যুক্তরাজ্যের আদালতে অলিখিত সংবিধানের বিড়ম্বনা

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

অলিখিত সংবিধানের দেশ যুক্তরাজ্যে রাষ্ট্রের মৌলিক তিনটি স্তম্ভ—আইন বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগ এত দিন পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও রীতির ভিত্তিতেই ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করে আসছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক পার্লামেন্ট স্থগিত করার ঘটনায় সরকার ও আইন বিভাগের মধ্যকার সৃষ্ট বিবাদ আদালতে গড়ানোর পর সংশ্লিষ্ট স্তম্ভগুলোর ক্ষমতার পরিধি নিয়ে এক জটিল ধাঁধার মুখোমুখি হয়েছেন দেশটির সুপ্রিম কোর্টের বিচারকেরা।

পার্লামেন্ট স্থগিতের বৈধতা নিয়ে স্কটল্যান্ডের কোর্ট অব সেশন ও ইংল্যান্ডের হাইকোর্টের দেওয়া পরস্পরবিরোধী রায়ের আপিল সমাধানে শুনানি করছে যুক্তরাজ্যের সুপ্রিম কোর্ট। গতকাল মঙ্গলবার শুনানির প্রথম দিনে সরকারের পক্ষে বারবার বলা হয়েছে যে পার্লামেন্ট স্থগিতের বিষয়টি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এখানে আইন ভঙ্গের মতো বিষয় যুক্ত নয়। কাজেই এ নিয়ে আদালত কোনো রায় দেওয়ার অধিকার রাখেন না।

অন্যদিকে পার্লামেন্ট স্থগিতের বৈধতা চ্যালেঞ্জকারীরা বলছেন, প্রায় পাঁচ সপ্তাহের জন্য পার্লামেন্ট স্থগিত করে প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতার চরম অপব্যবহার করেছেন। তিনি ব্রেক্সিট নিয়ে পার্লামেন্টের কণ্ঠ রোধ করতেই এ কাজ করেছেন, যা সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিতে পার্লামেন্টের অধিকারকে খর্ব করে।

ব্রেক্সিট (ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের বিচ্ছেদ) কার্যকর করার কৌশল নিয়ে সরকার ও পার্লামেন্টের মধ্যকার তুমুল বিরোধের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ১০ সেপ্টেম্বর থেকে পার্লামেন্টের অধিবেশন স্থগিত করেন। সরকারের নতুন কর্মপরিকল্পনা নিয়ে আগামী ১৪ অক্টোবর থেকে পুনরায় অধিবেশন শুরু হওয়ার কথা।

স্কটিশ ন্যাশনালিস্ট পার্টির (এসএনপি) জোয়ানা চ্যারির নেতৃত্বে ব্রেক্সিটবিরোধী ৭৫ জন আইনপ্রণেতা স্কটল্যান্ডের আদালতে সরকারের সিদ্ধান্তের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করেন। স্কটল্যান্ডের ‘কোর্ট অব সেশন’ সরকারের সিদ্ধান্তকে অবৈধ বলে রায় দেন। কিন্তু একই বিষয়ে ব্রেক্সিটবিরোধী প্রচারক জিনা মিলারের আরেকটি মামলায় ইংল্যান্ডের হাইকোর্ট বলেছেন, এটি রাজনৈতিক ব্যাপার। আদালতের সিদ্ধান্ত দেওয়ার বিষয় নয়।

কোর্ট অব সেশনের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে সরকার সুপ্রিম কোর্টে গেছে। আর জিনা মিলার হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেছেন।

গতকাল বিপরীতমুখী দুই আবেদনকারীর পক্ষে আদালতে বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়। জিনা মিলালের আইনজীবী লর্ড প্যানিক তাঁর আবেদন উপস্থাপন করে বলেন, পার্লামেন্ট স্থগিত করে প্রধানমন্ত্রী বরিস ক্ষমতার যে অপব্যবহার করেছেন, তা গত ৫০ বছরে আর ঘটেনি। নিজের কাজের জবাবদিহি এড়াতে তিনি এ কাজ করেছেন।

আর স্কটল্যান্ডের অ্যাডভোকেট জেনারেল লর্ড কিন সরকারের পক্ষে আবেদন উপস্থাপন করে বলেন, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে রায় দেওয়ার কোনো এখতিয়ার আদালতের নেই। সরকার নিজের কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের সুবিধার জন্য অবশ্যই পার্লামেন্ট স্থগিত করতে পারে। অতীতে একাধিকবার এমনটি ঘটার নজির আছে। একজন বিচারকের এক প্রশ্নের জবাবে আইনজীবী লর্ড কিন বলেন, প্রধানমন্ত্রী আদালতের রায় মেনে নেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আরেক বিচারকের প্রশ্নের জবাবে কিন বলেন, সরকারের সিদ্ধান্ত বৈধ ঘোষণা করা হলে সরকার আবারও পার্লামেন্ট স্থগিত করার সুযোগ নেবে না—এমন নিশ্চয়তা তিনি দিতে পারবেন না।

সরকারের তরফ থেকে আদালতে উপস্থাপন করা ৪৬ পৃষ্ঠার বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী সতর্ক করে দিয়ে বলেন, তাঁর পার্লামেন্ট স্থগিতের সিদ্ধান্ত নিয়ে রায় দেওয়ার কোনো এখতিয়ার আদালতের নেই। এমন কিছু করা হলে আদালত রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে প্রবেশের ঝুঁকিতে পড়বে। তিনি আদালতকে নিরপেক্ষতা বজায় রাখার আহ্বান জানান।

আজ বুধবার সরকারের আপিলের বিরুদ্ধে যুক্তি উপস্থাপন করেন জোয়ানা চ্যারির আইনজীবী। আর জিনা মিলারের আপিলের বিরুদ্ধে বক্তব্য উপস্থাপন করে সরকারপক্ষ।

যুক্তরাজ্যের আদালত মামলাটি এত গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছেন যে সুপ্রিম কোর্টের ১২ জন বিচারকের মধ্যে ১১ জনই শুনানিতে অংশ নিচ্ছেন। আগামীকাল বৃহস্পতিবার শেষ হবে তিন দিনের শুনানি। আগামীকাল ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির সাবেক প্রধানমন্ত্রী জন মেজর সরকারের বিরুদ্ধে আদালতে হাজির হবেন, যা হবে এক নজিরবিহীন ঘটনা। শুক্রবারের মধ্যেই রায় আশা করা হচ্ছে।

সমঝোতার ভান করা ঠিক হবে না
ইইউর পক্ষে প্রধান সমঝোতাকারী মিশেল বার্নিয়ে বলেছেন, ব্রেক্সিট নিয়ে সমঝোতার ভান করা ঠিক হবে না। তিনি বলেন, যুক্তরাজ্য কেবল সম্পাদিত ব্রেক্সিট চুক্তি নিয়ে আপত্তি জানিয়ে যাচ্ছে, এটি যথেষ্ট নয়। তাঁদের গ্রহণযোগ্য বিকল্প সমাধান নিয়ে হাজির হতে হবে।

ব্যাকস্টপের সংকট দূর করতে দুটি বিকল্প নিয়ে ভাবছে যুক্তরাজ্য। এগুলো হলো: এক. স্বাধীন আয়ারল্যান্ড এবং যুক্তরাজ্যের অংশ নর্দান আয়ারল্যান্ডের মধ্যে কৃষিজাত পণ্য ও গবাদিপশুর একক জোন গড়া; দুই. নর্দান আয়ারল্যান্ডকে ইইউ আইনের অধীনে রাখা হলে ইইউ আইনের ওপর নর্দান আয়ারল্যান্ডকে আপত্তি জানানোর অধিকার (ভেটো পাওয়ার) দিতে হবে। এই দুটি প্রস্তাবের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন বার্নিয়ে।