এনআরসি নিয়ে আশ্বাস, তবু থেকে গেল অস্বস্তি

রয়টার্স ফাইল ছবি
রয়টার্স ফাইল ছবি

আশ্বস্ত অবশ্যই, কিন্তু এনআরসির কিছু প্রশ্নের ব্যাখ্যা না পেয়েই ভারত সফর শেষে দেশে ফিরলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই সব প্রশ্নের ব্যাখ্যা পেতে তাঁকে আরও বহুদিন অপেক্ষায় থাকতে হবে।

জাতীয় নাগরিক তালিকা বা এনআরসি প্রসঙ্গ বাংলাদেশ-ভারতের দীর্ঘ যৌথ বিবৃতিতে স্থান পায়নি। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে প্রসঙ্গটি শেখ হাসিনা তোলেননি। আসামের এনআরসি নিয়ে তাঁর দেশের উদ্বেগের কথা আনুষ্ঠানিকভাবেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে গত শনিবারের বৈঠকে তুলেছিলেন। মোদিও তাঁকে সেই কথাই শুনিয়েছেন, যা তিনি নিউইয়র্কে বলেছিলেন। অর্থাৎ এ নিয়ে বাংলাদেশকে উদ্বিগ্ন হতে হবে না। এনআরসি পুরোপুরিই ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়।

অভ্যন্তরীণ ও একপক্ষীয় বিষয় বলেই যৌথ বিবৃতিতে এনআরসির উল্লেখ নেই। বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের এক সদস্য প্রথম আলোকে এ কথা জানালেও এ-সংক্রান্ত ভারতীয় ব্যাখ্যার অনেক কিছুই যে অনুচ্চারিত ও প্রশ্নবিদ্ধ রয়ে গেল, সে কথা জানাতে দ্বিধান্বিত হননি তিনি। ওই কর্মকর্তার কথায়, ‘প্রধানমন্ত্রী মোদি বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। আশঙ্কার কারণ নেই বলেছেন। তবু অনেক কিছু অমীমাংসিত ও অনেক ব্যাখ্যা অনুচ্চারিত রেখে আমরা দেশে ফিরছি।’

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব শহীদুল হক শনিবার রাতে সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘আমাদের সম্পর্কের সবচেয়ে ভালো অধ্যায় চলছে এখন। সম্পর্ক খুবই উষ্ণ ও বন্ধুত্বপূর্ণ। এ মুহূর্তে এনআরসি নিয়ে উদ্বিগ্ন না হলেও আমরা চোখকান খোলা রাখছি।’

যে প্রশ্নগুলোর ব্যাখ্যা বাংলাদেশ পায়নি তার একটি হলো আসাম রাজ্যে শেষ পর্যন্ত চূড়ান্তভাবে যাঁরা ‘অনাগরিক’ প্রতিপন্ন হবেন, তাঁদের নিয়ে কী করা হবে। সরকার বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করলেও শাসক দল বিজেপি তো বলেই চলেছে, বিদেশিদের ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ফেরত পাঠানো হবে। সরকার ও শাসক দলের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে কথার সামঞ্জস্য নেই কেন? এ প্রশ্নের কোনো সদুত্তর বাংলাদেশ এবারও পেল না। হাসিনা নিজেই প্রসঙ্গটির অবতারণা করে বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী মোদি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর আশ্বস্ত করলেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ প্রকাশ্য জনসভায় বারবার বলছেন, প্রত্যেক অনুপ্রবেশকারীকে ফেরত পাঠানো হবে।

>

শেখ হাসিনার ভারত সফর
আসামে যাঁরা ‘অনাগরিক’ হবেন, তাঁদের কী হবে?
বিজেপি তো বলছে, বিদেশিদের ফেরত পাঠানো হবে

প্রধানমন্ত্রী মোদি ও ভারতীয় প্রতিনিধিদলের সদস্যরা বৈঠকে যে বিষয় স্পষ্ট করেছেন তা হলো, আসামের এনআরসি হচ্ছে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ও নজরদারিতে। সরকারের এখানে কিছু করার নেই। বলা হয়েছে, মূল প্রক্রিয়া শেষ পর্যন্ত কোথায় এগিয়ে নিয়ে যায়, তার অপেক্ষা করতে হবে। বাংলাদেশের প্রশ্ন, একই প্রক্রিয়া সারা দেশে চালু করার অঙ্গীকারের কথা দলীয় নেতৃত্ব বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে। এর মানে, আসামের এনআরসি সমস্যা শেষ হলেও অন্যত্র, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি করা হলে তা নতুনভাবে দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠতে পারে। এনআরসি নাম দেওয়া না হলেও ইতিমধ্যেই উত্তর প্রদেশে ‘বিদেশি বাছাই অভিযান’ শুরু করার নির্দেশ রাজ্যের পুলিশ মহাপরিচালক দিয়েছেন। বাংলাদেশের প্রশ্ন, আসাম ছাড়া অন্যত্র কোথাও বিদেশি বাছাইয়ের নির্দেশ সুপ্রিম কোর্ট কিন্তু দেননি। শাসক দল নিজের উদ্যোগে তা করছে। সে ক্ষেত্রে সরকারের ব্যাখ্যা কী হবে? এনআরসি নিয়ে সরকারের আশ্বাসবাণী ও দলের কর্মসূচিতে কোথাও যেন সামঞ্জস্যের অভাব দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ সেই অভাব লক্ষও করছে।

এসব ব্যাখ্যা না জেনে ও প্রশ্ন অমীমাংসিত রেখে বাংলাদেশকে দেশে ফিরতে হলো। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে পররাষ্ট্রসচিব শহীদুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, এখনই তিলকে তাল বানানোর দরকার নেই। অপেক্ষা করা যাক।

বাংলাদেশের দুশ্চিন্তার অন্য কারণ প্রস্তাবিত নাগরিকত্ব বিলের সংশোধন। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে এ বিষয় আলোচিত হয়নি। কিন্তু এনআরসির সঙ্গে প্রস্তাবিত এই বিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত। নাগরিকত্ব বিল সংশোধিত হলে বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা। বাংলাদেশে এ মুহূর্তে হিন্দু নাগরিকের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ। ভারতের শাসক দলের বক্তব্য অবশ্য ভিন্ন। তাদের আনুষ্ঠানিক অভিমত, ভারতই সারা পৃথিবীর হিন্দুদের একমাত্র আশ্রয়স্থল। ভারত কোল পেতে না দিলে অত্যাচারিত হিন্দুদের কে আশ্রয় দেবে? আশ্রয় না দিলে তা হবে চরম অধার্মিকের কাজ।