খাসোগি হত্যার প্রতিটি মুহূর্ত অডিও টেপে বন্দী

জাতিসংঘের বিশেষ দূত আগ্নেস ক্যালামার্ড। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
জাতিসংঘের বিশেষ দূত আগ্নেস ক্যালামার্ড। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

প্রথিতযশা সৌদি সাংবাদিক ও কলাম লেখক জামাল খাসোগি হত্যার বছর ঘুরে গেল। পুরো বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল এই হত্যাকাণ্ড। যে সৌদি আরব তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য কখনো কারও কাছে জবাবদিহি করা বা পাত্তা দেওয়ার চিন্তাও করে না, তারাও পশ্চিমা দেশগুলোর চাপে পড়ে সুর নরম করেছিল। শাস্তির ব্যবস্থাও নিয়েছে কয়েকজনের। তবে এ হত্যার নানা তথ্য, প্রমাণ যাঁর দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করেছিল, সেই ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানকে তারা ‘সাফসুতরোই’ দেখিয়েছে।

জামাল খাসোগি হত্যার অন্যতম বড় প্রমাণ ছিল গোপন রেকর্ড। খাসোগি হত্যার সময়ের প্রতিমুহূর্ত বন্দী হয়েছে গোপন টেপগুলোতে।

ঘটনাস্থল তুরস্কের ইস্তাম্বুলে অবস্থিত সৌদি কনস্যুলেট ভবনটিজুড়ে বসানো ছিল তুর্কি গোয়েন্দা সংস্থার শব্দ ধারণের ক্ষুদ্র মাইক্রোফোন। এতেই হত্যার পরিকল্পনা ও হত্যার সবকিছু রেকর্ড হয়েছে। টেপটি খুব অল্প মানুষই শুনেছেন। তাঁদের মধ্যে দুজন হচ্ছেন ব্রিটিশ আইনজীবী হেলেনা কেনেডি এবং বিচারবহির্ভূত হত্যার বিচারের জন্য জাতিসংঘের বিশেষ দূত আগ্নেস ক্যালামার্ড। তাঁর নেতৃত্বে খাসোগি হত্যার তদন্তবিষয়ক একটি দলে আমন্ত্রিত সদস্য ছিলেন কেনেডি। জাতিসংঘ এই আন্তর্জাতিক অপরাধ তদন্তে অনীহা প্রকাশ করলেও মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ ক্যালামার্ড তদন্তে দৃঢ়সংকল্প ছিলেন।

খাসোগি হত্যার বর্ষপূর্তির আগে আগে বিবিসির প্যানোরামা অনুষ্ঠানে যোগ দেন আগ্নেস ক্যালামার্ড ও হেলেনা কেনেডি। টেপে গোপনে ধারণ করা খাসোগি হত্যার সময়ের গা শিউরে ওঠা বর্ণনা দিয়েছেন তাঁরা।

গত বছরের ২ অক্টোবর তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেট ভবনের ভেতরে খাসোগি প্রবেশ করার পর আর বেরিয়ে আসেননি। সেখানে সৌদি গোয়েন্দারা তাঁকে হত্যার পর লাশ টুকরা টুকরা করে ফেলেছে বলে প্রমাণ পেয়েছে আন্তর্জাতিক নানা গোয়েন্দা সংস্থা। শুরুতে সৌদি আরব এ হত্যার কথা অস্বীকার করে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য দিলেও পরে সৌদি গোয়েন্দাদের মাধ্যমে হত্যার ঘটনা ঘটার কথা স্বীকার করে। তবে এর পেছনে সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান, যাঁকে সংক্ষেপে ‘এমবিএস’ বলে ডাকা হয়, তাঁর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনো ধরনের সম্পৃক্ততার কথা এখন পর্যন্ত অস্বীকার করে চলেছে দেশটি। তবে সবশেষ খবর হলো, এক সাক্ষাৎকারে যুবরাজ মোহাম্মদ হত্যার দায় নিয়েছেন এই বলে যে তাঁর ক্ষমতায় থাকার সময়ে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। তাই এর দায় তাঁর রয়েছে।

একসময়ের সৌদি সরকারের প্রিয়ভাজন খাসোগি রোষানলে পড়েন যুবরাজ মোহাম্মদ ২০১৭ সালের জুন মাসে ক্রাউন প্রিন্স হওয়ার পর। সৌদি শাসকের বিরুদ্ধাচরণ করা ব্যক্তিদের ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করেন তিনি। ওই সময় দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে আশ্রয় নেন খাসোগি। সেখানে ওয়াশিংটন পোস্টে কলাম লেখা শুরু করেন। তাঁর লেখায় তিনি কড়া সমালোচনা করতেন যুবরাজ মোহাম্মদের কার্যকলাপের।

এদিকে খাসোগি হত্যার টেপ শোনার সুযোগ পেতে কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি ক্যালামার্ডকে। এক সপ্তাহের চেষ্টার পর তুর্কি গোয়েন্দা সংস্থা একজন আরবি অনুবাদকসহ টেপগুলো শোনার সুযোগ দেয়। খাসোগি হত্যা যে পূর্বপরিকল্পিত তা প্রমাণের জন্য ওই টেপগুলো শুনতে পাওয়া অনেক কাজে লেগেছে বলে জানান ক্যালামার্ড।

টেপের গুরুত্বপূর্ণ ৪৫ মিনিট শুনতে পেরেছেন ক্যালামার্ড ও কেনেডি।

‘লাশ কাটতে কাটতে গান শুনি’

খাসোগিকে হত্যা করতে ১৫ সদস্যের স্কোয়াডের মধ্যকার কথোপকথন অডিও টেপ থেকে শুনে বিশদ নোট তৈরি করেছিলেন কেনেডি। তিনি বলেন, ‘তাদের হাসির শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। খুব ঠান্ডা মাথায় একজনকে মেরে ফেলার ক্ষণ গুনছিল লোকগুলো। তারা জানত, এই লোকটা তাদের কাছে আসবে। আর তারা তাঁকে দুনিয়া থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে।’

ব্রিটিশ আইনজীবী হেলেনা কেনেডি। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
ব্রিটিশ আইনজীবী হেলেনা কেনেডি। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

কেনেডি বলেন, কারও আওয়াজে এমন ভয়াবহতা, কণ্ঠে এমন মৃত্যুভয়, আর জীবনের শেষ কিছু মুহূর্তের কথা শুনে যে কারও শরীরে কাঁপুনি ধরে যেতে বাধ্য।

হত্যাকাণ্ডের দিন গত বছরের ২ অক্টোবর জামাল খাসোগি তাঁর বিবাহবিচ্ছেদ–সংক্রান্ত কাগজ আনতে ইস্তাম্বুলের সৌদি কনস্যুলেট ভবনে যান। তুর্কি বাগদত্তা হাতিজে জেঙ্গিসকে বিয়ে করার জন্য ওই কাগজপত্র জরুরি ছিল। ওই দিন তাঁর সঙ্গে ছিলেন হাতিজে জেঙ্গিস। তিনি বাইরে অপেক্ষা করছিলেন। খাসোগি জানতেন অভ্যর্থনা কক্ষে তাঁর ফোন আটকে দেবেন কর্মকর্তারা। তাঁর ব্যক্তিগত তথ্য যেন সৌদি জানতে না পারে, সে জন্য জেঙ্গিসের কাছে ফোন গচ্ছিত রেখেছিলেন তিনি।

এর কয়েক দিন আগে ২৮ সেপ্টেম্বর যখন প্রথমবার খাসোগি কনস্যুলেটে যান, তাঁকে বোঝানো হয় কাগজপত্র নিতে কয়েক দিন পর আবার এখানে আসতে হবে তাঁকে। তাদের দেওয়া চা-কফির প্রস্তাবে বহুদিন পর যেন স্বদেশের আন্তরিকতা খুঁজে পেয়েছিলেন খাসোগি। তাই দ্বিতীয়বার সেখানে যাওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর মনে কোনো সন্দেহ জাগেনি।

ক্যালামার্ড জানান, খাসোগিকে প্রথম দিন অভ্যর্থনা জানানো হলেও তিনি চলে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে ইস্তাম্বুল থেকে ফোন চলে যায় রিয়াদে। সেই ফোন কলে নিখোঁজ ব্যক্তির (খাসোগি) সন্ধান পাওয়া গেছে বলে জানানো হয়।

২৮ সেপ্টেম্বরের কনস্যুলেট এবং রিয়াদের মধ্যে প্রায় চারবার ফোনালাপ হয়। এর মধ্যে তুরস্কের রাষ্ট্রদূত এবং পররাষ্ট্রবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নিরাপত্তাপ্রধানের মধ্যে কথোপকথনের রেকর্ডও পাওয়া গেছে। পুরো ব্যাপারটিকে তাঁরা জাতীয় দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবে ‘টপ সিক্রেট মিশন’ বলে আখ্যা দেন।

কেনেডি বলেন, ‘আমি নিশ্চিত, শীর্ষ পর্যায়ের নির্দেশেই এমন গুরুতর ও সুসংহত মিশন চলেছে।’ তিনি বলেন, বিশেষ অভিযান সৌদি বাদশাহ বা যুবরাজের অনুমতি ছাড়া সম্ভব নয়।

১ অক্টোবর বিকেলে তিন সৌদি গোয়েন্দা কর্মকর্তা ইস্তাম্বুলে চলে আসেন। তাঁদের দুজন সৌদি যুবরাজের অফিসে কাজ করতেন বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।

অডিও টেপ শুনে কেনেডি ও ক্যালামার্ড বুঝতে পারেন, মাহের আব্দুলাজিজ মুতরেব নামে এক ব্যক্তি ছিলেন এই হত্যা অভিযানের মূল হোতা। মুতরেবকে নিয়মিত যুবরাজের সঙ্গে তাঁর নিরাপত্তা বাহিনীর অংশ হিসেবে বিভিন্ন স্থানে অংশ নিতে দেখা গেছে।

কেনেডি বলেন, কনসাল জেনারেল ও মুতরেবের মধ্যকার ফোনালাপে ২ অক্টোবর খাসোগি আসার বিষয়টির উল্লেখ পাওয়া গেছে।

সৌদি সাংবাদিক ও কলাম লেখক জামাল খাসোগি। ছবি: এএফপি
সৌদি সাংবাদিক ও কলাম লেখক জামাল খাসোগি। ছবি: এএফপি

২ অক্টোবর সকালে কাগজপত্র নিতে খাসোগিকে ডাকেন দূতাবাসের কর্মকর্তারা। খাসোগি আর তাঁর বাগদত্তা হেতিস চেঙ্গিস যখন কনস্যুলেটের দিকে রওনা দেন, ঠিক সে সময় গা শিউরে ওঠা এক কথোপকথন চলছিল মুতরেব আর ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ ডা. আল তুবাইগির মধ্যে।

কেনেডি সেই বীভৎস কথোপকথনের কথা স্মরণ করে বলেন, ‘কীভাবে কাটাছেঁড়া করবেন, তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিচ্ছিলেন তুবাইগি। তাঁদের হাসির শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম।’ লোকটা বলছিলেন, ‘লাশ কাটতে কাটতে মাঝে মাঝে গান শুনি আমি। হাতে থাকে কফির মগ কিংবা সিগারেট।’

অডিও রেকর্ড শুনলে বোঝা যায়, নিজের কাজ সম্পর্কে খুব ভালোভাবেই অবহিত ছিলেন তুবাইগি। মুতরেবের সঙ্গে বলছিলেন, ‘এই প্রথম নিচে ফেলে টুকরা টুকরা করে লাশ কাটতে হবে। কসাইরাও তো ঝুলিয়ে পশু কাটার সুযোগ পায়। আমাকে মেঝেতেই কাজ সারতে হবে।’

খাসোগি হত্যার জন্য কনস্যুলেট ভবনের ওপরের তলা প্রস্তুত করা হয়। মেঝেতে প্লাস্টিক বিছিয়ে দেওয়া হয়। স্থানীয় তুর্কি কর্মীদের সেদিন ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়। খাসোগি কনস্যুলেট ভবনে ঢোকার সময় তারা বলাবলি করতে থাকে, ‘বলির পাঁঠা’ চলে এসেছে? এই নামেই তারা খাসোগিকে সম্বোধন করছিল। কাঁপা কাঁপা গলায় নোটবুকে টুকে রাখা তথ্যগুলো বিবিসিকে পড়ে শোনাচ্ছিলেন কেনেডি।

খাসোগি ভেবেছিলেন তাঁকে অপহরণ করা হচ্ছে
সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ অনুযায়ী, সৌদি কনস্যুলেট ভবনে স্থানীয় বেলা ঠিক সোয়া একটায় প্রবেশ করেন খাসোগি।

অডিও রেকর্ড থেকে জানা যায়, কনস্যুলেটে ঢুকতেই অভ্যর্থনা কমিটি জানায় খাসোগির গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নিয়ে বসে আছে ইন্টারপোল। তাঁকে অবশ্যই সৌদি আরবে ফিরে যেতে হবে। চার সন্তানের জনক খাসোগিকে বলা হয়, ‘ছেলেকে বার্তা পাঠিয়ে জানিয়ে দিন, আপনি ভালো আছেন।’ তাদের কথামতো কাজ করতে অস্বীকৃতি জানান খাসোগি। এরপর থেকে শুরু হয় খাসোগির নিস্তব্ধতা।

কেনেডি বলেন, অডিও রেকর্ড শুনতে শুনতে খুব ভালো করে বোঝা যায়, একজন আত্মবিশ্বাসী সাংবাদিক কীভাবে ভয়ার্ত, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে উঠছেন। কণ্ঠস্বরের ওই পরিবর্তনের ভেতরেই লুকিয়ে আছে পুরো ঘটনার ভয়াবহতা। আস্তে আস্তে টের পাচ্ছিলেন, তাঁর সঙ্গে খুব বাজে কিছু হতে যাচ্ছে।

সৌদির হত্যা পরিকল্পনার কথা খাসোগি কতটুকু আঁচ করতে পেরেছিলেন, ক্যালামার্ড সে ব্যাপারে নিশ্চিত নন। খাসোগি হয়তো ভেবেছিলেন, তাঁকে অপহরণ করা হবে। তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আমাকে ইনজেকশন দেবে নাকি?’ উত্তরে তাঁকে ‘হ্যাঁ’ বলা হয়েছিল।

দুবার জিজ্ঞেস করেছিলেন খাসোগি, ‘আমাকে কি অপহরণ করছ?’ তাদের ইতিবাচক উত্তর শুনে হতভম্ব খাসোগি জানতে চান, ‘একটা দূতাবাসের মধ্যে এ কাজ কীভাবে সম্ভব?’

ক্যালামার্ড জানান, এরপর গলা শুনে বোঝা যায়, খাসোগির শ্বাস রোধ করা হচ্ছে। খুব সম্ভবত তাঁর মাথায় প্লাস্টিকের ব্যাগ পেঁচিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অথবা হাত বা কিছু দিয়ে তাঁর মুখ চেপে ধরা হয়েছিল। এরপর ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ দলনেতাকে প্রয়োজনীয় কিছু নির্দেশ দেন। মুতরেব বলে ওঠেন, ‘এবার ওকে কেটে ফেল।’

এরপর বিচ্ছিন্নভাবে বেশ কিছু চিৎকার ভেসে আসে। একজন বলে, ‘কাজ হয়ে গেছে।’ আরেকজন বলে, ‘ওর মাথায় এটা পরিয়ে দাও। মাথাটা আলাদা করো।’ এসব কথা শুনেই কেনেডি ও ক্যালামার্ড বুঝতে পারেন, খাসোগির শিরশ্ছেদ করা হয়।

সিসিটিভি ফুটেজ অনুযায়ী, বেলা ঠিক তিনটায় স্যুটকেস আর প্লাস্টিকের ব্যাগ নিয়ে তিন ব্যক্তি কনস্যুলেট ভবন থেকে বেরিয়ে আসে। ক্যালামার্ডের বিশ্বাস, ওই ব্যাগেই ভরা ছিল খাসোগির দেহাবশেষ। গাড়িতে করে বেরিয়ে যায় লোকগুলো।

খাসোগির লাশ আর কখনো পাওয়া যায়নি।

সিসিটিভি ক্যামেরায় শেষবারের মতো ধারণ করা খাসোগির ছবি। ছবি: রয়টার্স
সিসিটিভি ক্যামেরায় শেষবারের মতো ধারণ করা খাসোগির ছবি। ছবি: রয়টার্স

করাত দিয়ে হাড় কাটার কোনো শব্দ পাওয়া গেছে কি না, জানতে চাইলে কেনেডি বলেন, অডিও টেপে তেমন কোনো শব্দ শোনা না গেলেও গুন গুন করে হালকা একটি শব্দ ভেসে আসছিল। তুর্কি গোয়েন্দাদের দাবি, ওটা করাত চালানোর শব্দ।

স্থানীয় সময় বেলা ৩টা ৫৩ মিনিটে খাসোগির পোশাক পরে এক লোক কনস্যুলেট থেকে বেরিয়ে আসেন, তবে তাঁর জুতাটা ছিল আলাদা। এর কিছুক্ষণ পরই সাদা প্লাস্টিকের ব্যাগ হাতে সৌদি স্কোয়াডের আরেক সদস্য বেরিয়ে আসেন। ইস্তাম্বুলের বিখ্যাত নীল মসজিদের দিকে রওনা দেন তাঁরা। পরে তাঁরা ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলে চলে আসেন। এর আগেই খাসোগির পোশাক পরে বেরিয়ে আসা ব্যক্তি পোশাক পাল্টান। ধারণা করা হয়, রাস্তার পাশের একটি বিনে প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে খাসোগির জামাকাপড় ফেলে দেওয়া হয়।

সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে ব্যক্তিগত জেট বিমানে করে রিয়াদে ফিরে যান সৌদি স্কোয়াডের সদস্যরা। তুরস্কে তাঁরা ২৪ ঘণ্টাও কাটাননি।

কনস্যুলেটের ভেতরে সেদিন আদতে কী ঘটেছিল, তা নিয়ে পরদিন সৌদি আরব আর তুরস্ক সরকারের ভিন্ন বক্তব্য পাওয়া যায়। সৌদি জোর গলায় দাবি করে, খাসোগি কনস্যুলেট ছেড়ে বেরিয়ে গেছেন। এদিকে তুর্কিরা বলেছে, খাসোগি ওই কনস্যুলেটের ভেতরেই আছেন।

খাসোগি গায়েব হওয়ার চার দিন আগের ফোন কলের রেকর্ডও তুর্কি গোয়েন্দাদের কাছে ছিল।

এবার তাহলে প্রশ্ন করতেই হয়, আগে থেকে জেনেও কেন খাসোগিকে সতর্ক করেনি তুর্কিরা?

এ প্রশ্নের উত্তরে ক্যালামার্ড বলেন, ‘আমার ধারণা, তারা আগে থেকে কিছু জানত না। কী ঘটেছে তার তাৎক্ষণিক খবর তুর্কিদের কাছে ছিল না। খাসোগি খুন হয়েছেন বুঝতে পেরেই তারা রেকর্ডিং উদ্ধার করেছে।’

তুর্কি গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হয়, পুরো ঘটনার প্রায় চার থেকে পাঁচ হাজার ঘণ্টার রেকর্ড তারা শুনেছে। এর মধ্যে থেকে উল্লেখযোগ্য ৪৫ মিনিট ক্যালামার্ড আর কেনেডির সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে।

খাসোগি হত্যার চার দিন পর আবারও তুরস্কে পা রাখেন একদল সৌদি কর্মকর্তা। সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে একে তদন্ত দল বলে দাবি করা হলেও ধারণা করা হয়, ওই দলের কাজ ছিল খুঁটিনাটি সব প্রমাণ গায়েব করে ফেলা। ২ অক্টোবরের পর থেকে প্রায় দুই সপ্তাহ পর্যন্ত তুরস্কের কোনো তদন্তকারীকে ওই বাড়িতে ঢুকতে দেয়নি সৌদি কর্তৃপক্ষ।

ক্যালামার্ড বলেন, তুর্কি গোয়েন্দারা যখন কনস্যুলেট ভবনে প্রবেশের সুযোগ পেয়েছিল, তখন আর কোনো প্রমাণ অবশিষ্ট ছিল না। খাসোগির ডিএনএরও কোনো প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। সব প্রমাণ মুছে ফেলা হয়েছে। এই অবস্থায় কনস্যুলেট থেকে প্রমাণ জোগাড় করে কীভাবে যে এই হত্যাকাণ্ডের যৌক্তিক সমাপ্তি ঘটবে, সে বিষয়ে সন্দিহান তাঁরা।