নীরব ঘাতক এসএফসিক্স গ্যাস

বৈদ্যুতিক সঞ্চালনব্যবস্থার সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে এসএফসিক্স গ্যাসের ব্যবহার বাড়ছে। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
বৈদ্যুতিক সঞ্চালনব্যবস্থার সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে এসএফসিক্স গ্যাসের ব্যবহার বাড়ছে। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশ প্রস্তুতকরণ শিল্পে সালফার হেক্সাফ্লুরাইড বা এসএফসিক্সের ব্যাপক ব্যবহার হয়। বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট, অগ্নিকাণ্ডসহ বৈদ্যুতিক বিভিন্ন দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কাজ করে এটি। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য দায়ী গ্রিনহাউস গ্যাসগুলোর মধ্যে এটিই সবচেয়ে শক্তিশালী। তবে স্বল্পপরিচিত এই গ্যাসের নিঃসরণের হার সাম্প্রতিক বছরগুলোয় অনেক বেশি বেড়ে গেছে। কেবল ২০১৭ সালেই ইউরোপ মহাদেশে এই গ্যাসের যে পরিমাণ নিঃসরণ হয়েছে, তা বিশ্বজুড়ে সড়কে অতিরিক্ত আরও ১৩ লাখ গাড়ি নামালে যতটা গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হতো, তার সমান।

সস্তা ও অদাহ্য এসএফসিক্স গ্যাস বর্ণ ও গন্ধহীন। মাঝারি ও উচ্চ ভোল্টেজের বৈদ্যুতিক স্থাপনায় এটি কার্যকর অন্তরক উপকরণ হিসেবে ব্যবহার হয়।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, কার্বন ডাই–অক্সাইডের চেয়ে এসএফসিক্স গ্যাস ২৩ হাজার ৫০০ গুণ বেশি উষ্ণ। এই গ্যাস পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে অপেক্ষাকৃত বেশি সময় ধরে টিকেও থাকে। নিঃসরিত এসএফসিক্স গ্যাস অন্তত এক হাজার বছর ধরে পৃথিবীকে উষ্ণতর করে চলতে পারে।

প্রশ্ন উঠতে পারে, এতটা ক্ষতিকর হওয়া সত্ত্বেও এই গ্যাস কেন এখনো ব্যবহার হচ্ছে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে মানুষ দিনে দিনে নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে বেশি ঝুঁকছে। এই পরিবর্তনের ফলে বৈদ্যুতিক সঞ্চালনব্যবস্থায় দুর্ঘটনা প্রতিরোধে আরও বেশি পরিমাণে সংযোগ, অতিরিক্ত সুইচ, সার্কিট ব্রেকারসহ নতুন নতুন সংযোজন হচ্ছে। সামগ্রিকভাবে এসব সংযোজনকে সুইচগিয়ার বলে। এসব ব্যবস্থায় শর্টসার্কিটসহ দুর্ঘটনা প্রতিরোধে অন্তরক হিসেবে ব্যাপকভাবে এসএফসিক্স গ্যাস ব্যবহার হয়।

বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এসএফসিক্স বায়ুমণ্ডলে মিশছে মূলত অন্তরক পদার্থের ফাটল বা ছিদ্রের মাধ্যমে নিঃসরিত হয়ে। যুক্তরাজ্যের ওয়েলসে অবস্থিত ইউনিভার্সিটি অব কার্ডিফের একটি গবেষক দল পুরো দেশে বৈদ্যুতিক সঞ্চালন ও বিতরণব্যবস্থার ওপর সম্প্রতি একটি সমীক্ষা চালিয়েছে। তারা বলেছে, যুক্তরাজ্যজুড়ে বর্তমানে প্রায় ১০ লাখ কেজি এসএফসিক্স ব্যবহার হচ্ছে। প্রতিবছর এর ব্যবহার বাড়ছে ৩০ থেকে ৪০ টন হারে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, বর্তমানে এসএফসিক্সের নিঃসরণ হার কার্বন ডাই–অক্সাইডের তুলনায় খুব কম হলেও ২০৩০ সাল নাগাদ তা ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। এই গ্যাসের মূল সমস্যা হলো, এটি বায়ুমণ্ডলে শোষিত বা প্রাকৃতিকভাবে এর উপাদান ভেঙে যায় না। এই সংকট মোকাবিলার একমাত্র উপায়, বায়ুমণ্ডল থেকে এসএফসিক্স অপসারণ।

ইউরোপীয় কমিশন ২০১৪ সালে এসএফসিক্সসহ মানুষের প্রস্তুতকৃত ক্ষতিকর কিছু গ্যাস (এফ–গ্যাস নামে পরিচিত) নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু ইউরোপজুড়ে ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম প্রস্তুত ও ব্যবহারকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রবল বিরোধিতার মুখে সে উদ্যোগ সফল হয়নি। ইউনিভার্সিটি অব কার্ডিফের স্কুল অব ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক মানু হাদ্দাদ বলেন, আপাতত এসএফসিক্সের প্রমাণিত বিকল্প নেই বললেই চলে।

এরপরও ইউরোপীয় ইউনিয়ন আগামী বছর এসএফসিক্সের বিকল্প কিছু কাজে লাগানো যায় কি না, তা পর্যালোচনা ও পরীক্ষা–নিরীক্ষা করবে।