ভোটে এবারও বিজেপির ভরসা সেই জাতীয়তাবাদ

নরেন্দ্র মোদি
নরেন্দ্র মোদি

বিরোধীরা ছত্রখান। রাজ্যে রাজ্যে ক্রমাগত দলত্যাগে জেরবার কংগ্রেস। কিন্তু তা সত্ত্বেও মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানা বিধানসভার ভোটে জিততে শাসক বিজেপির হাতিয়ার সেই জাতীয়তাবাদ। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর প্রচারে সন্ত্রাসবাদ, পাকিস্তান ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহার ছাড়া বাকি সব গৌণ।

প্রধানমন্ত্রী মোদি প্রচারে গিয়ে কংগ্রেসকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলছেন, হিম্মত থাকলে রাহুল বাবা বলুন, কার স্বার্থে তাঁরা জম্মু-কাশ্মীরে ৩৭০ অনুচ্ছেদ বলবৎ রাখার পক্ষে। কংগ্রেস জবাব দিচ্ছে না। মোদি বলছেন, ওদের ডুবে মরা উচিত। কংগ্রেস চুপ। দশেরার দিন প্রথম রাফাল যুদ্ধবিমান হাতে পেল ভারত। রীতিমতো পূজা–অর্চনা সেরে রাজনাথ সিং তা গ্রহণ করলেন। মোদি বললেন, শত্রু এবার বুঝবে কত ধানে কত চাল। রাজনাথ সিংয়ের সগর্ব ঘোষণা, এবার ঘরে বসেই পাকিস্তানকে গুঁড়িয়ে দেব। অমিত শাহর উবাচ শোনা গেল, ৫৬ ইঞ্চি ছাতি আছে বলেই প্রধানমন্ত্রী কাশ্মীরকে বাকি দেশের সঙ্গে জুড়তে পেরেছেন। কংগ্রেস বিরোধিতা করছে তাদের স্বার্থে, যারা এত বছর কাশ্মীরকে নিজেদের কুক্ষিগত করে রেখেছিল। কংগ্রেস পাকিস্তানের দালাল...। আর বলছেন, ২০২৪ সালের মধ্যে অবৈধভাবে থাকা সব বিদেশিকে খুঁজে বের করে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে ফেরত পাঠাব। সারকথা, লোকসভা ভোটের মতোই মহারাষ্ট্র-হরিয়ানা জিততে জাতীয়তাবাদ এবারও ফের বিজেপির একমাত্র হাতিয়ার।

লোকসভা ভোটের আগে বিরোধী শিবিরের অঙ্ক ছিল শরিকদের ওপর বিজেপির নির্ভরতা বাড়ানো। অতি বড় আশাবাদীরা ভেবেছিলেন, বিজেপিকে নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতার নিচে নামানো সম্ভব। রাহুল গান্ধী তেড়েফুঁড়ে নেমেছিলেন। হাতিয়ার ছিল রাফাল, দুর্নীতি, বেকারত্ব ও চৌপাট হয়ে যাওয়া অর্থনীতি। কিন্তু সবকিছু টেক্কা দিয়ে মোদি ও জাতীয়তাবাদ কেল্লাফতে করায় কংগ্রেস শুয়ে পড়ে। রাহুলের পশ্চাদপসরণ এবং অনিচ্ছুক সোনিয়ার ফের হাল ধরার ক্ষীণ চেষ্টার মধ্যে রাজ্যে রাজ্যে নেতাদের কংগ্রেস ত্যাগের ধুম পড়ে যায়। এই অবস্থায় মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানায় কংগ্রেস লড়ছে স্রেফ লড়াইয়ের ময়দানে থাকার জন্য। কেননা, জনপ্রিয় ধারণা, দুই রাজ্যেই দুই–তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজেপি এবার একাই সরকার গড়ার অধিকার অর্জন করবে। হরিয়ানায় কংগ্রেস ও মহারাষ্ট্রে কংগ্রেস-এনসিপি জোট হারের লজ্জা কীভাবে লুকোবে, সেটা দ্বিতীয় জনপ্রিয় জল্পনা।

ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। ছবি: এএফপি
ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। ছবি: এএফপি

অর্থবল, লোকবল, সাংগঠনিক শক্তি—সবেতেই সীমিত সামর্থ্য নিয়ে কংগ্রেস ভোট-প্রচারে যতটুকু রয়েছে, তাতে বড় করে তুলে ধরছে বেহাল অর্থনীতি, বেকারত্ব, সামাজিক অসন্তোষের মতো জরুরি বিষয়গুলো। এই প্রচারে চিড়ে ভেজার কথা নয়। তবু মূল বিষয় থেকে কংগ্রেস কিন্তু সরছে না। কংগ্রেস প্রচারাভিযানের এক শীর্ষ নেতার কথায়, ‘আমরা জানি, লড়াইটা এই মুহূর্তে অসম। কিন্তু এটাও জানি, সত্য থেকে চোখ ফিরিয়ে বেশি দিন থাকা সম্ভব নয়। গোটা দেশে পেটে টান পড়েই চলেছে। এভাবে জাতীয়তাবাদ ধুয়ে বেশি দিন চলা সম্ভব নয়।’

বিজেপির জাতীয়তাবাদের মোকাবিলায় কংগ্রেসের হাতিয়ারে আচমকাই শাণ দিয়েছেন নোবেলজয়ী বঙ্গসন্তান অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। অর্থনীতি নিয়ে সরকারের সমালোচনায় অমর্ত্য সেনের সঙ্গী হয়ে তিনি শুধু সরবই হননি, জানাজানি হয়ে গেছে, লোকসভায় কংগ্রেসের ‘ন্যায়’ প্রকল্পের জনকও ছিলেন এই নোবেলজয়ী। কংগ্রেসের ভোট-প্রতিশ্রুতি ‘ন্যায়’ মানুষ গ্রহণ করেনি। সে অন্য কথা। আসল কথা হলো, অর্থনীতি ঝকমকে করতে গেলে কৃষিপ্রধান ভারতে গ্রামীণ মানুষের চাহিদা বাড়ানোই যে একমাত্র উপায়, অবশেষে তা স্বীকৃতি পাওয়া। সব মহলই এখন মনে করছে, চাহিদা না বাড়লে অর্থনীতি বল পাবে না। চাহিদা বাড়াতে গেলে গ্রামীণ মানুষের হাতে অর্থ জোগান দিতেই হবে। সেই জোগানের কথাই বলা হয়েছিল ‘ন্যায়’ প্রকল্পে। অতি দরিদ্রদের হাতে মাসে ছয় হাজার করে বছরে ৭২ হাজার টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল কংগ্রেস। সেই একই কথা এখনো বলে চলেছেন অর্থনীতিবিদেরা, যাঁদের মধ্যে সরকারের কাছের মানুষজনও রয়েছেন।

কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী। ছবি: রয়টার্স
কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী। ছবি: রয়টার্স

বিজেপির বিড়ম্বনা অভিজিৎ যতটা বাড়িয়েছেন, তার চেয়ে বেশি বাড়িয়েছেন মোদি সরকারের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের অর্থনীতিবিদ স্বামী পরকাল প্রভাকর। বেহাল অর্থনীতির কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেওয়ার মতো এক প্রবন্ধে (ইংরেজি দৈনিক দ্য হিন্দুতে) তিনি লিখেছেন, গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড়ানো ভারতীয় অর্থনীতির উচিত নরসিংহ রাও-মনমোহন সিংয়ের দেখানো পথে হাঁটা। তাঁদের মডেল অনুসরণ করা। সেই মডেল অনুযায়ীই অভিজিতের পরামর্শে কংগ্রেস ‘ন্যায়’ প্রকল্প চালু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সেই মডেল অনুযায়ীই পরিত্রাণের নিদান বাতলেছেন রিজার্ভ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর রঘুরাম রাজন ও প্রধানমন্ত্রী মোদির ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রাহ্মণ্যম। পরকাল প্রভাকরের দাওয়াইয়ের মোদ্দাকথাও সেই এক।

অমর্ত্য সেনকে বিজেপির গালমন্দ হজম করতে হচ্ছে নিয়মিত। একই হাল অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়েরও। কিন্তু খোদ অর্থমন্ত্রীর স্বামীর এই কিল-মারা প্রেসক্রিপশন নীরবে হজম করতে হচ্ছে মোদি-সরকারকে। অভিজিতের নোবেলপ্রাপ্তি নামক বোঝার ওপর প্রকাল প্রভাকর হয়ে উঠেছেন শাকের আঁটি!

বিজেপি বিপুল সমর্থনে মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানা জিতে আগামী দিনে ঝাড়খন্ড ও দিল্লি দখলে মনোযোগী হবে। বোঝাতে চাইবে ‘অল ইজ ওয়েল’। সেই একপেশে লড়াইয়েও জাতীয়তাবাদ হাতিয়ার করা ছাড়া তাদের অন্য কোনো বিকল্প থাকবে না। কেননা, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার বা মুডিজের মতো অর্থনৈতিক রেটিং এজেন্সিগুলো কেউই আগামী দিনে ভারতের অর্থনীতির উত্তরমুখী হওয়ার ক্ষীণতম সম্ভাবনার ইঙ্গিত এখন পর্যন্ত দিতে পারেনি।