অভিজিৎকে দেরিতে অভিনন্দন কেন মোদির?

অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: রয়টার্স
অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: রয়টার্স

অভিজিতের সাফল্যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কি তবে সেভাবে আলোড়িত হননি? অর্থনীতিতে নোবেল পাওয়া ভারতীয় বংশোদ্ভূত এই মানুষটিকে মোদি চার ঘণ্টা পর অভিনন্দন জানান।
অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ভারতের মুম্বাইয়ে। মা-বাবা দুজনই অর্থনীতির স্বনামধন্য অধ্যাপক। তাঁদের কর্মজীবন কেটেছে কলকাতায়ই। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে স্নাতক করেন অভিজিৎ। নয়াদিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় (জেএনইউ) থেকে করেন স্নাতকোত্তর। পিএইচডি করেন যুক্তরাষ্ট্রের সেরা হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বর্তমানে বোস্টনের বিখ্যাত ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) অধ্যাপক তিনি। এখন নোবেল জয় করে প্রাপ্তির খাতা পূর্ণ করেছেন তিনি।

দ্বিতীয় বাঙালি অর্থনীতিবিদ হিসেবে নোবেল জয় করে দেশের মানুষের শ্রদ্ধায় এখন ভাসছেন অভিজিৎ। খবরটা কলকাতায় পৌঁছাতেই অভিনন্দনের বন্যা বয়ে গেছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এক টুইটে বলেন, ‘আরও এক বাঙালি দেশের মুখ উজ্জ্বল করলেন।’ রাজ্য সরকারের শুভেচ্ছাবার্তা ও ফুলের তোড়া খুব তাড়াতাড়িই পৌঁছে যায় সদ্য নোবেলজয়ী অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বালিগঞ্জের বাড়িতে। সেখানে এখন তাঁর মা থাকেন। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই অভিনন্দন জানিয়ে টুইট করেন সোনিয়া গান্ধী, রাহুল গান্ধী। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অত্যন্ত তৎপর প্রধানমন্ত্রী চুপ ছিলেন বেশ কিছুক্ষণ। এই প্রাপ্তি নিয়ে নির্লিপ্ত ছিল ভারতের শাসক দলের সোশ্যাল মিডিয়া সেল। পরে চার ঘণ্টা পর টুইট করেন নরেন্দ্র মোদি। অভিনন্দনবার্তা দেন। এরপর অভিনন্দন টুইট করেন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ।

সরকারের এই নির্লিপ্ততা নিয়ে সংগত কারণেই প্রশ্ন উঠছে রাজনীতির মাঠে। অর্থনীতিতে আরও এক ভারতীয়র নোবেল পাওয়াকে কি খুব বড় বিষয় হিসেবে দেখছে না ভারত সরকার—এমন প্রশ্ন এখন অনেক সরকারি সমালোচকের মুখেই।

আসলে এ প্রশ্নের জবাব পাওয়া খুব কঠিন নয়। কারণ এটা সবারই জানা যে অভিজিৎ মোদি ঘরানার লোক নন। অভিজিৎ জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এই বিশ্ববিদ্যালয় পুরোপুরি মোদির হিন্দুত্ববাদের বিরোধী। অতীতে মোদি সরকারের অনেক নীতির সমালোচনা করেছেন তিনি। বিরোধী কংগ্রেস দলের মূল নীতিগুলোর সঙ্গে একমত তিনি। দারিদ্র্য নিয়ে কাজ, দারিদ্র্য নিয়ে গবেষণা। দারিদ্র্যের সঙ্গে কীভাবে কাজ করছেন বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষ, অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় তা তুলে ধরেছেন নিজের লেখায় বা গবেষণাপত্রে।

২০১৬ সালের নভেম্বরে পুরো ভারত থেকে ৫০০ ও ১ হাজার রুপির নোট উঠিয়ে নেয় মোদি সরকার। সরকারের ওই পদক্ষেপের প্রকাশ্যে তীব্র সমালোচনা করেছিলেন অভিজিৎ । ‘মুদ্রা রোহিতকরণ ব্যর্থ হবে’—একেবারে শুরুতেই বলে দিয়েছিলেন প্রবাসী এই ভারতীয় অর্থনীতিবিদ। ভারতের অর্থনীতি এতে বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হবে, এমন পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। মুদ্রা রোহিতকরণের ৫০ দিন পর এক সাক্ষাৎকারে অভিজিৎ বলেন, ‘আমি এর পেছনে কোন যুক্তি কাজ করছে, তা একেবারেই বুঝতে পারছি না। কেন ২ হাজার রুপির নোট আনা হচ্ছে? ক্ষতির পরিমাপটা আমরা এখনো ঠিকমতো করতে পারিনি, হয়তো তা আমাদের ধারণার চেয়ে অনেক বেশি। কালোটাকা ঠেকিয়ে, দুর্নীতি কমিয়ে ভারতকে ডিজিটাল অর্থনীতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পদক্ষেপ হিসেবে মুদ্রা রোহিতকরণ করেছিল মোদি সকার। তবে ভারতের রিজার্ভ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর রঘুরাম রাজন, অভিজিতসহ অনেক অর্থনীতিবিদই এর বিরোধিতা করেন।

অভিজিতের মোদিবিরোধী অন্যান্য কর্মকাণ্ডের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—দেশের জিডিপির পরিসংখ্যানের তথ্য কারসাজি নিয়ে প্রশ্ন তোলা। ভারতের মোট দেশজ উৎপাদন যে পদ্ধতিতে নির্ণয় করা হয়, তার সমালোচনা করেছিলেন অভিজিৎ। অভিজিৎ, জিএন ড্রেজ, ডাফলো, জয়তি ঘোষ, রীতিকা খেরাসহ ১০৮ অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানী জিডিপি গণনা ও প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যান নির্ণয়ের বেসলাইন বছর নিয়ে ভারত সরকারকে চিঠি দিয়েছিলেন।

এমনকি নোবেল জয়ের পর এমআইটি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় কোনো রকম রাখঢাক না করেই বলেন, ‘আমার মতে (ভারতের) অর্থনীতির হাল এখন খুব খারাপ। জাতীয় নমুনা সমীক্ষার সম্প্রতি প্রকাশিত পরিসংখ্যান বলছে, শহর ও গ্রামাঞ্চলে গড় ভোগের হার কমেছে। অনেক বছর পরে এমন হলো, যা স্পষ্টই একটা সতর্কতা সংকেত।’

সরকারি পরিসংখ্যানের বিষয়ে অভিজিৎ বলেন, ‘পরিসংখ্যান নিয়ে টানাপোড়েন ভারতে নতুন নয়। সরকার মনে করে, যেসব পরিসংখ্যান তার জন্য সুবিধাজনক নয়, তা ভুল। তা সত্ত্বেও আমার মনে হয়, কোথাও যে একটা ভুল হচ্ছে সরকারও সেটা বুঝতে পারছে। অর্থনীতির গতি খুব দ্রুত শ্লথ হচ্ছে।’ তাঁর মতে, চাহিদার অভাবই এখন অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সমস্যা।

২০১৯ সালে সাধারণ নির্বাচনের আগে বিরোধী দল কংগ্রেসকে ন্যূনতম আয়ের গ্যারান্টি পরিকল্পনা তৈরি করতে সহায়তা করেছিলেন অভিজিৎ। তবে অভিজিৎ বরাবরই সরকারবিরোধী, স্পষ্টবাদী ও নির্ভীক হিসেবে পরিচিত। সরকারবিরোধী মনোভাব জেএনইউ ক্যাম্পাসেই তৈরি হয় তাঁর। ছাত্র রাজনীতি করতেন। এমনকি ১৯৮০-এর দশকে জেএনইউতে পড়ার সময় (তখন কংগ্রেস সরকার ক্ষমতায় ছিল) দিল্লির তিহার কারাগারেও যেতে হয়েছিল অভিজিৎকে।

তথ্যসূত্র: কোয়ার্টজ ইন্ডিয়া, ইকোনমিক টাইমস, আনন্দবাজার, রয়টার্স