছেন, ভুলে ভরা এই তালিকা বিজেপি কিছুতেই মেনে নেবে না। ভারতের হিন্দুরা কখনো বহিরাগত হতে পারে না। ১৩০০ কোটি টাকা খরচ করে এই এনআরসি পর্বতের মূষিক প্রসব ছাড়া অন্য কিছু নয়।

এনআরসির চূড়ান্ত তালিকা মেনে নিতে পারছে না অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়নও (আসু), যাদের আন্দোলনের ফলেই ১৯৮৫ সালের চুক্তিতে নাগরিকপঞ্জি তৈরির প্রতিশ্রুতি রাখা হয়েছিল। সেই আসুর মুখ্য উপদেষ্টা সমুজ্জল ভট্টাচার্য সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, এই তালিকা তাঁদের হতাশ করেছে। কারণ, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার বিভিন্ন সময়ে রাজ্যে যত বিদেশির উপস্থিতির কথা বলে এসেছে, এই তালিকা তার ধারেকাছেও নেই। প্রতিকার চেয়ে তাঁরা সুপ্রিম কোর্টের শরণাপন্ন হবেন।

আসুর সাধারণ সম্পাদক লুরিংজ্যোতি গগৈয়ের অভিযোগ, কেন্দ্র ও রাজ্য দুই সরকারই অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বাছাইয়ের অনেক সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু তারা নিদারুণ ব্যর্থ।

আসামের কংগ্রেসিদের কাছে নাগরিকপঞ্জি প্রথম থেকেই শাঁখের করাত। বরাক উপত্যকার রাজনীতির স্বার্থে তারা এনআরসির বিরোধিতা করতে পারেনি। আবার মুসলমানদের জন্য এনআরসিকে সমর্থন করাও ছিল তাদের পক্ষে কঠিন। তালিকা প্রকাশের পর এখন কংগ্রেসের অবস্থান ঠিক করতে শনিবার রাতে কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী এক জরুরি বৈঠক ডেকেছিলেন। বৈঠকের পর জানানো হয়, প্রকৃত ভারতীয়দের নাম বাদ যাওয়া কোনোভাবেই বরদাশত করা হবে না। ওই বৈঠকে আসামের কংগ্রেস সাংসদ গৌরব গগৈ, মেঘালয়ের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মুকুল সাংমারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকের পর মুকুল সাংমা বলেন, প্রকৃত ভারতীয় নাগরিকদের অধিকার রক্ষায় কংগ্রেস পাশে থাকবে।

নাগরিকপঞ্জি প্রকাশিত হওয়ার পর অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডিয়া আসাম সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছে, ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল (এফটি) যাতে স্বচ্ছতা বজায় রেখে নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারে, তা নিশ্চিত করা হোক। চূড়ান্ত তালিকায় যাঁদের নাম ওঠেনি তাঁরা এবার এফটিতে আবেদন জানাতে পারবেন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের পক্ষে আকর প্যাটেল বলেছেন, নাগরিকপঞ্জি তৈরির অধিকার সরকারের অবশ্যই রয়েছে। কিন্তু এফটির নিরপেক্ষতা নিয়ে নানা মহলে প্রশ্ন উঠছে। সরকারি নথিতে ভুল থাকার জন্য বহু মানুষের নাম বাদ গেছে। মানুষের অধিকার সুরক্ষা করা দরকার।

বাদ পড়ার চমকপ্রদ উদাহরণ
নাগরিক তালিকায় নাম ওঠেনি এমন বহু চমকপ্রদ উদাহরণ ক্রমেই প্রকাশ পাচ্ছে। যেমন আসামের সাবেক মন্ত্রী আসাম গণপরিষদ নেতা আবদুল জব্বারের মেয়ে জাহিদা সুলতানার নাম তালিকায় নেই। ৮৮ বছরের এই নেতা বলেন, সরকারি কর্তারা বলেছিলেন, মেয়ের নাম অবশ্যই তোলা হবে। অথচ হলো না। জাহিদা সুলতানা রাজ্যের এক কলেজের অধ্যাপক।

একই রকম ভাগ্য বিশিষ্ট গোর্খা স্বাধীনতাসংগ্রামী ছবিলাল উপাধ্যায়ের নাতনি মঞ্জু দেবীরও। মঞ্জু দেবীকে এর আগে ‘ডি’ ভোটার করা হয়। তাঁর দাবি, সব ধরনের প্রমাণপত্র দাখিল করা সত্ত্বেও তাঁর ও তাঁর ছেলেমেয়ের নাম ওঠেনি। অথচ স্বামীর নাম রয়েছে।

তালিকায় নাম ওঠেনি আলফা নেতা পরেশ বরুয়া, তাঁর স্ত্রী ও দুই ছেলের। প্রবল দুশ্চিন্তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীর তিন জওয়ানের পরিবার। দিলবর হুসেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর সিপাই। লক্ষ্ণৌয়ে পোস্টিং। তাঁর ভাই মিজানুর আলী কেন্দ্রীয় আধা সামরিক বাহিনীর জওয়ান। চেন্নাইয়ে পোস্টিং তাঁর। তৃতীয় ভাই শহীদুল ইসলাম সেনাবাহিনীর সুবেদার। তাঁদের বাবা আবদুল হামিদ ও মা খাদিজা বেগমের নাম ১৯৭০ সালের ভোটার তালিকায় ছিল। অথচ শহীদুল ছাড়া এঁদের কারও নাম নাগরিকপঞ্জিতে ওঠেনি।

অবশ্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গতকালের বিবৃতিতে স্পষ্ট বলা হয়েছে, যাঁদের নাম চূড়ান্ত তালিকায় ওঠেনি তাঁদের ‘রাষ্ট্রহীন’ বা ‘বিদেশি’ বলা যাবে না। এসব মানুষকে সব ধরনের আইনি সহায়তা দেওয়া হবে। আসাম সরকার বিনা খরচে আইনি সাহায্য দেওয়ার কথাও জানিয়েছে।