তাইওয়ান: সমৃদ্ধির আড়ালে অস্থিরতা

তাইপে ১০১। তাইওয়ানের রাজধানীর চাকচিক্যের প্রধান একটি আকর্ষণ হচ্ছে এই ১০১-তলা উঁচু ভবন। ছবি: প্রথম আলো
তাইপে ১০১। তাইওয়ানের রাজধানীর চাকচিক্যের প্রধান একটি আকর্ষণ হচ্ছে এই ১০১-তলা উঁচু ভবন। ছবি: প্রথম আলো

২ কোটি ৩৫ লাখ জনসংখ্যার তাইওয়ান বিশ্বের সমৃদ্ধ এক অস্তিত্ব হিসেবে পরিচিত। রাষ্ট্রের দাবিদার হয়েও সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত দেশ না হওয়ায়, নিজের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ধরে রাখার জন্য নানা রকম পথের সন্ধানে গণচৈনিক ভূখণ্ডে থাকতে হচ্ছে তাইওয়ানকে।

তবে তা সত্ত্বেও রাজনীতির অদ্ভুত দোলাচলে পিছিয়ে থাকেনি তাইওয়ানের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা। মাথাপিছু আয় ২৪ হাজার ৩৪০ ডলার বিশ্বের প্রথম সারির দেশগুলোর তুলনায় খুব বেশি সমৃদ্ধির পরিচয় তুলে না ধরলেও, সম্পদের বণ্টন আর নাগরিক সেবার দিক থেকে অন্যান্য অনেক দেশের চেয়ে তুলনামূলক এগিয়ে আছে এই অঞ্চল। ফলে জনগণের জীবন এখানে অনেক বেশি নিরাপদ। দৈনন্দিন জীবনে বেঁচে থাকার সমস্যা থেকে মুক্ত। বিশেষ করে, সাম্প্রতিক সময়ে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় তাইওয়ানের এগিয়ে থাকা, সমৃদ্ধিতে নিয়ে এসেছে নতুন মাত্রা। ফলে রাজধানী তাইপের জাঁকজমক আর ভোগের জীবন ঘনায়মান মেঘকে আড়াল করে রাখলেও, নাগরিক জীবনের ভেতরে আলোকপাত করলে সমস্যার গভীরতার আঁচ সহজেই পাওয়া সম্ভব।

রাজধানী তাইপের পুরোনো শহরের রাতের বাজার। ছবি: প্রথম আলো
রাজধানী তাইপের পুরোনো শহরের রাতের বাজার। ছবি: প্রথম আলো

ঐতিহাসিকভাবে তাইওয়ান ভূখণ্ড দীর্ঘকাল ধরে ছিল চীনের একটি করদ রাজ্য। তবে অতীতের সমৃদ্ধ চীন ঊনবিংশ শতাব্দীতে এসে ক্রমে বিভক্ত এক সমাজে পরিণত হলে, দেশটি হারিয়ে ফেলে এর সব রকম প্রভাব আর প্রতিপত্তি। চীনের প্রভাববলয়ে থাকা মূল ভূখণ্ডের চারপাশের অনেক ছোট ছোট অস্তিত্ব তখন নিজেদের স্বাতন্ত্র্য অস্তিত্বের ঘোষণা দিতে তৎপর হয়ে ওঠে।

তবে আশপাশের অন্যান্য প্রভাবশালী দেশ ও সেই সঙ্গে বিশ্বজুড়ে আধিপত্য বিস্তার করা ঔপনিবেশিক শক্তির দাপটের মুখে অচিরেই এদের সেই আকাঙ্ক্ষার সমাপ্তি টানতে হয়। চীনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ১৮৮৫ সালে চীনকে যুদ্ধে পরাজিত করে জাপান দখল করে নিয়েছিল তাইওয়ান দ্বীপমালা। তখন থেকে ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয় পর্যন্ত তাইওয়ান ছিল পূর্ব এশিয়ায় নব্য শক্তি হিসেবে আবির্ভাব হওয়া জাপানের একটি উপনিবেশ। যুদ্ধে জাপানের পরাজয় তাইওয়ানকে আবারও সম্পৃক্ত করে দিয়েছিল চীনের সঙ্গে।

তবে কয়েক বছরের মধ্যে চীনে দেখা দেওয়া নতুন আলোড়ন তাইওয়ানকে আবারও আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসে। ১৯৪৯ সালে চীনে কমিউনিস্টদের ক্ষমতা দখলের ফলে চিয়াং কাই শেকের নেতৃত্বাধীন জাতীয়তাবাদী নেতৃত্ব দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে তাইওয়ান দ্বীপে আশ্রয় নেয়। নিজেদের চীনের বৈধ নেতৃত্ব হিসেবে ঘোষণা করার মধ্যে দিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম চীনের একটি সরকার সেখানে তারা প্রতিষ্ঠা করেন। চীনের মূল ভূখণ্ড থেকে বিতাড়িত হওয়া সত্ত্বেও বিশাল সেই দেশটির বৈধ প্রতিনিধি হিসেবে নিজেদের দাবি করে বসা কতটা যুক্তিসংগত কিংবা গ্রহণযোগ্য ছিল, সেই প্রশ্ন অবশ্য তখন থেকেই দেখা দিয়েছিল।

তাইপের অদূরের একটি পর্যটন স্থান। ছবি: প্রথম আলো
তাইপের অদূরের একটি পর্যটন স্থান। ছবি: প্রথম আলো

তবে যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমের অন্যান্য দেশ কমিউনিস্টবিরোধী অবস্থান থেকে সেই দাবির বৈধতা মেনে নিলে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবেই কেবল তাইওয়ানের স্বীকৃতি মেলেনি, একই সঙ্গে চীনের জন্য সংরক্ষিত জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যপদটিও তাইওয়ানকে দেওয়া হলে প্রভাবশালী এক দেশ হিসেবে বিশ্বের রাজনৈতিক মঞ্চে তাইওয়ানের আবির্ভাব ঘটেছিল।

পশ্চিমের দেশগুলো তাইওয়ানকে সামনে রেখে কমিউনিস্ট চীনকে পরাভূত করার বাসনায় আন্তর্জাতিক রাজনীতির যে খেলা সেদিন শুরু করেছিল, তা বজায় থাকে ১৯৭১ সালে গণচীনের জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভের আগ পর্যন্ত। ১৯৬০ এর দশকের শেষ দিকটায় এসে মস্কো-পিকিং বিরোধকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক রাজনীতির হিসাব হঠাৎ করে পাল্টে গেলে ওয়াশিংটন চীনের দিকে ঝুঁকতে শুরু করে। যার ফলে তাইওয়ান ক্রমে এর গুরুত্ব হারাতে শুরু করে এবং সেই পথ ধরেই জাতিসংঘের সদস্যপদই কেবল নয়, এমনকি পশ্চিমা মিত্রদের কাছ থেকে পাওয়া স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্বীকৃতিও তাওয়ানকে হারাতে হয়।

তখন থেকে দেশটির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক বজায় রাখা রাষ্ট্রের সংখ্যা ক্রমে সংকুচিত হয়ে এখন দাঁড়িয়েছে মাত্র ১৬টিতে। তবে তা সত্ত্বেও থেমে থাকেনি ভূখণ্ডের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা। বর্তমানে অবশ্য তাইওয়ানের ব্যবসায়িক অংশীদারদের তালিকার শীর্ষে আছে গণচীন, তাইওয়ানকে যারা নিজের দেশের বর্ধিত একটি অংশ বলে গণ্য করে থাকে।

পাহাড় আর সাগরঘেরা প্রকৃতি হচ্ছে তাইওয়ানের আরেক আকর্ষণ। ছবি: প্রথম আলো
পাহাড় আর সাগরঘেরা প্রকৃতি হচ্ছে তাইওয়ানের আরেক আকর্ষণ। ছবি: প্রথম আলো

তাইওয়ানের মোট রপ্তানির প্রায় ৪০ শতাংশের গন্তব্য হচ্ছে চীন। এ ছাড়া চীনের মূল ভূখণ্ডে তাইওয়ানের অর্থায়নে বাস্তবায়িত বিভিন্ন প্রকল্পে প্রায় চার লাখ তাইওয়ানি কর্মরত আছেন। মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে এই বাণিজ্যিক সম্পৃক্ততা বিগত দুই দশকে তাইওয়ানে চীনের প্রতি নমনীয় একটি রাজনৈতিক ব্লকের জন্ম দিয়েছে, যারা মনে করে চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা রক্ষা করে চলা তাইওয়ানের নিজ স্বার্থেই প্রয়োজন। ফলে চীনপন্থী এবং চীনের কট্টর বিরোধিতা করা দুই পক্ষের রাজনৈতিক বিভাজন এখন তাইওয়ানে যথেষ্ট প্রকট।

চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখার কারণে তাইওয়ানের যে খাতটি গত প্রায় দেড় দশকে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে, সেটা হলো ভূখণ্ডের পর্যটনশিল্প। চীনের মূল ভূখণ্ডের অনেকেই তাইওয়ানের বিভিন্ন পর্যটন স্থান ভ্রমণের উদ্দেশ্যে ভূখণ্ডের কাছাকাছি অবস্থানের সুযোগ গ্রহণ করে সেখানে যাচ্ছেন। ২০১৫ সালে যেমন ৪১ কোটি চীনা নাগরিক তাইওয়ান ভ্রমণ করেছিলেন, যা হচ্ছে সেই একই বছর জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং হংকং থেকে তাইওয়ান ভ্রমণে যাওয়া পর্যটকের সম্মিলিত সংখ্যার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ বেশি। তবে ২০১৬ সালে চীন বিরোধী গণতান্ত্রিক পার্টির নেত্রী সাই ইং-ওয়েন তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে চীনের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে চলতে শুরু করলে চীনা ভ্রমণকারীর সংখ্যা হ্রাস পেতে শুরু করে।

সর্বশেষ হিসাবে দেখা যায়, ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে আনুমানিক যে ১০ লাখ ৩০ হাজার বিদেশি পর্যটক তাইওয়ান ভ্রমণ করেছেন, চীনা পর্যটকের সংখ্যা সেখানে ছিল ২ লাখ ৮০ হাজারের মতো। চীন সরকার দেশের নাগরিকদের জন্য তাইওয়ান ভ্রমণের বহির্গমন ভিসা প্রদান বন্ধ করে দিলে সেই সংখ্যা এখন একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকবে বলে তাইওয়ানের পর্যটনশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আশঙ্কা করছেন। চীনের এই সর্বশেষ সিদ্ধান্তের পেছনে আছে সূক্ষ্ম কিছু রাজনৈতিক হিসাব, আগামী বছর জানুয়ারি মাসে নির্ধারিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সাইকে পরাভূত করার লক্ষ্যে যা হাতে নেওয়া হয়।

পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝরনা। ছবি: প্রথম আলো
পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝরনা। ছবি: প্রথম আলো

জানুয়ারির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিরোধী কুওমিনতাং পার্টির প্রার্থী হচ্ছেন তাইওয়ানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর কাওশিয়াংয়ের মেয়র হান কুও-ইয়ু। গত বছর নভেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত স্থানীয় নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট সাইয়ের গণতান্ত্রিক পার্টি ব্যাপকভাবে পরাজিত হওয়ার পর ধারণা করা হচ্ছিল যে জানুয়ারির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কুওমিনতাং প্রার্থীর জয় প্রায় অবশ্যম্ভাবী। তবে হংকংয়ের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি সেই হিসাবকে এখন অনেকটাই ঘুরিয়ে দিচ্ছে। বিশেষ করে, তাইওয়ানের তরুণ প্রজন্ম হংকংয়ের অভিজ্ঞতার আলোকে চীনের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে চলার দিকে ঝুঁকে পড়ছে এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফলকে তরুণেরা প্রভাবিত করতে পারে বলে অনেকেই এখন মনে করছেন।

তবে তা সত্ত্বেও জনসমর্থনের হার শেষ পর্যন্ত কোন দিকে ঝুঁকে পড়ে, তা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না। এর অনেকটাই হয়তো নির্ভর করবে হংকংয়ের গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলন বেইজিং কীভাবে সামাল দেয় তার ওপর। এ ছাড়া অর্থনীতির নিম্নমুখী যাত্রা অব্যাহত থাকলে শুধু রাজনৈতিক স্লোগানের মধ্য দিয়ে ভোটারদের অসন্তুষ্টি দূর করা সাইয়ের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দেখা দিতে পারে। ফলে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট গ্রহণ শুরু হওয়ার আগের তিন মাস তাইওয়ানের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক সময়।