পরিস্থিতি বুঝতে অমিত শাহ যাচ্ছেন গুয়াহাটিতে

ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। ছবি: রয়টার্স
ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। ছবি: রয়টার্স

আসামের জাতীয় নাগরিকপঞ্জি তালিকা (এনআরসি) প্রকাশের পর রাজ্যের পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে ৮ সেপ্টেম্বর গুয়াহাটি যাচ্ছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। গতকাল সোমবার সরকারি সূত্রে এ খবর জানা গেছে। অমিত শাহ দুই দিনের এ সফরে উত্তর–পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্যপালদের সঙ্গে বৈঠক করবেন।

অমিত শাহর সফর পূর্বনির্ধারিত হলেও এনআরসির চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের পর সব মহলের ক্ষোভের কারণে তাঁর আসাম ভ্রমণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর যাওয়ার কথা নর্থ ইস্টার্ন কাউন্সিলের (এনইসি) বৈঠকে যোগ দিতে। কিন্তু সেই বৈঠক গৌণ হয়ে মুখ্য হয়ে উঠেছে রাজ্যজোড়া এনআরসিজনিত হতাশা ও ক্ষোভ। এনআরসি বিজেপির দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক দাবি হলেও চূড়ান্ত তালিকা কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসক দলকে চরম অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে। এতটাই যে বিজেপির রাজ্য নেতারা সবাই একযোগে এই তালিকা খারিজ করেছেন। তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন, যাঁদের নাম তালিকায় ওঠেনি, তাঁদের মধ্যে হিন্দুদের সংখ্যা কোন যুক্তিতে এত বেশি এবং কী করেই-বা মুসলমান বাঙালিদের সংখ্যা এত কম হয়? রাজ্য বিজেপি নেতারা ‘বিদেশি’ খোঁজা নিয়ে গত চার বছরের এই প্রক্রিয়াকে ‘পর্বতের মূষিক প্রসব’ বর্ণনা করে বলেছেন, হিন্দুস্তানে কিছুতেই হিন্দুরা বিদেশি হতে পারে না।

বিজেপির ক্ষোভের প্রধান কারণ তাদের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক দাবি পূরণ না হওয়া। তাদের লক্ষ্য ছিল ‘বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে চলে আসা মুসলমান’, যারা আসামের জনসংখ্যার ভারসাম্য ‘নষ্ট’ করে দিয়েছে। কিন্তু দেখা গেল, মুসলমান বাঙালিদের তুলনায় এনআরসিতে বেশি বাদ পড়েছেন হিন্দু বাঙালি। আসামের বিজেপি নেতারা এই অঙ্কটা কিছুতেই মেলাতে পারছেন না। তাঁদের চোখে এনআরসির কো–অর্ডিনেটর প্রতীক হাজেলা তাই এই মুহূর্তের সবচেয়ে বড় খলনায়ক। দুর্নীতির অভিযোগও বড় হয়ে উঠেছে। আসামের অর্থমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা সোমবারও বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন, ১৯৭১ সালের অনেক আগে তৎকালীন পূর্ববঙ্গ থেকে আসামে চলে আসা বহু হিন্দু বাঙালি শরণার্থীদের নাম এনআরসিতে গ্রাহ্য হয়নি। সেই সময় তাঁদের দেওয়া ‘রিফিউজি সার্টিফিকেট’ গণ্য করা হয়নি। হিমন্ত এ কারণে সোমবার নতুন করে তাঁর পুরোনো দাবি জানিয়ে বলেছেন, সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর ২০ শতাংশ এবং অন্য জেলাগুলোর ১০ শতাংশ তালিকা নতুন করে পরীক্ষা হোক।

বেশি হিন্দু বাঙালির নাম বাদ যাওয়ায় রাজ্য বিজেপির রাজনৈতিক সমীকরণে গোলমাল হয়ে গেছে। তবে শুধু বিজেপিই নয়, অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়নও (আসু) এই এনআরসিকে খারিজ করেছে। এর বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আসামের বিজেপি নেতারা। সেটা করা ঠিক হবে কি না কিংবা হলেও কোন উপায়ে, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে সেই বিষয়ে রাজ্য নেতৃত্বের কথা চলছে। অমিত শাহ রাজ্যে গেলে তিনিও পরিস্থিতি বিচার করে দলকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতে পারবেন।

এনআরসি তালিকা প্রকাশের পর থেকে নিত্যনতুন কাহিনি শোনা যাচ্ছে। যেমন গোয়ালপাড়া জেলার মাটিয়ায় ১৭টি শরণার্থীশিবিরের একটির ৩০০ পরিবারের ৯০ শতাংশ নারীর কারও নাম তালিকায় ওঠেনি। তাঁদের অধিকাংশই আদিবাসী। গারো, হাজং, কোচ, বানাই ও ডালু জনজাতি গোষ্ঠীর। ১৯৬৪ সালে তাঁরা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে চলে আসেন। অভিযোগ, তাঁদের কোনো পরিচয়পত্রই কর্তৃপক্ষ গ্রাহ্য করেনি।

প্রথম খসড়া তালিকায় ৪০ লাখ মানুষের নাম ছিল না। সেই তালিকা পরে আরও বাড়ে। নাম পুনর্বিবেচনার জন্য জমা পড়ে ৩৬ লাখ আবেদন। দেখা যায়, ৫ লাখের মতো মানুষ এনআরসিতে নাম তোলার জন্য আবেদনই জানায়নি। চূড়ান্ত তালিকায় যে ১৯ লাখ মানুষের নাম ওঠেনি, তার মধ্যে ওই ৫ লাখ মানুষ রয়েছে। প্রশ্ন হলো, ওই ৫ লাখ কোথায় গেল? কেনই বা তারা এনআরসিতে নাম তুলতে আগ্রহী হয়নি?

এনআরসির আবেদনপত্রে ধর্ম সম্বন্ধে কোনো প্রশ্ন ছিল না। ফলে সরকারিভাবে জানানো হয়নি ১৯ লাখের মধ্যে কতজন কোন ধর্মাবলম্বী। কিন্তু বেসরকারিভাবে জানা যাচ্ছে, ওই ১৯ লাখের মধ্যে হিন্দুর সংখ্যা ১২ লাখ।

এনআরসিকে কেন্দ্র করে বহির্বিশ্বে ভারতের ভাবমূর্তি যাতে নষ্ট না হয়, সে জন্য পররাস্ট্র মন্ত্রণালয় সচেষ্ট। ইতিমধ্যেই মানবাধিকার রক্ষার আন্দোলনকর্মীরা এনআরসি নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলেছেন। প্রশ্ন উঠেছে শাসক দলের ভূমিকা নিয়েও। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাই বিবৃতি দিয়ে দুটি বিষয় স্পষ্ট করে দিয়েছে। প্রথমত, গোটা প্রক্রিয়ায় সরকারের কোনো ভূমিকা নেই। পুরোটাই সুপ্রিম কোর্টের এখতিয়ার। তাঁর নির্দেশে সবকিছু হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, গোটা প্রক্রিয়া চূড়ান্তভাবে শেষ না হওয়া পর্যন্ত কাউকেই ‘বিদেশি’ অথবা ‘রাষ্ট্রহীন’ বলা হবে না। কারও নাগরিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হবে না।

কিন্তু এই কথা বলা হলেও ভারতের নির্বাচন কমিশন ১ সেপ্টেম্বর থেকে আসামসহ সারা দেশে প্রকৃত ভোটার তালিকা তৈরির কাজ হাতে নিয়েছে। ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত এই যাচাই–বাছাইয়ের কাজ চলবে। প্রশ্ন হলো, আসামের ১৯ লাখ প্রশ্নবিদ্ধ নাগরিকের ভোটের অধিকারের কী হাল হবে? এই সময়ের মধ্যে প্রশ্নবিদ্ধ নাগরিকদের আবেদনের মীমাংসা চূড়ান্ত হবে না। কারণ, তাদের আবেদনের জন্য চার মাস সময় নির্ধারিত রয়েছে। তারপর হাইকোর্ট। তারও পর সুপ্রিম কোর্ট রয়েছে। ‘অনাগরিক’ বলে কেউ গণ্য হবেন তারপর।