সৌদি-ইরান শত্রুতার নেপথ্যে

সৌদির যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ও ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি। ছবি: রয়টার্স
সৌদির যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ও ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি। ছবি: রয়টার্স

মধ্যপ্রাচ্য যথারীতি গরম। এখনকার উত্তপ্ত পরিস্থিতির কেন্দ্রে সৌদি আরব ও ইরান। আঞ্চলিক অস্থিরতার জন্য রিয়াদ ও তেহরান পরস্পরকে দোষারোপ করছে। কথায় কথায় হুমকি-ধমকি তো আছেই।

অবশ্য সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যকার এই বৈরিতা নতুন কিছু নয়। তারা দীর্ঘদিনের প্রতিপক্ষ, যাকে বলে ‘পুরোনো শত্রু’। দুই দেশের মধ্যে শত্রুতা বাড়তে বাড়তে এখন তা ভয়ানক রূপ নিয়েছে। তারা কেউ কারও ছায়া পর্যন্ত দেখতে চায় না। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে তেহরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছেদ করে রিয়াদ। কূটনৈতিক সম্পর্ক ছেদ করলেও দেশ দুটির মধ্যে বৈরিতার সম্পর্ক ঠিকই চলে। বরং দিনকে দিন এই বৈরিতা বাড়ছে।

কিন্তু সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে কেন এই বৈরিতা?

সৌদি আরব ও ইরান দুই প্রতিবেশী। ‘ছোট-খাটো’ প্রতিবেশী নয়, উভয়ই বেশ শক্তিশালী, প্রভাবশালী। প্রতিবেশী হলেও তাদের মধ্যে সদ্ভাব নেই। আছে নানান বিরোধ। এই বিরোধের মূলে আছে ধর্ম, রাজনীতি, আঞ্চলিক আধিপত্য, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের মতো বিষয়। এসব বিষয় নিয়ে দেশ দুটির মধ্যে দশকের পর দশক ধরে চলছে টানাপোড়েন।

ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। ছবি: রয়টার্স
ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। ছবি: রয়টার্স

সৌদি আরব সুন্নি মুসলিমপ্রধান দেশ। অন্যদিকে ইরান শিয়া মুসলিমপ্রধান দেশ। ধর্মীয় মতাদর্শ নিয়ে শুরু থেকেই উভয় দেশের মধ্যে একটা বিরোধ বিদ্যমান।

সৌদি আরব ঐতিহাসিকভাবে নিজেদের মুসলিম বিশ্বের নেতা মনে করে। সৌদি আরবকে নেতা মানতে নারাজ ইরান। মুসলিম বিশ্বকে নেতৃত্ব দিতে ইরানও মরিয়া। তা ছাড়া মুসলিম বিশ্বে ইরানের প্রভাবও কম নয়।

ধর্মীয় মতাদর্শগত বিরোধের সঙ্গে মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বের লড়াই যোগ হয়ে সৌদি আরব-ইরান সম্পর্ক মানেই এক দোলাচল। এই বিরোধ এতটাই প্রকট যে, তা শুধু সৌদি আরব ও ইরানের গণ্ডির মধ্যে আটকে নেই। বরং মধ্যপ্রাচ্য ছাপিয়ে সৌদি আরব-ইরান বিরোধের ছায়া পুরো মুসলিম বিশ্বে পড়েছে। এর ফলে রিয়াদপন্থী ও তেহরানপন্থী ধারা তৈরি হয়ে গেছে। ‘মুসলিম মুসলিম ভাই ভাই’ স্লোগান ভুলে দুই গ্রুপই পরস্পরকে দুর্বল বা ঘায়েল করতে ব্যস্ত।

১৯২৯ সালে সৌদি আরব ও ইরান প্রথম আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। তারপর দেশ দুটির মধ্যে অম্ল-মধুর সম্পর্ক চলতে থাকে। ১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামিক বিপ্লব সৌদি আরবকে প্রথমবারের মতো ‘ওপেন’ চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেয়। ইরান প্রকাশ্যে সৌদি আরবের সমালোচনা করতে থাকে। উপসাগরীয় অঞ্চলে সৌদি আরবকে যুক্তরাষ্ট্রের ‘চর’ হিসেবে তারা অভিহিত করে। সৌদি আরবও ইরানকে নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করতে থাকে। প্রভাব বাড়াতে ইরান তার মডেলের বিপ্লব অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে দিতে চায় বলে আশঙ্কা করে সৌদি আরব। ১৯৮০ সালে ইরাক যে ইরানে হামলা চালিয়ে বসে, তার মূলেও ছিল রিয়াদ-তেহরানকেন্দ্রিক শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব। তবে সৌদি আরব ও ইরান কখনো সরাসরি যুদ্ধে জড়ায়নি। দেশ দুটির মধ্যে যা হয়ে আসছে, তা স্নায়ুযুদ্ধ বা ছায়াযুদ্ধ।

সৌদি আরবের বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ। ছবি: রয়টার্স
সৌদি আরবের বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ। ছবি: রয়টার্স

গত প্রায় দুই দশকে ঘটে যাওয়া বেশ কিছু ঘটনার জেরে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যকার সম্পর্ক আরও তিক্ত হয়। ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকে সৌদি আরব নিজের জন্য চরম হুমকি বিবেচনা করে। তাই তারা এই কর্মসূচির ঘোরবিরোধী। একই সঙ্গে এই ইস্যুতে ইরানকে চরমভাবে শায়েস্তা করার পক্ষে রিয়াদ। সৌদি আরবের এই অবস্থান ইরানের ক্ষোভের অন্যতম কারণ।

ইরাকের সুন্নি প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন কট্টর ইরানবিরোধী ছিলেন। ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বাহিনী ইরাকে আগ্রাসন চালায়। পতন হয় সাদ্দাম হোসেনের। তাঁর পতন ইরানের জন্য স্বস্তি হয়ে আসে। ইরাকে ইরানের প্রভাব বৃদ্ধির পথ খুলে যায়। সেই থেকে ইরাকে ইরানের প্রভাব বেড়েই চলছে। এই উল্টো দৃশ্যে সৌদি আরবের কপালে ভাঁজ। তার প্রতিবেশী যে ইরাক একসময় ইরানের শক্ত প্রতিপক্ষ ছিল, সে-ই এখন তেহরানের ‘ভক্ত’ বনে গেছে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ছবি: রয়টার্স
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ছবি: রয়টার্স

২০১১ সালের আরব বসন্তের ছাঁট লেগেছিল সৌদি আরবে। কিন্তু তা ছড়িয়ে পড়তে পারেনি। সৌদি রাজতন্ত্র টিকে যায়। তবে পুরো অঞ্চলে রাজনৈতিক অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। এই অস্থির পরিস্থিতিকে নিজেদের জন্য একটা বড় ‘সুযোগ’ হিসেবে দেখে সৌদি আরব ও ইরান। আরব বসন্তের ঢেউ লাগা দেশগুলোতে প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়াতে উঠে-পড়ে লাগে দুই দেশ। ফলে দেশ দুটির মধ্যে সন্দেহ ও শত্রুতা চরম আকার ধারণ করে।

সৌদি আরবের সন্দেহ, ইরান পুরো অঞ্চল নিজের করায়ত্তে নিতে চায়। বিভিন্ন দেশে প্রভাব বাড়িয়ে নিজের অবস্থান সুসংহত করার মাধ্যমে তেহরান অপ্রতিরোধ্য আঞ্চলিক মোড়ল হতে চায়। এ জন্য ইরান অঞ্চলজুড়ে ছায়া (প্রক্সি) প্রতিষ্ঠা করছে।

সৌদি আরবের সন্দেহ অমূলক নয়। ইরাককে আগেই ইরান দলে ভিড়েছে। লেবাননে ইরান-ঘনিষ্ঠ হিজবুল্লাহ সামরিক ও রাজনৈতিকভাবে আগের চেয়ে অনেক শক্তিশালী। ইরান-সমর্থিত সিরীয় প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ অনেকটাই টিকে গেছেন। ইয়েমেন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ইরান-সমর্থিত শিয়াপন্থী হুতি বিদ্রোহীরা। এভাবেই নানান ফ্রন্টে আঞ্চলিক লড়াইয়ে ইরান জয়ী হচ্ছে। ইরানের জয় মানে সৌদির দুশ্চিন্তা। তাই সৌদি আরব মরিয়া হয়ে ইরানের আঞ্চলিক প্রভাব ঠেকাতে চাইছে। ইরানকে ঠেকানোর বর্তমান লড়াইয়ে সৌদির সিপাহসালার দেশটির যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান।