লড়াই এবার অর্থনীতির

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। ফাইল ছবি
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। ফাইল ছবি

দেশের অভাবিত অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে রা না কেড়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, তাঁর দ্বিতীয় দফার সরকারের প্রথম ১০০ দিনে মানুষ যা দেখেছে, তা নিছকই ‘ট্রেলার’। সিনেমার পুরোটাই এখনো বাকি।

অথচ অর্থনীতির হাল নিয়ে উদ্বিগ্ন সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বলেছেন, মোদি সরকার খবরের কাগজে হেডলাইন হতে বেশি ভালোবাসে। ওই বদভ্যাস ছেড়ে সরকার বরং অর্থনীতির লাটে ওঠা বন্ধে সচেষ্ট হোক। স্পষ্টতই, বিজেপির বিরুদ্ধে সোনিয়া–মনমোহন সিংয়ের কংগ্রেস লড়াইটা অর্থনীতির আঙিনায় টেনে আনতে চাইছে।

অর্থনীতি নিয়ে বিচলিত মনমোহন সিং দুটি সংবাদপত্রকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নরেন্দ্র মোদিকে ছয়টি পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, হাল ফেরাতে হলে এইভাবে চলুন। নইলে আফসোসের অন্ত থাকবে না। তিনি বলেছেন, ‘দেশ যে অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে চলছে, তা অস্বীকার করার আর কোনো উপায় নেই। অনেকটা সময় নষ্ট হয়ে গেছে। এখন আর মলম লাগানোর মানে হয় না। কোনো কোনো ক্ষেত্রকে কিছু সুবিধে পাইয়ে দিয়ে অথবা নোট বাতিলের মতো চমক দিয়ে সময় না নষ্ট করে সরকারের উচিত সংস্কারে মন দেওয়া।’

সেই সংস্কারগুলো কী, তা বলার আগে নরেন্দ্র মোদির সরকারকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনে করিয়ে দিয়েছেন, তিনি যখন প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, কিংবা তার আগে যখন অর্থমন্ত্রী ছিলেন, তখন জনগণের এই বিপুল সমর্থন তাঁদের পক্ষে ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও সংস্কারের মধ্য দিয়ে তাঁরা ১৯৯১ ও ২০০৮ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠেছিলেন। মোদিকে তিনি সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘একবার নয়, পরপর দুবার আপনার সরকার পূর্ণ সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে। এবার সেই সংকটকে সংকট বলে স্বীকার করে সংকটমোচনের রাস্তায় হাঁটুন। তা করার আগে খোলামনে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলুন। যারা সংকটে রয়েছে, তাদের কথা শুনুন। এবং পরিত্রাণ পেতে সরকার যে সচেষ্ট, তার প্রমাণ রাখুন।’

মনমোহন সিং বলেছেন, ‘সরকারকে মানুষের মনে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে এবং সেই বার্তা গোটা বিশ্বকে জানাতে হবে। দুঃখের বিষয়, এখন পর্যন্ত সেই একমুখী ব্যগ্রতা এই সরকার দেখাতে পারেনি।’

অর্থনীতির সংকটমোচনে মনমোহন সিংয়ের পাঁচ দাওয়াইয়ের প্রথমেই রয়েছে অভিন্ন পণ্য ও পরিষেবা করকে (জিএসটি) বাস্তবমুখী ও সরলীকৃত করা। যেভাবে তাড়াহুড়া করে মোদি সরকার জিএসটি চালু করেছিল, মনমোহন শুরু থেকেই তার বিরোধিতা করেছিলেন। মনমোহন তখন বলেছিলেন, ত্রুটিপূর্ণ জিএসটির রূপায়ণ এবং নোট বাতিলের মতো অবিবেচক সিদ্ধান্ত দেশের প্রবৃদ্ধির হার অন্তত ২ শতাংশ কমিয়ে দেবে। মনমোহনের সেই আশঙ্কা অতিদ্রুত সত্য হয়েছে। তাঁর প্রথম দাওয়াই তাই জিএসটির সরলীকরণ এবং তাকে যুক্তিগ্রাহ্য করে তোলা। তিনি বলেছেন, এতে প্রাথমিকভাবে রাজস্ব কম হলেও আখেরে লাভ হবে।

সাবেক অর্থমন্ত্রীর দ্বিতীয় সুপারিশ গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙা করার। তিনি বলেছেন, কৃষিক্ষেত্রে সংস্কার আনতেই হবে। তা হলে গ্রামীণ উপভোক্তাদের চাহিদা বাড়বে। তিনি বলেন, কী করে কৃষিক্ষেত্রকে চনমনে করে তোলা যায়, তার উপায় গত নির্বাচনে কংগ্রেসের ইশতেহারে লেখা আছে। মোদির উদ্দেশে মনমোহন বলেছেন, সেই ইশতেহারটা একটু দেখে নিতে পারেন।

বাজারে নগদের জোগান উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে, সেটা বাড়াতে হবে। সেই কাজে শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংককে হাত বাড়ালে চলবে না, নন–ব্যাংকিং অর্থলগ্নি সংস্থাগুলোকে (এনবিএফসি) টেনে আনতে হবে। চতুর্থত, যেসব শিল্পে কর্মসংস্থান বেশি হয় যেমন বস্ত্রশিল্প, গাড়ি তৈরির কারখানা, ইলেকট্রনিকস অথবা গৃহনির্মাণশিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করে তুলতে হবে। এই শিল্পগুলোতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগপতিরা যাতে সহজে ঋণ পেতে পারেন, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। রপ্তানি প্রসঙ্গে মনমোহন বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বাণিজ্য লড়াইয়ের কুফল পড়েছে ভারতের ওপর। কাজেই নতুন রপ্তানিযোগ্য বাজার ভারতকে খুঁজে নিতে হবে।

মোদি সরকারকে মনমোহন সিংয়ের শেষ সুপারিশ অবকাঠামো ক্ষেত্রের সংস্কার। শুধু সরকারি বিনিয়োগ নয়, এই ক্ষেত্রে বেসরকারি লগ্নিরও প্রয়োজন। সেই কারণে তিনি বলেছেন, অবকাঠামো ক্ষেত্রের সংস্কার অত্যাবশ্যক। মনমোহন সিংয়ের মতে, অবিলম্বে কাজ শুরু না করতে পারলে ভারতের ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি হওয়ার স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে।

লড়াইটা যখন অর্থনীতির, কংগ্রেস তখন নরেন্দ্র মোদির ‘সিনেমা এখনো বাকি’ মন্তব্য নিয়ে কটাক্ষ করতে সময় নেয়নি। সাবেক মন্ত্রী ও আইনজীবী কপিল সিবাল শুক্রবার টুইট করে বলেছেন, ট্রেলার বলে দিচ্ছে, বাকি সিনেমা দেখার দরকার নেই। প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়িয়েছে ৫ শতাংশে। রাজস্ব আদায় বেড়েছে মাত্র ১ শতাংশ, যেখানে গত বছর ২২ শতাংশ ছিল। মানুষ সবকিছু কম কম কিনছে। ১০ মাস ধরে গাড়ি বিক্রি কমেই চলেছে। কমেছে জিএসটি আদায় এবং লগ্নি। কপিল সিবাল কটাক্ষ করে বলেছেন, এত কিছু কমার মধ্যে বেড়েছে বেকারত্বের হার। আপাতত তা ৮ দশমিক ২ শতাংশ! বাকি সিনেমা আর দেখতে চাই না।

লড়াইটা অর্থনীতির। কংগ্রেসের নেতা–কর্মীদের প্রতি সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীর নির্দেশ—ছড়িয়ে পড়ুন। দেশের বিপন্ন অর্থনীতির প্রকৃত ছবি মানুষের কাছে তুলে ধরুন।