সেই আলোচিত 'ট্যাংক ম্যান' আলোকচিত্রী চার্লি কোল মারা গেছেন

‘ট্যাংক ম্যান’, আলোচিত সেই ছবি। তিয়েনআনমেন বিক্ষোভের সময় শপিং ব্যাগ হাতে অজ্ঞাতনামা বিক্ষোভকারীর সারি বেঁধে আসা কামানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছবিটি এ আন্দোলনের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। ছবি: রয়টার্স
‘ট্যাংক ম্যান’, আলোচিত সেই ছবি। তিয়েনআনমেন বিক্ষোভের সময় শপিং ব্যাগ হাতে অজ্ঞাতনামা বিক্ষোভকারীর সারি বেঁধে আসা কামানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছবিটি এ আন্দোলনের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। ছবি: রয়টার্স

সারি বেঁধে আসা ট্যাংকের চলার পথে শপিং ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে আছেন এক ব্যক্তি। পরনে সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট। চীনের তিয়েনআনমেন স্কয়ারের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সম্পর্কে যাঁরা জানেন, তাঁদের কাছে ট্যাংকের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তির ছবিটি অতিপরিচিত। গণতান্ত্রিক আন্দোলনে প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে পরিণত হয় ছবিটি। ঘটনার ৩০ বছর পরও দিবসটি পালনের সময় এই ছবির ওই ব্যক্তির আদলে প্রতীকী প্রতিবাদ জানায় মানুষ। সেই ছবির কারিগরদের অন্যতম চার্লি কোল মারা গেছেন।

মার্কিন এই চিত্রসাংবাদিক ইন্দোনেশিয়ার বালিতে বসবাস করছিলেন। সেখানে গত সপ্তাহে ৬৪ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়। তাৎক্ষণিকভাবে তাঁর মৃত্যুর খবরটি জানতে পারেনি গণমাধ্যম।

আজ শুক্রবার বিবিসি অনলাইনের খবরে বলা হয়, ‘ট্যাংক ম্যান’ ছবিটির জন্য চার্লি কোল ১৯৯০ সালে ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো পুরস্কার জিতেছিলেন।

১৯৮৯ সালের ৫ জুন কোলসহ চার চিত্রসাংবাদিক ছবিটি তুলতে পেরেছিলেন। তিনি একটি হোটেলের ব্যালকনি থেকে টেলিফটো লেন্স ব্যবহার করে মার্কিন সাময়িকী নিউজউইকের জন্য ছবিটি তুলেছিলেন।

পরে এক সাক্ষাৎকারে কোল জানান, তিনি ভেবেছিলেন ট্যাংকের সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করা অজ্ঞাতনামা প্রতিবাদকারীকে মেরে ফেলা হবে। তাঁর তখন মনে হয়েছিল, এরপর কী ঘটে সেটার রেকর্ড রাখা তাঁর দায়িত্ব। তবে ওই সময় দুজন লোক এসে ওই ব্যক্তিকে টেনে নিয়ে যান। এরপর কী ঘটেছে তা তাঁর জানা নেই।

বেইজিংয়ের তিয়েনআনমেন স্কয়ার। ছবি: রয়টার্স
বেইজিংয়ের তিয়েনআনমেন স্কয়ার। ছবি: রয়টার্স

১৯৮৯ সালের ১৫ এপ্রিল নিহত হন চীনের সরকারবিরোধী বুদ্ধিজীবী হু ইয়াওব্যাং। তাঁর মৃত্যুর পর থেকেই চীনের বেইজিংয়ের তিয়েনআনমেন স্কয়ারকে কেন্দ্র করে ছাত্র, জনতা ও পেশাজীবীরা প্রতিবাদে ফেটে পড়েন। গণতন্ত্রের দাবিতে সে বছরের ১৫ এপ্রিল থেকে ৪ জুন পর্যন্ত ১ মাস ২০ দিন শিক্ষার্থী, জনতাসহ বিভিন্ন পেশাজীবী অবস্থান নিয়েছিলেন। বেইজিংসহ বিভিন্ন শহরের প্রায় ১০ লাখ মানুষ এই বিক্ষোভে অংশ নেয়। সেনাবাহিনী নামিয়ে সেদিন গণ-অভ্যুত্থান দমন করা হয়। বলা হয়, ওই বিক্ষোভে সেনাবাহিনীর হাতে প্রাণ হারিয়েছেন হাজারের বেশি বিক্ষোভকারী। সেন্সরশিপ আরোপের দক্ষতায় ইতিহাসের সে অধ্যায়টি নতুন প্রজন্মের কাছে অজানা রাখার চেষ্টা করছে কমিউনিস্ট সরকার।

‘ট্যাংক ম্যান’ ছবিটি যে চারজন তুলেছিলেন, তাঁর মধ্যে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) আলোকচিত্রী জেফ ওয়াইডনেরও একজন। বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, বিক্ষোভ দমন শেষে ৫ জুন ট্যাংকগুলো ফেরার পথে তিয়েনআনমেন স্কয়ারের উত্তর প্রান্তে চ্যানগান অ্যাভিনিউয়ে অজানা ওই বিক্ষোভকারী ট্যাংকের গতি রোধ করে দাঁড়ান। ট্যাংক তাঁকে পাশ কাটাতে থাকলে তিনি বারবার তাঁর অবস্থান পাল্টে ট্যাংকের গতি রোধ করে দাঁড়াচ্ছিলেন। পরে পথচারীরা তাঁকে সরিয়ে নেন। ঘটনাস্থল থেকে আধা মাইল দূরে বেইজিং হোটেলের সাততলার বারান্দা থেকে ছবিটি তোলেন জেফ ওয়াইডনের। এটিসহ ওই গণ-অভ্যুত্থানের ছবি তাঁর হোটেল থেকে অন্তর্বাসে করে বেইজিংয়ে মার্কিন দূতাবাসে পৌঁছে দেন বিক্ষোভে অংশ নেওয়া এক শিক্ষার্থী।

বিক্ষোভের সংবাদ প্রচার করতে আসা বিদেশি সাংবাদিকদের চীন সরকার ওই সময় দেশটি থেকে বহিষ্কার করে। চীনের সংবাদপত্রে এ-সংক্রান্ত খবর প্রচারের ওপর সেন্সরশিপ আরোপ করে।

‘ট্যাংক ম্যান’ ছবিটি প্রসঙ্গে চার্লি কোল বলেছিলেন, চীনা নিরাপত্তা বাহিনী এই ছবির সন্ধানে তাঁকে ধরতে পারে, এই ভয়ে তিনি ফিল্মটি বাথরুমে লুকিয়ে রাখেন। এর কিছু পরেই দরজা ভেঙে তাঁর কক্ষে তল্লাশি চালানো হয়। তবে তারা ফিল্মটি খুঁজে পায়নি। তিনিসহ চার চিত্রসাংবাদিকের তোলা সেই ছবি বিশ্বজুড়ে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের আইকনিক প্রতীক হয়ে রয়েছে।

সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের খবরে বলা হয়েছে, নব্বইয়ের দশকে এক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে কোলের সাংবাদিক পেশায় ছেদ পড়ে। টোকিও যাওয়ার পথে তাঁর হার্লে ডেভিডসন গাড়িটি দুর্ঘটনায় পড়লে তাঁর বাম পা কেটে ফেলতে হয়। দীর্ঘ চিকিৎসার পর তিনি টোকিও থেকে প্রথমে জাকার্তা এবং পরে বালিতে চলে আসেন। সেখানে ১৫ বছর ধরে নিজের ভিলায় তিনি ইন্দোনেশীয় স্ত্রী রোসান্নার সঙ্গে বসবাস করতেন। ধীরে ধীরে তিনি বাণিজ্যিক আলোকচিত্র থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন। শারীরিক অনেক যন্ত্রণা ভোগের মধ্য দিয়ে তাঁকে যেতে হয়েছে, কিন্তু কখনো তা প্রকাশ করতেন না।