সাহিত্যে পিটার হান্ডকের নোবেল জয় নিয়ে সমালোচনার ঝড়

এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য নাম ঘোষণা করা হয়েছে সাহিত্যিক পিটার হান্ডকের। ছবি: রয়টার্স
এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য নাম ঘোষণা করা হয়েছে সাহিত্যিক পিটার হান্ডকের। ছবি: রয়টার্স

সাহিত্যে অস্ট্রিয়ার নাট্যকার, ঔপন্যাসিক ও কবি পিটার হান্ডকের নোবেল পাওয়া নিয়ে বিশ্বজুড়ে সমালোচনার ঝড় বইছে। এ সমালোচনায় অংশ নিয়েছেন বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধানেরাও।

নব্বই দশকে বসনিয়া যুদ্ধে সার্বদের সমর্থন দেওয়ার কারণে হান্ডকে অত্যন্ত বিতর্কিত ছিলেন। পিটার হান্ডকের বিরুদ্ধে আলোচিত স্রেব্রেনিৎসা গণহত্যাকে অস্বীকার করার অভিযোগ রয়েছে। তিনি যুদ্ধাপরাধী স্লোভোদান মিলোসোভিচেরও ঘনিষ্ঠজন ছিলেন।

বসনিয়া যুদ্ধে সার্বিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট স্লোভোদান মিলোসোভিচের নেতৃত্বে সার্ব বাহিনী ১৯৯৫ সালের ১১ থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত মাত্র ১২ দিনে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার স্রেব্রেনিৎসা শহরের আট হাজারের বেশি মুসলিম পুরুষ ও ছেলেশিশু হত্যা করে। নারীদের বন্দীশিবিরে রেখে ধর্ষণ করা হয়।

আজ শুক্রবার বিবিসি অনলাইনের খবরে জানানো হয়, অস্ট্রিয়ার নাট্যকার, ঔপন্যাসিক ও কবি পিটার হান্ডকে গতকাল বৃহস্পতিবার ২০১৯ সালের নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পান।
অত্যন্ত মর্যাদাকর এই পুরস্কারটির তদারকিতে রয়েছে সুইডিশ একাডেমি। তারা এক বিবৃতিতে জানায়, হান্ডকে তাঁর লেখনীতে আবিষ্কারের প্রবল আকাঙ্ক্ষা, সাহিত্যের নতুন প্রকাশপদ্ধতি অনুসন্ধানের মাধ্যমে এসব আবিষ্কারকে জীবন দিয়েছেন।
পুরস্কার বাবদ হান্ডকা ৯০ লাখ সুইডিশ মুদ্রা ক্রোনার (৭ কোটি ৭৬ লাখ টাকার বেশি), একটি মেডেল ও সনদ পাবেন। গতকাল সুইডিশ একাডেমি সাহিত্যে নোবেলজয়ী দুজনের নাম ঘোষণা করেছে। এবার একসঙ্গে ২০১৮ ও ২০১৯ সালের নোবেলজয়ীর নাম ঘোষণা করা হয়। সাহিত্যে ২০১৮ সালের নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন পোল্যান্ডের লেখক অলগা তোকারতুক।

পুরস্কারের জন্য হান্ডকের নাম ঘোষণার পর তা নিয়ে শুরু হয় কঠোর সমালোচনা। অনেকে ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন। হান্ডকেকে বলা হয়, সাবেক সার্ব নেতা স্লোভোদান মিলোসোভিচের ঘনিষ্ঠ। ২০০৬ সালে তাঁকে সমাহিত করার অনুষ্ঠানে হান্ডকে বক্তব্য রেখেছিলেন। একবার তিনি স্রেব্রেনিৎসায় সার্বিয়ার নৃশংসতার বিষয়টি অস্বীকার করেছিলেন এবং সার্বিয়ার ভাগ্যকে ইহুদিদের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। যদিও তিনি পরে ওই মন্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘মুখ ফসকে বেরিয়েছে।’

পুরস্কার ঘোষণার পর আলবেনিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেন্ট ক্যাকেজ (ইংরেজি উচ্চারণে) ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে টুইটারে লিখেছেন, এই পুরস্কার লজ্জাজনক। একজন ‘গণহত্যা অস্বীকারকারীকে’ পুরস্কারটি দেওয়া হলো।

টুইটারে আলবেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী এদি রামা বলেছেন, ‘কখনো ভাবিনি নোবেল পুরস্কারের কথা ভেবে আমার বমি ভাব হবে।’

কসোভোর প্রেসিডেন্ট হাশিম থাচি টুইটে বলেছেন, ‘নোবেল পুরস্কারের এই সিদ্ধান্ত ভুক্তভোগীদের জন্য অপরিমেয় বেদনা হয়ে দাঁড়াবে।’

স্রেব্রেনিৎসায় আট হাজারের বেশি মুসলিম হত্যার ঘটনায় বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের একজন এমির সুলইয়াগিচ। তিনি বলেন, ‘একজন মিলোসোভিচ-ভক্ত এবং গণহত্যা অস্বীকারকারী কুখ্যাত ব্যক্তি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন...বেঁচে থেকে এও দেখতে হলো।’

বিশ্বজুড়ে লেখকদের সংগঠন পেন আমেরিকার সভাপতি জেনিফার ইগান টুইটারে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছেন, ‘এমন একজন লেখক যিনি তাঁর কণ্ঠকে ঐতিহাসিক সত্যকে মুছে ফেলতে ব্যবহার করেছেন, তাঁকে নির্বাচিত করা খুবই বিস্ময়কর।’

স্রেব্রেনিৎসা শহরে সার্ব বাহিনী আট হাজার মুসলিম পুরুষ ও ছেলেশিশু হত্যা করে। ধর্ষণ করা হয় নারীদের। পোতচারিতে স্রেব্রেনিৎসা গণহত্যার সাক্ষী হয়ে আছে এই সমাধিস্থল। ছবি: এএফপি
স্রেব্রেনিৎসা শহরে সার্ব বাহিনী আট হাজার মুসলিম পুরুষ ও ছেলেশিশু হত্যা করে। ধর্ষণ করা হয় নারীদের। পোতচারিতে স্রেব্রেনিৎসা গণহত্যার সাক্ষী হয়ে আছে এই সমাধিস্থল। ছবি: এএফপি

‘গার্ডিয়ান’-এ দেওয়া সাক্ষাৎকারে ব্রিটিশ লেখক হারি কানজ্রু সমালোচনা করে বলেছেন, ‘যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন আমাদের এমন বুদ্ধিজীবী প্রয়োজন, যাঁরা আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের অবহেলা ও বিদ্বেষপূর্ণ আচরণের মুখে মানবাধিকার রক্ষায় বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারবেন। হান্ডকে তেমন ব্যক্তি নন।’

পুরস্কার পাওয়ার পর পিটার হান্ডকে বলেন, তিনি বিস্মিত হয়েছেন। সুইডিশ একাডেমির এটা খুবই সাহসী সিদ্ধান্ত।

যে গণহত্যাকে অস্বীকার করার জন্য পিটার হান্ডকে এই তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছেন, সে ইতিহাস সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরা যাক।
১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে যুগোস্লাভিয়া থেকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করা হয় বসনিয়া ও হার্জেগোভিনাকে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) স্বীকৃতি চাওয়া হয়। ১৯৯২ সালের মার্চে এক গণভোটে বসনিয়ার ভোটাররা স্বাধীনতা বেছে নেন। প্রেসিডেন্ট আলিজা ইজেৎবেগোচ এটিকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেন। বসনিয়ার বাসিন্দাদের মধ্যে মুসলিম ৪৪, সার্ব ৩১ ও ক্রোয়েট ১৭ শতাংশ। এই তিন জাতির প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারব্যবস্থা গড়ে ওঠে সেখানে। তবে স্বাধীন হয়েও সেখানে শান্তি ফিরে আসেনি, শুরু হয় জাতিগত যুদ্ধ।

স্বাধীনতার এই ঘোষণা বসনীয়-সার্ব রাজনৈতিক প্রতিনিধিরা প্রত্যাখ্যান করে এবং নিজেদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। সার্বীয় সরকারের প্রধান স্লোভোদান মিলোসোভিচের সহায়তায় বসনীয়-সার্ব বাহিনী এবং যুগোস্লাভ পিপলস আর্মি রাষ্ট্রটির সার্বীয় অংশ নিজেদের দখলে নিতে রিপাবলিক অব বসনিয়া ও হার্জেগোভিনায় হামলা চালায়। এরপর খুব দ্রুত বসনিয়াজুড়ে যুদ্ধ শুরু হয়। বসনিয়ার বিভিন্ন অংশের (বিশেষ করে পূর্ব বসনিয়ার) জাতিগত জনগোষ্ঠী এই যুদ্ধে অংশ নেয়।

ক্রোয়েশীয় ও সার্বীয় প্রেসিডেন্ট দুজন নিজেদের মধ্যে বসনিয়াকে ভাগ করার পরিকল্পনা করেছিলেন। সার্ব জাতিসংঘের নিরাপদ এলাকা তুজলা, জেপা ও স্রেব্রেনিৎসায় ঢুকে পড়ে মুসলিম নিধন শুরু করে। বলা হয়, ১৯৯২ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত চলা এই যুদ্ধে আড়াই লাখ মানুষের মৃত্যু হয়।

বসনিয়ার যুদ্ধ চলাকালে সার্ব বাহিনী ছোট শহর স্রেব্রেনিৎসার প্রায় আট হাজার মুসলিম পুরুষ ও ছেলেশিশুকে হত্যা করে। তারা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীদের হেফাজতে ছিল। এর বাইরে বসনিয়া যুদ্ধের জন্য মুসলিম নেতাদেরও অভিযুক্ত হয়ে শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়েছে।

১৯৯৪ সালে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল নেদারল্যান্ডসের হেগে শহরে এই যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু করে। ২০০১ সালে সার্বিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট স্লোভোদান মিলোসোভিচের বিরুদ্ধে বিচার শুরু হয়। দীর্ঘ সময় ধরে চলা এই বিচারের রায় ঘোষণার আগেই ২০০৬ সালে তাঁর মৃত্যু হয়।